ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ভাষা, গল্প ও হ‌ুমায়ূন আহমেদ

মাসউদ আহমাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩৩, ১৯ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ১৩:০২, ১৩ নভেম্বর ২০২০
ভাষা, গল্প ও হ‌ুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদের ব্যবহৃত আলোকচিত্র : নাসির আলী মামুন

হ‌ুমায়ূন আহমেদের গল্পে কোনো ভান নেই। আখ্যানের কেন্দ্রে ও বাইরে ভাষার অলৌকিক পিরামিড নেই। গল্পে লিখনশৈলী নিয়ে আলাদা করে প্যাঁচ-পাঁয়তারাও নয়। তিনি নিয়তিতাড়িত মানুষের জীবন-সংসার আর ব্যক্তিমনের নিখাঁদ গল্প বলেছেন স্বকীয় ভঙিতে। এক ধরনের মনোজগৎ আচ্ছন্ন করে তোলা অনুভব-অভিজ্ঞতায় গল্প বুনে গেছেন। আর একইসঙ্গে তাঁর গদ্যভঙিটি আটপৌরে, মেদহীন, নির্ভার, সাদামাটা; কিন্তু অন্তরঙ্গ। তাঁর কোনো একটি গল্প বা উপন্যাস এমনকি গদ্য- হোক তা প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের মতো নাক উঁচু ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা, একবার পড়তে শুরু করলে, বইটি পড়ব কিনা তা মনস্থির করার ভাবনায় থিতু হতে হতে প্রথম পৃষ্ঠার কয়েকটা লাইনে চোখ রাখি; তারপর, পড়তে গিয়ে দেখা যায় কখন যেন পৃষ্ঠা ফুরিয়ে গেছে। গল্পে শৈলীর চেয়ে জীবনের নির্মম ও মুগ্ধকর সংবেদনটুকুই তুলে ধরেছেন তিনি। চেনা জীবন ও জগতের গল্প দিয়েই তিনি পাঠকের বোধ আর অভিজ্ঞতায় নতুন চেতনার রং মেখে দিয়েছেন এমন এক ভাষায় যার আবেদন এড়ানো যায় না। তাঁর গল্প পাঠের পর, আমরা আপ্লুত হই। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠি। কখনো বেদনার ভার ও ভায়োলিনে লীন হই। ভেজা চোখেও আমাদের বিস্ময় জাগে, পাশ ফিরে তাকাই, ভাবি-আহা, জীবনে এমনও হয়!

তাঁর ‘সৌরভ’ গল্পটির কথাই ধরা যাক। এই গল্পটি তাঁর লেখালেখির শুরুর দিকে লেখা। তখন সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হয়েছেন- রসায়নের প্রভাষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে ঘর পাননি বলে ময়মনসিংহ শহরে দূরসম্পর্কের এক খালার বাড়িতে থাকতেন। তখন এই গল্পটি তিনি লেখেন। খুবই সরল ভঙিতে গল্পটি শুরু হয়েছে-

‘আজহার খাঁ ঘর থেকে বেরুবেন, শার্ট গায়ে দিয়েছেন, তখনি লিলি বলল, বাবা আজ কিন্তু মনে করে আনবে।

তিনি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের দিকে। মেয়ে বড় হয়েছে, ইচ্ছে করলেও ধমক দিতে পারেন না। সেই জন্যেই রাগী চোখে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ।

লিলি বলল, রোজ মনে করিয়ে দেই। আজ আনবে কিন্তু।

সামনের মাসে আনব।

না, আজই আনবে।

রাগে মুখ তেতো হয়ে গেল আজহার খাঁর। প্রতিটি ছেলেমেয়ে এমন উদ্ধত হয়েছে। বাবার প্রতি কিছুমাত্র মমতা নেই। আর নেই বলেই মাসের ছাব্বিশ তারিখে দেয়ালে হেলান দিয়ে দৃঢ় গলায় বলতে পারে, না, আজই আনতে হবে।

তিনি নিঃশব্দে শার্ট গায়ে দিলেন। চুল আঁচড়ালেন। জুতা পরলেন। জুতার ফিতায় কাদা লেগে ছিল, ঘষে ঘষে সাফ করলেন। লিলি সারাক্ষণই বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি বেরুবার জন্যে উঠে দাঁড়াতেই বলল, বাবা আনবে তো?

মেয়েটার গালে প্রচণ্ড একটি চড় কষিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা প্রাণপনে দমন করে তিনি শান্ত গলায় বললেন, টাকা নেই, সামনের মাসে আনব।

লিলি নিঃশব্দে উঠে গেল।’

[হ‌ুমায়ূন আহমেদ, বাছাই গল্প, অন্যপ্রকাশ ঢাকা; ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃ. ১৭]।

একা একা অনেকদিন ভেবেছি, উত্তম-সুচিত্রার বাংলা সিনেমা মানুষ কেন এমন ব্যাকুল হয়ে দেখেছে? কারণ নিপাট অভিনয়। দুজনেরই, বিশেষ করে উত্তমের সরল ও স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়। কোনো কৃত্রিমতা নেই, ভনিতা নেই; আছে নিখাঁদ অন্তরঙ্গ কথার মোহিনী শক্তি ও দৃশ্যপট। মানুষের মন ভরে যেত সেসব দেখে। উত্তমের উপমা এখানে টানার কারণ হচ্ছে, গল্প বলার ক্ষেত্রে হ‌ুমায়ূনের ভাষাটা দখলে ছিল। তিনি হয়ত ঢাকার সমাজ-সংসারের গল্প বলছেন, বা অন্য কোনো জনপদের গল্প- তিনি ময়মনসিংহের ভাষা ব্যবহার করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর যুক্তি ছিল, ময়মনসিংহের ভাষাটা তিনি ভালো জানেন। অধিকাংশ গল্প বলার সময় এ বিষয়টি তিনি অত্যন্ত চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন। আর তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এই খুব সাধারণ একটি বিষয়কে অসামান্য দক্ষতায় মানবিক গল্পে রূপান্তরিত করতে পারতেন। এ দৃষ্টান্ত আমাদের এখানে বিরল। সামান্য বিষয়কে তিনি গল্পের কাঠামোতে ধরে সেখানে প্রাণ-প্রাচুর্য ও জীবনের প্রবহমান ঝর্নাধারা বইয়ে দিতে পারতেন। ‘সৌরভ’ গল্পেও সেই জিনিসটি ধরা আছে অসামান্য শিল্পকুশলতায়।

তাঁর উপন্যাস নিয়ে সমালোচকদের মধ্যে অনেক রকম কথা চালু আছে-হালকা লেখা। গভীর জীবনবোধ নেই। ঢলঢলে গল্প। সাহিত্যের ইতিহাসে টিকবে না। লোকটা বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি করেছেন। ইত্যাদি। কিন্তু এটাও খুব বিস্ময়কর ব্যাপার যে, তাঁর লেখার নির্মম সমালোচকরাও বলেন, হ‌ুমায়ূনের ছোটগল্প অসাধারণ। কারণ কী? জানি না। জানতে ইচ্ছে করে। একজন লেখকের কোনো লেখা সময়ের ঘা সয়ে টিকবে কিনা সেটা বলা শক্ত। এটা সময়ই নির্ধারণ করে। কারণ সময় ভোলে না কিছু এবং সে মস্ত বড় বিচারক। কিন্তু বিপুল পাঠকের ভালোলাগা অর্জন করে তাদের মুগ্ধতায় অবশ করে রাখা বছরের পর বছর-কম কথা নয়। পাঠকের পাঠতৃষ্ণা মেটানোর এই কৃতিত্ব কব্জা করা তুলনারহিত। এবং এটা গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজটি অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে করে গেছেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ।

যে কথাটি মোটাদাগে বলা দরকার- গল্প বা উপন্যাসে বা তাঁর সমস্ত রকম রচনায় শিল্পমান ও শৈলী যেন ভাষার সঙ্গে মিলেমিশে আছে। গল্পে ভাষার সৌন্দর্য ও ক্ষমতা কত চমৎকার এবং প্রভাববিস্তারী হতে পারে, ভাষার সরলতা ও লাবণ্য কত ব্যাপকভাবে তুলে আনা যায়, তিনি তা দেখিয়ে গেছেন। মানুষের কত কাছে ভাষাকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, সেই জাদু দেখিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর গল্প-উপন্যাসে শীতরাতের কুয়াশাভরা পরিবেশ, চৈত্রের মধ্যদুপুর, বৃষ্টিদিন কিংবা চাঁদনি রাতের বর্ণনা এমন মনোরম ভঙিতে উঠে এসেছে, মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। এসবের পেছনে জোরালোভাবে কাজ করে তাঁর সরল ও নির্মেদ ভাষার দ্যুতি। হ‌ুমায়ূনের লেখা; বিশেষ করে তার ছোটগল্প পাঠের পর তা দারুণ অনুভব করা যায়।

এ বিবেচনাও আমরা মাথায় তুলে রাখতে ভুলি না, যে, ভাষা তো লেখেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, যেমন ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’য়-‘এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তার রিকশা চলছে ছলছল করে যেনো গোটিয়ার বিলে কেউ নৌকা বইছে, ‘তাড়াতাড়ি করো বাহে, ঢাকার গাড়ি বুঝি ছাড়ি যায়।’ আমার জানলায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারেরর ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলী-লগ্ন আমি কতোদিন পাইনি, কতোকাল, কোনোদিন নয়’; কিংবা হাসান আজিজুল হক তাঁর ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’এ- ‘এখন নির্দয় শীতকাল, ঠাণ্ডা নামছে হিম। চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়’; হাসান আজিজুলের ভাষায় সোনায় মোড়া কথাশিল্পী শহিদুল জহীরের ভাষা তো আরও অন্যরকম সুন্দর।তাঁর ‘কোথায় পাব তারে’ গল্পের কথাই ধরা যাক-‘দক্ষিণ মৈশুন্দি, ভূতের গলির লোকেরা পুনরায় এক জটিলতার ভেতরে পড়ে এবং জোড়পুল ও পদ্মনিধি লেনের, ওয়ারি ও বনগ্রামের, নারিন্দা ও দয়াগঞ্জের লোকেরা তাদের এই শঙ্কটের কথা শুনতে পায়; তারা, ভূতের গলির লোকেরা বলাবলি করে: আমরা পুনরায় আব্দুল করিমের কথায় ফিরে যেতে চাই’; কিংবা আমাদের মাস্টার লেখক মাহমুদুল হকের ‘হৈরব ও ভৈরব’ গল্পে খেয়াল করলে দেখি- ‘মন অন্নময়, কি বুঝছস, অন্ন নাই তো মনই নাই; শ্যাষম্যাষ হ্যা অন্নেই ধরছে টান, তো মন পামু কই’- কিছুক্ষণের জন্যে থামে হৈরব। কথার ফাঁকে ফাঁকে সবসময় এইভাবে জিরিয়ে নেয়। একটা পিনপিনে নীলমাছি তার ফেকো মুখে গোত্তা খায়। হাতের চেটোয় মুখ মুছে সে আবার বলে, ‘মন আছিল যেমুন হিজল, নাভিজলে গেন্দবয়রা হয়া খারায়া রইছে, রাও নাই’; -এঁরা সবাই বড় লেখক এবং জীবিত থাকাকালীন প্রত্যেকেই কালজয়ী লেখকের তীলকরেখা পেয়েছেন।

কিন্তু তাঁদের গল্প থেকে এই উদাহরণগুলো টানার কারণ কী?

কারণ এই যে, একই সমাজ-সংসারের ভেতরে দিনযাপন করেও হুমায়ূন এমন এক ভাষাভঙি রপ্ত করেছিলেন, যে ভাষার সৌরভ ও গৌরবের ছায়াচিত্র তাঁর যে কোনো গল্প বা উপন্যাস পড়তে বিশেষভাবে আগ্রহী করে তোলে পাঠককে। এ জন্য কোনো প্রলুব্ধকরণের কৌশল দরকার হয় না। পাঠানন্দই তখন পাঠকের আরাধ্য ও একমাত্র বিষয় হয়ে ওঠে। এখানেই তাঁর গল্পের বিশেষত্ব এবং স্বাতন্ত্র। ফলে কাজের বুয়ার দিনযাপনের সরল-সাধারণ গল্প ‘অতিথি’ কিংবা সিরিয়াস গল্প ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’, ‘খাদক’, ‘চোখ’, ‘অয়োময়’, ‘পিঁপড়া’ বা ‘জনক’ প্রভৃতি গল্প লেখার সময় তিনি ভাষার সারল্য ও সৌন্দর্যের রেণু মিশিয়ে দিয়েছেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসকে উপজীব্য করে লেখা তাঁর দীর্ঘ উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ বা ‘বাদশাহ নামদার’-এ ভাষার লাবণ্য ও আকর্ষণ বদলায়নি। অন্যদিকে, উল্লেখিত নমস্য লেখকদের ভাষাটা একটু অন্যরকম। সেই অন্যরকমটা কেমন? তুলে রাখা প্রিয় পোষাকের মতো? হয়ত। কিংবা বিশেষ দিনের বিশেষ খাবারের ন্যায়। লেখা শেখার জন্য পাঠ, সঙ্গে নূতন ভাবনা-চিন্তার রসদ সঞ্চয় করা- যে সঞ্চয় পাঠকের পাঠাভিজ্ঞতা ঋদ্ধ করে। নতুনতর বোধ জাগিয়ে দিতে প্রেরণার সঞ্চার করে। তবু এঁদের ভাষাটা যেন তেমনই। তুলে রাখা কাপড়ের মতো ভারি।

উচ্চাকাঙ্ক্ষী বা নিরীক্ষাপ্রবণ গল্পকারের ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটে, গল্পের মুখোশ তৈরি করতে গিয়ে অনেকসময় মুখশ্রী ঢাকা পড়ে যায়। তখন হয় কী, গল্পের বিন্যাস অধরা থেকে যায়; জীবনের সূক্ষ্ম সুষমা কিংবা অভিঘাতও। গল্পের আঙ্গিককে হ‌ুমায়ূন আহমেদ বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন বলে মনে হয় না। তাঁর গল্পে নেই স্মার্টনেসের বা অতিআধুনিক গল্প লেখকের চমকও। তবে কী আছে? আছে জীবন সম্বন্ধে গভীর অভিজ্ঞতা ও দরদ। গল্পের চরিত্রচিত্রণ ও পরিপার্শ্ব নির্মাণে তিনি এমন নিপুণ শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন, গল্পের সৌন্দর্য তখন সমস্ত ব্যাকরণকে ছাপিয়ে প্রধান হয়ে ওঠে। ঘরোয়া ভঙ্গিতে, সংবেদী ঢঙে মানুষের দৈনন্দিন হাসি-কান্নার অনুপম ছবি আঁকায় তাঁর পারঙ্গমতা আকর্ষণীয়, অপরূপ এবং প্রাতিস্বিক। আর ভাষার লাবণ্য তাতে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ দখল করে আছে।

একবার এক অনুরাগী-পাঠক-হুজুরের সঙ্গে দেখা হয় হ‌ুমায়ূন আহমেদের। সে অনেক আগের কথা। অন্যপ্রকাশের বাংলাবাজারের শো-রুম উদ্বোধনের জন্য মিলাদের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই মিলাদ পড়ানোর জন্য হুজুরকে ডেকে আনা হয়েছিল। সেখানে আমন্ত্রিত অনেক অতিথির সঙ্গে হ‌ুমায়ূনও ছিলেন। মিলাদ পড়ানো শেষ হলে সেই হুজুর হ‌ুমায়ূনের কাছে এসে তাঁকে অনুরোধ করলেন, যে, স্যার, আপনি এত ভালো লেখেন; খুব সুন্দর আপনার লেখার ভাষা। অনেক মানুষ আপনার লেখা পড়ে। আপনি যদি স্যার, আমাদের নবীজির জীবনীটা লেখেন, তাহলে মানুষ খুব আগ্রহ নিয়ে পড়বে। হ‌ুমায়ূন কী ভেবে রাজি হয়ে গেলেন এবং তিনি বিষয়টি নিয়ে লিখবেন ঠিক করেন। দুঃখজনক বিষয় এই, লেখাটা শুরু করলেও, বেশ খানিকটা লেখাও হয়েছিল কিন্তু লেখাটা তিনি শেষ করে যেতে পারেননি।

প্রসঙ্গটি এ জন্য যে, একজন হুজুর মানুষও হ‌ুমায়ূনের কতটা ভক্ত হলে এমন প্রস্তাব করতে পারেন। আর এটার মূলে সেই ভাষা প্রসঙ্গ। ভাষার সারল্য ও লাবণ্যের কারণেই তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

বাঙালি মাছে-ভাতে তুষ্ট থাকে, তাই এরা আরামপ্রিয় জাতি। এটা খারাপ বা দোষের কিছু নয়। কিন্তু আরামের মাত্রাটা বেশি হয়ে গেলে আলসেমি পেয়ে বসে। তখন কাজে আর যাপনে ধ্বস নামে। সেটা অবশ্যই খারাপ। হ‌ুমায়ূন আহমেদও সেই আরামের আয়েশি হাওয়া ছেড়ে দূরে সরে থাকতে পারেননি। ফলে তাঁর অজস্র মুগ্ধ পাঠকও একসময় বলতে শুরু করেছিলেন-তাঁর লেখায় আর আরাম পাই না। মিসির আলি পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু হিমু সিরিজের লেখার ধাঁচ ও প্যাঁচ যখন তাঁর গল্পের মধ্যেও ঢুকে পড়লো- গল্পও বসে যেতে শুরু করলো। মারা যাওয়ার আগে আগে তিনি সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কিছু উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন; যেমন ‘মধ্যাহ্ন’, ‘মাতাল হাওয়া’, ‘বাদশা নামদার’, ‘যখন নামিবে আঁধার’ বা ‘দেয়াল’।  তেমনি কিছু গল্পও তিনি লিখে গেছেন হিমু সিরিজের গল্পের মতো চটুল এবং মজাদার, যা তাঁর গল্পের ধারা থেকে অনেক দূরের শিল্পযাত্রায় পর্যবসিত। যেমন এখন মনে পড়েছে তাঁর ‘রস কষ সিঙ্গারা বুলবুলি মস্তক’ গল্পটির কথা [নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ, অন্যপ্রকাশ; বইমেলা ২০১২]।

বিচিত্র বিষয় ও ভাবনাকে উপজীব্য করে গল্প লিখেছেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ। অতিপ্রাকৃত গল্প, প্রেমের গল্প, রহস্য গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প এমনকি ‘উদ্ভট গল্প’ বলেও তাঁর গল্পের সংকলন আছে। জীবনকে তিনি কতভাবে এবং কী রং ও রেখায় অবলোকন করেছেন, এসব গল্পে তার ভাষ্য লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু মজার ব্যাপার, গল্পে তিনি কোনো সমাধান দেননি, উত্তর বা উপদেশ দেননি; রহস্য রেখে দিয়েছেন। নিজস্ব ভাষা-ভাব ও শিল্পকুশলতায় তিনি আমাদের প্রধান গল্পকারের একজন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মৃত্যুর কয়েক বছর পরেও; সুদীর্ঘ সময় পার করেও তিনি যে স্বমহিমায় ভাস্বর থাকবেন তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।




ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়