ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

যেভাবে আমি মিগ্যেল স্ট্রিট ছাড়লাম

মাহামুদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৮, ১৩ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যেভাবে আমি মিগ্যেল স্ট্রিট ছাড়লাম

 

মা বলেছিল, ‘তুই এখানে থেকে বড্ড ইঁচড়েপাকা হয়ে যাচ্ছিস। আমার মনে হয় এখন তোর এখান থেকে চলে যাওয়ার উপযুক্ত সময়।’

আমি বললাম, ‘কোথায় যাবো? ভেনেজুয়েলা?’

‘না, ভেনেজুয়েলা নয়। অন্য কোথাও, কারণ ওখানে পৌঁছানোর সাথে সাথে ওরা তোকে জেলে পুরে দেবে। আমি তোকে চিনি আর ভেনেজুয়েলাকেও। না, অন্য কোথাও যা।’

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। তুমি এটা নিয়ে ভাবো এবং ঠিক করো।’

মা বললো, ‘আমি গিয়ে গণেশ পণ্ডিতের সাথে কথা বলবো। তিনি তোর বাবার বন্ধু ছিলেন। কিন্তু তোকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। তুই হতচ্ছাড়া হয়ে যাচ্ছিস।’

আমার মনে হয় মা ঠিক ধরেছিল। কোনো কিছু ঠিকমতো বুঝতে না পেরেই আমি কিছুটা বখে গিয়েছিলাম। আমি মাছের মতো করে মদ খাচ্ছিলাম আর এটা-সেটা করে বেড়াচ্ছিলাম। মদ খাওয়ার অভ্যাসটা শুরু হয়েছিল শুল্ক অফিসে, যেখানে আমরা নূন্যতম কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই মালামাল আটক করছিলাম। প্রথম দিকে কড়া স্পিরিটের গন্ধ সহ্য করতে পারতাম না। কিন্তু আমি নিজেই নিজেকে বলতাম যে, ‘তোমাকে এটা পারতেই হবে। ওষুধ মনে করে গিলে ফেল। নাক চেপে ধরো এবং চোখ বন্ধ করে ফেল।’ সময়ের সাথে সাথে আমি নাম্বার ওয়ান মদখোর বনে গেলাম এবং আমি গলা ডুবিয়ে মদ খেতে পারি এমন গর্বে ভুগতে শুরু করলাম।
তার উপর ছিল বয়ি আর এরল, যারা আমাকে এই শহরের জায়গাগুলো চিনিয়ে দিয়েছিল। কাজ শুরু করার অল্পদিনের মধ্যেই, এক রাতে, তারা আমাকে মেরিন স্কয়ারের কাছে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। একতলার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর আমরা সবুজ বাতি জ্বালানো ছোট্ট কিন্তু জনাকীর্ণ একটা ঘরে প্রবেশ করলাম। সবুজ বাতিগুলোকে জেলির মতো থিকথিকে মনে হলো। ঘর ভর্তি অনেক মেয়ে, যারা শুধু অপেক্ষা চেয়েছিল। সাথে বড় করে একটা লেখা টানিয়ে রাখিা: অশ্লীল ভাষা নিষিদ্ধ।
বারে গিয়ে আমরা একটা করে ড্রিংক নিয়েছিলাম। সেটা ছিল বেশ ঘন এবং সুমিষ্ট। এরল আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোন মেয়েটাকে তোমার পছন্দ হয়?’ আমি তৎক্ষণাত ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম এবং আমার গা ঘিনঘিন করে উঠলো। দৌড়ে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে, একটু আতঙ্ক আর একটু অসুস্থতা নিয়ে আমি বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। আমি নিজেকে বলেছিলাম- আমাকে এসব কাটিয়ে উঠতেই হবে।

পরের রাতে আমি আবার সেই ক্লাবে গিয়েছিলাম। এবং তারপর থেকে নিয়মিত। আমরা খুব জম্পেশ পার্টি করেছিলাম। রাম আর মেয়েদেরকে নিয়ে আমরা সারারাতের চুক্তিতে মারাকাস বে তে গিয়েছিলাম।

মা বলেছিল, ‘তুই চরম বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছিস।’

এক সন্ধ্যায় এতো বেশি মদ গিলেছিলাম যে পরের দুদিন অবধি আমি নেশার ঘোরে ছিলাম। তার আগ পর্যন্ত আমি মা’র কথায় পাত্তা দেইনি। তারপর নেশা কেটে গেলে আমি ধূমপান আর মদ না খাওয়ার কসম কেটেছিলাম। মাকে বলেছিলাম, ‘আমার সত্যি কোনো দোষ নেই। এটা ত্রিনিদাদ। মদ গেলা ছাড়া এখানে করার মতো কারো জন্য আর আছেই বা কি?’
মাস দুয়েক পর মা বলেছিল, ‘আমার সাথে চল। আমরা গণেশ পণ্ডিতের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।’
গণেশ পণ্ডিত বেশ অনেক দিন আগেই সাধুগিরি ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। তার বেশ নাম-যশও হয়েছে। তিনি কোনো এক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা সরকারের তেমন কিছু একটা হয়েছিলেন। লোকমুখে শুনেছিলাম যে তিনি এমবিই (মেম্বার অব দি অর্ডার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ার) হওয়ার দৌড়ে আছেন।

আমরা সেন্ট ক্লেয়ারে তার বিশাল বাড়িতে গিয়েছিলাম। সাধুগিরির সময়ের ধুতি আর কুর্তার বদলে তার পরনে ছিল দামি লাউঞ্জ স্যুট। আমার মাকে তিনি সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। তারপর বললেন, ‘আমি আমার সধ্যমত চেষ্টা করবো।’

মা কাঁদতে শুরু করেছিল।

গণেশ আমাকে বললেন, ‘বিদেশে গিয়ে কি পড়তে চাও তুমি?’

আমি বললাম, ‘আমি আসলে কিছু পড়তে চাই না। আমি শুধু এখান থেকে চলে যেতে চাই। ব্যস, আর কিছু না।’

মুচকি হেসে গণেশ বললেন, ‘সরকার এখনো পর্যন্ত তেমন স্কলারশিপ দেয়া শুরু করেনি। তুমি যা চাচ্ছো, সেটা কেবলমাত্র মন্ত্রীরাই করতে পারে। তোমাকে কিছু একটা পড়তে হবে।’

আমি বললাম, ‘আমি কখনো বিষয়টা সেভাবে ভাবিনি। আমাকে কিছুটা সময় দিন।’

গণেশ বললেন, ‘ঠিক আছে। তুমি অল্প একটু চিন্তা করো।’

আমার মা ওদিকে কাঁদতে কাঁদতেই গণেশকে ধন্যবাদ দিতে লাগল। আমি আমার কাকা ভাকুর কথা চিন্তা করতে করতে বললাম, ‘আমি জানি আমি কি পড়তে চাই। ইঞ্জিনিয়ারিং।’

গণেশ অট্টহাসি দিয়ে বললেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং তুমি কি জানো?’

আমি বললাম, ‘এখন পর্যন্ত কিছুই জানি না। কিন্তু আমি মন লাগিয়ে পড়লে সব জানতে পারবো।’

মা বলল, ‘তুই আইন বিষয়ে পড়তে চাস না কেন?’

চিত্তরঞ্জন আর তার গায়ের বাদামী স্যুট-এর কথা ভেবে আমি বললাম, ‘না, আইন তো নয়-ই।’

গনেশ বললো, ‘মাত্র একটা স্কলারশিপ খালি আছে। ওষুধের উপর।’

আমি বললাম, ‘কিন্তু আমি ড্রাগিস্ট হতে চাই না। সাদা কোট গায়ে দিয়ে মেয়েদের কাছে আমি লিপস্টিক বেচতে চাই না।’

গণেশ হাসলেন। আমার মা বলল, ‘ছেলের কথায় আপনি কিছু মনে করবেন না, পণ্ডিত। ও ওটাই পড়বে।’ আর আমার দিকে তাকিয়ে মা বলল, ‘তুই মন লাগিয়ে পড়লে সব পড়তে পারবি।’

গণেশ বললেন, ‘ভেবে দেখো। তোমাকে লন্ডন যেতে হবে। ওখানে তুষারপাত দেখতে পাবে। টেমস নদী আর বড় সংসদ ভবন।’

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। আমি ওষুধ নিয়েই পড়তে যাবো।’

আমার মা বলল, ‘আমি জানি না কি করে আপনাকে ধন্যবাদ দেব, পণ্ডিত।’ আর কাঁদতে কাঁদতেই গুনে গুনে দু’শ ডলার গণেশের হাতে দিল। তারপর বললো, ‘আমি জানি এটা খুব বেশি নয়, পণ্ডিত। কিন্তু আমার কাছে আর কিছু নেই। অনেক দিন ধরে আমি এই টাকাটা জমা করেছি।’
গণেশ বেদনাহত হয়ে টাকাটা নিলেন এবং মাকে বললেন, ‘ওসব নিয়ে ভাববেন না। আপনার সাধ্যের মধ্যে যা আছে তা-ই দেবেন।’

আমার মা কাঁদতেই থাকলো আর শেষে, গণেশও নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না।

মা যখন এটা দেখল তখন সে তার চোখ মুছে বলল, ‘আপনি যদি জানতেন আমি যে কি দুশ্চিন্তায় আছি, পণ্ডিত। কতো কিছুর জন্য যে আজকাল আমাকে টাকা জোগাড় করতে হচ্ছে। আমি সত্যিই জানি না কি দিয়ে যে কি করবো। কীভাবে চলবো?’
গণেশ ততোক্ষণে কান্না থামিয়ে দিয়েছেন। আমার মা আবার নতুন করে কাঁদতে শুরু করলো। আর সেটা চলতে থাকলো যতোক্ষণ না গণেশ আমার মাকে একশ ডলার ফেরত দিলেন। তিনি ফোঁপাচ্ছিলেন আর কাঁপছিলেন। কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘এই টাকাটা রাখুন। ছেলের জন্য ভালো কিছু জামাকাপড় কিনে দেবেন।’

আমি বললাম, ‘পণ্ডিত, আপনি খুব ভালো মানুষ।’

এটা তাকে খুব ভালোমতো নাড়া দিয়েছিল। তিনি বললেন, ‘তুমি যখন ইংল্যান্ড থেকে বড় মানুষ হয়ে, সব সার্টিফিকেট নিয়ে, বড় ড্রাগিস্ট হয়ে ফিরে আসবে, তখন আমি তোমার কাছে আমার পাওনা বুঝে নেব।’

হ্যাটকে বলেছিলাম যে, ‘আমি চলে যাচ্ছি।’

সে তাচ্ছিল্যভরে বলেছিল, ‘কী করতে? কাজ?’

আমি বললাম, ‘ওষুধ নিয়ে পড়ার জন্য সরকার আমাকে স্কলারশিপ দিয়েছে।’

সে বলল, ‘তুই এই বাটপারিটা করেছিস?’

আমি বললাম, ‘আমি না। আমার মা।’

এদ্দোস বলেছিল, ‘আরে এটা খুবই ভালো। প্রায় বছর হয়ে এলো আমি একজন ড্রাগিস্টের হয়ে এটা-সেটা করি। সে বিশাল টাকা পয়সার মালিক। তুই বিশ্বাস করবি না, সে টাকার উপর গড়াগড়ি খায়।’

খবরটা ইলিয়াসের কানেও যায়। কিন্তু সে এটাকে হজম করতে পারেনি। একদিন সন্ধ্যায় সে আমাদের দরজার কাছে এসে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘ঘুষ, ঘুষ না দিলে কি এমনি এমনি হয়! তোমরা যা করতে পারো তা হলো, দুর্নীতি।’

আমার মা-ও চেঁচিয়ে উত্তর দিয়েছিল, ‘যাদের ঘুষ দেবার মতো কিছু থাকে না, তারাই ঘুষ নিয়ে হাউকাউ করে।’
এক মাসের মধ্যে আমার যওয়ার সব বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছিল। ত্রিনিদাদ সরকার নিউ ইয়র্কে অবস্থিত ব্রিটিশ কাউন্সিল অফিসকে আমার সর্ম্পকে অবহিত করেছিল। সেখান থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিল আমার সর্ম্পকে জানতে পারে। সশস্ত্র বিদ্রোহ করে আমি তাদের সরকার ফেলে দেব না, আমেরিকানরা এই শর্তে আমাকে ভিসা দিয়েছিল। আমার যাওয়ার আগের রাতে, মা ছোট্ট একটা পার্টি দিয়েছিল। বিষয়টা ঠিক সবাইকে জানান দেয়ার মতো আরকি। প্রতিবেশী আর আমন্ত্রিতরা মুখ ভার করে এসেছিল আর আমাকে বলেছিল যে, তারা আমাকে কতোটা মিস করবে। কিন্তু তারপর তারা আমাকে ভুলে গিয়ে খাওয়া আর পানাহারের আসল কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেছিল। লরা আমার গালে চুমু দিয়েছিল। আরো দিয়েছিল সেন্ট ক্রিস্টোফারের একটা মেডেল। সেটা সে আমাকে গলায় পরতে বলেছিল। আমি তাকে কথা দিয়ে মেডেলটা আমার পকেটে পুরেছিলাম। পরে সেটার আর কোনো খোঁজ পাইনি। মিসেস ভাকু আমাকে একটা সিক্স পেনি কয়েন দিয়ে বলেছিলেন যে তিনি সেটা এক বিশেষ এবং পবিত্র উদ্দেশ্যে জমিয়ে রেখেছিলেন। অন্য সাধারণ সিক্স পেনি কয়েনের সাথে এটার কোনো পার্থক্য ছিল না। আর আমার মনে হয় আমি সেটা খরচ করে ফেলেছি। টিটাস হয়ত আমার সব দুষ্টুমি ক্ষমা করেছিলেন এবং সবার জন্য টেনিসন-এর দ্বিতীয় খণ্ডটা এনেছিলেন। এদ্দোস আমাকে একটা মানিব্যাগ দিয়েছিল আর কসম কেটে বলেছিল যে সেটা নতুন। কিন্তু বয়ি আর এরল আমাকে কিছুই দেয়নি। হ্যাট আমাকে এক কার্টন সিগারেট দিয়েছিল। সে বলেছিল, ‘আমি জানি তুই বলেছিস যে তুই আর সিগারেট খাবি না। কিন্তু এটা রাখ। যদি কখনো আবার তোর খেতে ইচ্ছে করে।’ আর এর ফলে আমি আবার সিগারেট খেতে শুরু করি।

যে ভ্যানে চড়ে পরদিন সকালে আমার বিমানবন্দরে যাবার কথা, ভাকু কাকা সারারাত ধরে সেটার পেছনে লেগেছিল। মাঝে মাঝে আমি তার কাছে গিয়ে এতো খাটাখাটুনি না করার অনুনয় করেছি। তার কাছে নাকি মনে হয়েছিল যে কার্বুরেটরটা তাকে বোকা বানাচ্ছে।
পরদিন খুব সকালে উঠে তিনি আবার ওটার পেছনে লাগলেন। আটটার মধ্যে আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও দশটা পর্যন্ত ভাকু কাকার মেকানিকগিরি চলতেই থাকলো। আমার মা আতঙ্কিত হয়ে পরেছিল আর মিসেস ভাকু অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন। গাড়ির নিচে চিৎ হয়ে শুয়ে ভাকু কাকা গুনগুন করে রামায়ণ থেকে কয়েক-ছত্র গাইছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে, হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমরা ভয় পাচ্ছিলে, তাই না?’

ততক্ষণে আমরা সবাই তৈরি ছিলাম। ভাকু কাকা ইঞ্জিনের কিছু ক্ষতি করলেও সেটা কাজ করছিলো। আমার ব্যাগগুলো সব গাড়িতে তোলা হয়ে গিয়েছিল। এবং শেষ বারের মতো আমি বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।

মা বললো, ‘দাঁড়া।’ তারপর দরজার মাঝখানে দুধ ভর্তি একটা পিতলের ঘটি রাখলো। আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারি না যে সেটা কীভাবে ঘটেছিল। একটা গাড়ি যাওয়ার জন্য দরজাটা যথেষ্ট চওড়া ছিল। কিন্তু পিতলের ঘটিটা চওড়ায় ছিল মাত্র চার ইঞ্চি। আমি ভেবেছিলাম যে দরজা পার হয়ে পিতলের ঘটি থেকে আমি অনেক দূরে চলে এসেছি। তারপরও কীভাবে যেন আমি ঘটিটাতে লাথি মারলাম।

আমার মা মুখ নামিয়ে নিলেন।

আমি বললাম, ‘এটা কি কোনো অশুভ লক্ষণ?’

মা কোনো উত্তর দেয়নি।

ভাকু জোরে জোরে গাড়ির হর্ন বাজাচ্ছিল।

আমরা উঠে বসা মাত্র ভাকু কাকা গাড়ি চালানো শুরু করলেন। মিগ্যেল স্ট্রিট পার হয়ে, রাইটসন রোড ধরে, সাউথ কুয়ে’র দিকে। আমি গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকাইনি।

মা কাঁদছিল। বলেছিল, ‘আমি জানি তোকে আর কখনো এই মিগ্যেল স্ট্রিটে দেখতে পাবো না।’

আমি বললাম, ‘কেন? ঘটির দুধ ফেলে দিয়েছি বলে?’

মা কোনো কথা না বলে পড়ে যাওয়া দুধের জন্য তখনো কাঁদছিল।
পোর্ট অব স্পেন আর শহুরে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পরই কেবল আমি বাইরে তাকিয়েছিলাম। দিনটি ছিল পরিষ্কার, কিন্তু গরম। পুরুষ আর মহিলারা ধানের ক্ষেতে কাজ করছিল। রাস্তার ধারের খোলা নলের জলে অনেকগুলো বাচ্চা গোসল করছিল।

আমরা ঠিক সময়ে পিয়ারকোতে পৌঁছেছিলাম। আর তখন আমার মনে হতে লাগলো যে স্কলারশিপটা না পেলেই ভালো হতো। বিমানবন্দরের লাউঞ্জ দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মোট মোটা আমেরিকানরা বারে বসে অদ্ভুত কিছু একটা পান করছিল।আমেরিকান মহিলাগুলোর চোখে ছিল দামি আর অহঙ্কারী রোদচশমা। কথা বলার সময় অহেতুক তাদের গলার স্বর চড়ে যাচ্ছিল। তাদের সবাইকে বেশ ধনী আর বেশ স্বাছন্দ দেখাচ্ছিল।

আর ঠিক তখনি স্প্যানিশ আর ইংরেজিতে খবরটা ঘোষণা হলো- ২০৬ নম্বর ফ্লাইট ৬ ঘণ্টা দেরীতে ছাড়বে।
মাকে বললাম, ‘চলো, আমরা পোর্ট অব স্পেনে ফিরে যাই।’

যদিও লাউঞ্জে বসা লোকগুলোর সাথে আমাকেও শীঘ্রই একত্র হতে হবে, আমি কিছুটা দেরী করতে চাচ্ছিলাম। আর ওদিকে মিগ্যেল স্ট্রিটে প্রথম যাকে দেখলাম সে হলো হ্যাট। একটা পেপার বগলদাবা করে অসংলগ্ন পায়ে সে ক্যাফে থেকে বের হয়ে আসছিল। আমি হাত তুলে ডাক দিলাম।

সে বলল, ‘আমি ভাবছিলাম যে তুই এতোক্ষণে আকাশে উড়ছিস।’

আমি হতাশ হয়েছিলাম। শুধু হ্যাটের শীতল অভ্যর্থনার জন্য নয়। ভালো কিছুর আশা নিয়ে আমি চলে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু এদিকে সবকিছু একেবারে ঠিক ঠিক চলছিল, আমার অনুপস্থিতির কোনো চিহ্ন কোথাও ছিল না। দরজার মাঝখানে তখনো পরে থাকা পিতলের ঘটির দিকে তাকি আমি মাকে বললাম, ‘এর মানে হলো যে আমি আর কখনো এখানে ফিরে আসতাম না, তাই তো?’

মা হসলো। তাকে খুশী মনে হলো।

এবার মা, ভাকু কাকা আর তার স্ত্রীর সাথে বাড়িতে বসে আমি শেষ বারের মতো দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর গরম রাস্তা ধরে পিয়ারকোতে ফিরে গেলাম যেখানে বিমানটা অপেক্ষা করছিল। শুল্ক অফিসের এক কর্তাকে চিনতে পারলাম। সে আমার ব্যাগপত্তর কিছু পরীক্ষা করলো না।তারপর ঘোষণাটি এলো, শীতল এবং সাধারণ ব্যাপার। মাকে জড়িয়ে ধরলাম। ভাকু কাকাকে বললাম, ‘আংকেল ভ্যাক, আগেই বলতে চাইনি, কিন্তু আমার মনে হয় আপনার গাড়ির পিপার ঢাকনাটা নড়বড় করছে।’ তার চোখ চিকচিক করে উঠলো।

সবাইকে বিদায় দিয়ে, পেছনে না তাকিয়ে আমার সামনে চলমান নিজের ছায়া যা টারমাকে এক নাচুনে বামনের মতো দেখাচ্ছিল সেটা দেখতে দেখতে আমি বিমানের দিকে দ্রুত পায়ে হেঁটে যেতে থাকলাম।

 

লেখক পরিচিতি : সম্প্রতি চলে গেলেন সাহিত্যে নোবেলজয়ী লেখক স্যার ভি এস নাইপল (১৯৩২-২০১৮)। ত্রিনিদাদে জন্মগ্রহণকারী ভারতীয় বংশোদ্ভুত এই লেখক ৩০টিরও বেশি বই লিখেছেন যার মধ্যে রয়েছে ‘ইন এ ফ্রি স্টেট’, ‘এ বেন্ড ইন দ্য রিভার’, ‘এ হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’। ১৯৭১ সালে তিনি ‘ইন এ ফ্রি স্টেট’ উপন্যাসের জন্য বুকার পুরস্কার লাভ করেন। সাহিত্যে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ২০০১ সালে। নাইপলের পিতামহ ভারত থেকে পাড়ি জমান ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে। তার বাবাও লেখক ও সাংবাদিক ছিলেন। নাইপল নানা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন আর বই লিখেছেন একের পর এক। যেগুলো পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছে। প্রকাশিত গল্পটি তাঁর ‘মিগ্যেল স্ট্রিট’ গল্পগ্রন্থ থেকে নেয়া। এটি তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ যেটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়