ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

একটি সম্ভাব্য গল্পের প্রাক ভাবনা || মাহবুব রেজা

মাহবুব রেজা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একটি সম্ভাব্য গল্পের প্রাক ভাবনা || মাহবুব রেজা

অফিস আওয়ারে নিসতার জামাল পারতপক্ষে কারো সাথে খুব একটা কথা-টথা বলেন না। কী লাভ অযথা কথা বলে! অফিসে এসেছো কাজ করতে, কাজ করো, মাস শেষে যে ক’টাকা পাও নিয়ে ফুটে পড়ো- ব্যস। অযথা এর সাথে, ওর সাথে খুচরা কথা বলে ফায়দা কী? নিসতার অফিসের অন্যদের মতো যেচে পড়ে কারুর সাথেই কথা বলে না কিংবা বলতে যায় না।

নিসতারের এ ব্যাপারটা অফিসের কেউ গায়ে মাখে। আবার কেউ মাখে না। তারা উল্টো ভাব দেখায়- ব্যাটা চাকরি করছ দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তার আর ভাব মারছ এডিশনাল সেক্রেটারির? হু কেয়ারস! নিসতার অবশ্য অফিস কলিগদের এই ব্যাপারটা বোঝে। টেরও পায়। কিন্তু সে তার তরিকা মতো চলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। এই যেমন আজ দুপুরের আগে সিনিয়র সহকারী সচিব মারুফ কামাল তাকে রুমে ডেকে নিয়ে ভদ্র ভাষায় সাইজ করেছেন-

: নিসতার সাহেব খবর কী? কেমন চলছে কাজকর্ম? অফিসের কলিগদের সঙ্গে একটু কষ্ট করে কথা বললে তো কোনো ক্ষতি দেখি না, আপনি কী বলেন?

স্যার বলি তো- নিসতার কম কথায় খাটো করে জবাব দেয়।

: না শুনলাম আপনি নাকি নিজেকে দশজনের থেকে আলাদা করে আই মিন ক্যামোফ্লেজ করে রাখেন?

: এটা ঠিক না, যারা আমার সম্পর্কে এসব বলছে তারা আসলে ব্যাপারটাকে অন্যদিকে...

: আপনি তো আমার সঙ্গেও ভালো করে কথা-টথা বলেন না। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করেন ব্যাপারটা বুঝতে পারেন?

: আপনি ব্যস্ত মানুষ। আর কাজ ছাড়া অযথা কেনো আপনাকে বিরক্ত করতে যাবো?

এবার সিনিয়র সহকারী সচিব মারুফ সাহেব বেশ সময় নিয়ে নিসতারকে দেখলেন। তারপর হো হো করে হেসে বললেন, আরে ! এভাবে তো কখনো চিন্তা করি নি ব্যাপারটা। তাই তো! কাজ ছাড়া আমার সঙ্গে আপনি কেনো খাজুইরা প্যাঁচাল পারবেন? বলে মারুফ সাহেব হাসিটা ধরে রাখলেন অনেকক্ষণ। তারপর শরীর বাঁকা করে মেরুদণ্ডের হাড় ফোটালেন। পটপট করে মেরুদণ্ডের হাড় ফোটার শব্দ হলো। তারপর তিনি নিসতারকে বললেন, বুঝেছি, আপনি খাজুইরা প্যাঁচালে নাই। অলওয়েজ ইন ওয়ার্ক তাই তো?

মারুফ কামালের কথায় নিসতার কোনো উত্তর করল না।  হ্যাঁ-ও না, না-ও না। মারুফ কামাল যা বোঝার বুঝে নিলেন। তিনিও আর কোনো কথা বললেন না।

দুপুরের পর সিনিয়র সহকারী সচিব মারুফ কামালের রুম থেকে বেরিয়ে উচ্চমান সহকারী গোলাম মোস্তফা পিয়ন রোকনকে এক হাত নিয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, অফিসে কাম-কাইজ কিছু করো না। খালি খাজুইরা প্যাচাল পারো? বুঝবা বুঝবা, যহন স্যারের হাতে ধরা পড়বা হেইকালে বুঝবা। পিয়ন রোকন গোবেচারা মানুষ। সে গোলাম মোস্তফার কথা কিছুই বুঝলো না। না বুঝে শুধু বোঝার ভান করে তাকিয়ে রইল।
নিসতার জামাল শুনল। বুঝল। হাসল। নিসতার একবার রোকনের দিকে তাকাল। একবার গোলাম মোস্তফার দিকে তাকাল। প্রতিদিনের মত আজও পাঁচটা বাজার দশ মিনিট আগে নিসতার অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। বেরিয়ে যাবার আগে তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল রুমানার। নতুন জয়েন করেছে। কম্পিউটার অপারেটর পদে।  নতুন জয়েন করলে সবার ভেতর যে রকম একটা সংশয়, টেনশন থাকে এ মেয়েটার ভেতর নিসতার সেরকম কিছু  খেয়াল করল না। প্রথম যেদিন রুমানা অফিসে এলো সেদিন সে সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলেছে। এ টেবিল থেকে ও টেবিল, ও টেবিল থেকে এ টেবিল করেছে। নিতারের কাছেও এসে একবার সালাম দিয়ে হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলেছে, ভাই ভালো আছেন ?

: জি।

তারপর রুমানা কোনো চিন্তা-ভাবনা না করে বোকার মতো একটা প্রশ্ন করে ফেলল, আপনার দেশের বাড়ি কোন জেলায়?

প্রশ্নটা করে রুমানা বুঝল এ প্রশ্নটা না করলেও চলত। প্রথম দিনে অফিসে এসে কার দেশ কোন জেলায়-এ জাতীয় প্রশ্ন কার্যবিধির মধ্যে পড়ে না। আরও একটু বুঝিয়ে বললে, বলতে গেলে এ জাতীয় প্রশ্ন করাটা দাপ্তরিক কার্যবিধির পরিপন্থি। রুমানা যে গায়ে পড়ে বেশি-বেশি কথা বলে এই প্রশ্নটা তার বড় প্রমাণ।

নিসতার রুমানার কথার ছোট একটা উত্তর দিল, বিক্রমপুর।

: ও বুঝেছি, মুন্সীগঞ্জ? আমার বাড়িও মুন্সীগঞ্জে।

রুমানার জবাবের প্রতিউত্তরে নিসতার অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, আপনার বাড়ি মুন্সীগঞ্জে আর আমার বিক্রমপুরে।

রুমানা এবার নিসতারের চেয়ে দ্বিগুণ বিস্ময়ে বলে ওঠল, ও আল্লা! মুন্সীগঞ্জ আর বিক্রমপুর তো একই জিনিস খালি নামের পার্থক্য।

রুমানার কথায় আর আগ্রহ না দেখিয়ে নিসতার বলল, বিক্রমপুর মুন্সীগঞ্জ দিয়ে তো কোনো কাজ হবে না। আমার হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে। প্লিজ, আমাকে কাজ করতে দিন।

প্রথমদিন অফিসে রুমানার বুঝতে বাকি রইলো না নিসতার জামিল নামের মানুষটা কম কথার চিড়িয়া। হ্যাঁ, চিড়িয়া শব্দটাই এ ধরনের মানুষের জন্য প্রাপ্য।
অফিস থেকে বেরিয়ে যাবার সময় নিসতারের সঙ্গে রুমানার মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। নিসতার বেরিয়ে যাবার আগে রুমানা নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে বলল, যাচ্ছেন বুঝি?

‘জি’ বলে নিসতার রুমানাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল।

রাস্তায় নেমে নিসতারের মনে হলো, রুমানা কী তার সঙ্গে খাজুইরা প্যঁচাল পাড়তে চায়? তা না হলে রুমানা কেনো অযথা নিসতারের সঙ্গে প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে গায়ের ওপর হামলে পড়ে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলার চেষ্টা করে? রুমানা আসলে কী বলতে চায়? কী তার উদ্দেশ্য?

অফিস থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে মতিঝিলে এসে নিসতার থামে। সামনে শাপলা চত্বর। চারদিকে রাস্তা। গাড়িঘোড়া। মানুষজন। হাউকাউ। চিল্লাচিল্লি। গালাগালি। ধাক্কাধাক্কি। ভীড় বাট্টা। চারদিকে মানুষজন। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে মানুষ। গাড়িঘোড়া। কে কার আগে যাবে সেই খেলায় যেন নেমেছে সবাই। নিসতার মাঝে মধ্যে ভিড় ঠেলে ফুটপাতের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়িয়ে একা একা চারদিকের সবকিছু দেখে। এতো মানুষ- এরা সব কোথায় যাচ্ছে? নিসতার নিজেও জানে না, সে কোথায় যাবে? আর এতো এতো মানুষ প্রতিদিন কোথায় যে যায়!
নিসতার সোনালী ব্যাংকের সামনের ফুটপাতে এসে দাঁড়ায়। হকারদের শোরগোল। হট্টগোল। অফিস ফেরতা মানুষজনের বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা। এসব দেখতে ভালই লাগে নিসতারের। সে যখন এসব দেখে তখন মনে হয়, আরে! আমি তো এসব মানুষের তুলনায় ভালোই আছি। কোনো তাড়াহুড়া নেই। হুড়াহুড়ি নেই। একভাবে দিন পার করলেই হয়। অফিস শেষ করে মতিঝিল এজিবি কলোনিতে টিউশনি করে রাত আটটা-নয়টায় মেসে ফিরে যাওয়া। মানিকনগর ঝিলপাড় মেস। লোডশেডিং হলে অন্ধকারের মধ্যে আমকাঠের চৌকিতে শুয়ে শুয়ে রাত গুজার করে দেয়া। রাতেরবেলা যদি মেসঘরে ঘুম না আসে তাহলে নিসতার বেরিয়ে পড়ে। বাইরে। বাইরেটা কোথায়? সে নিজেও জানে না। তবে ঘুম না আসার রাতগুলোতে সে রিকশা নিয়ে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ায়। নিসতারের এরকম কর্মকাণ্ডে বাবলা অবাক হয়। ভাবে, লোকটার মাথার স্ক্রু ঢিলা নাকি? মানিকনগরের তারা মিয়ার গ্যারেজ থেকে বাবলার রিকশা নিয়ে নিসতার প্রায়ই বেরিয়ে পড়ে। বাবলা রিকশা চালাতে চালাতে নিসতারকে জিজ্ঞেস করে, ভাই আপনে তো বহুত আজিব মানুষ! ঘণ্টায় পঞ্চাশ-ষাট টাকা দিয়া কী কেউ রাইতের বেলা ঢাকা শহর দ্যাহে?
বাবলার কথায় নিসতার জবাব দেয়া থেকে বিরত থাকে। খামাখা কথা বলে তার তো কোনো ফায়দা নেই। বাবলা রাতের বাতাসকে ভেঙেচুরে মাঝেমধ্যে যত না আগ্রহ নিয়ে কথা বলে, নিসতার তার চেয়ে বেশি আগ্রহ নিয়ে মৌন থাকে। মৌন থাকতেই যেন তার ভালো লাগে বেশি।

দুই.
নিসতার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মানুষজনের দ্রুত ছুটে যাওয়া দেখে। চোখের সামনে জনঅরণ্য। হাঁটতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে কখনো পুরুষ মহিলার গায়ের ওপর উঠে যাচ্ছে, আবার কখনোবা মহিলা পুরুষের ওপর। কেউ কিছু মনেও করছে না তাতে। ভাবটা এরকম এমন তো হতেই পারে।
নিসতার অফিস থেকে বেরিয়ে প্রায় দিনই মানুষজনের এই হুড়াহুড়ি, পাড়াপাড়ি দেখে। সোনালী ব্যাংকের মেইন গেটের সামনের ফুটপাতে হকারদের সারিবদ্ধ দোকান। গার্মেন্টস-এর শার্ট। প্যান্ট। বাচ্চাদের জামাকাপড়। শার্ট পিছ। প্যান্ট পিছ। ‘একদাম একরেট’ বলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জামাকাপড় বিক্রি করে হকাররা। শার্ট কিনতে গিয়ে নিসতারের সঙ্গে এরকম একজন হকারের পরিচয় হয়েছে। তার নাম বাদশা। বঙ্গবাজারে তার আরও দুটো দোকান রয়েছে। তারপরও বাদশা কেনো ফুটপাতের ওপর কার্টুন বিছিয়ে শার্ট-প্যান্ট পিছ বিক্রি করে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, বঙ্গবাজারের দুই দোকানে সারাদিনে যা বেচাবিক্রি হয় এইখানে তারও চেয়ে বিক্রি বেশি হয়।

নিসতার মাঝে মধ্যে সন্ধ্যার দিকে বাদশা মিয়ার দোকানের পাশে এসে দাঁড়ায়। বাদশা থাকলে পোলাপান দিয়ে চা আনতে পাঠিয়ে বলে, সচিবালয়ের বড় সাব আয়া পড়ছে তাড়াতাড়ি চা আন।
নিসতার অনেকবার বাদশা মিয়াকে নিষেধ করেছে। নিষেধ করলে বাদশা মিয়া আরও দ্বিগুণ আন্তরিকতা নিয়ে নিসতারকে বলে,  ভাই আপনেরা হইলেন জ্ঞানীগুণী মানুষ। আপনেগোরে সম্মান দেহাইবার পারলে আমগো কাছেও ভালো লাগে। আমরা রাস্তার মানুষ- বলে বাদশা মিয়া হাসে।

: বাদশা মিয়া তুমি ফুটপাতে দোকানদারী করে মাস শেষে যে টাকা কামাও তা দিয়ে আমার মতো দশজন কর্মকর্তা পালতে পারবে। কেনো খামোখা নিজেকে রাস্তার মানুষ বলো!
ছার যে কী কন!- বাদশা মিয়া কথা ঘোরায়, আপনেগো সম্মানের কাছে আমগো ট্যাকা পয়সা পায়ের ময়লা। জীবনে সম্মানটাই সব বুঝলেন। বলতে বলতে বাদশা মিয়া ভীড়ের মধ্যে তার কাস্টমার খোঁজার চেষ্টা করে। একজন মাঝবয়েসী মানুষ অনেকক্ষণ ধরে একটা চক্রা-বক্রা রঙের শার্ট হাতে নিয়ে দেখছিল। একবার শার্টের কলার দেখে। একবার শার্টের পকেট দেখে। একবার বোতাম দেখে। বাদশা মিয়া বলে উঠল, চাচা, শার্টটা কী পছন্দ অইছে?
মাঝবয়েসী লোকটা কথা না বলে শার্টটা রেখে হাঁটা শুরু করল। বাদশা মিয়ার কথার জবাবে নিসতারের আর বলা হলো না যে, মানুষের জীবনে সম্মানের চেয়ে টাকার দামটা অনেক বেশি। এই সমাজে টাকা থাকলে তাকে সম্মান দেখাও। টাকা না থাকলে ব্যাটার পশ্চাদদেশে কষে দশ কেজি ওজনের এক লাথি লাগাও। নিসতার প্রতিনিয়ত তার পশ্চাদদেশে সেই লাথি টের পায়। কথাটা বলা হলো না নিসতারের।

বাদশা মিয়ার ওখান থেকে নিসতার পা বাড়ায় মতিঝিল কলোনির দিকে। হাঁটতে হাঁটতে নিসতারের মনে হয় বাদশা মিয়া তো সবসময় তাকে চা খাওয়ায়- এটা কী ঠিক হচ্ছে? নিসতার বারকয়েক চায়ের জন্য টাকা দিতে চাইলে বাদশা মিয়া একছার না না করে ওঠে- আরে ভাই, আপনের অফিসে যহন যামু তহন আপনে বালতি ভইরা আমারে চা খাওয়াইয়েন। তহন আমি না করুম না। আপনে অহন আমার মেহমান। মাঝে মধ্যে বাদশা মিয়া নিসতারের জন্য সিগারেটও আনাতে চায়। নিসতার ধমক দিয়ে বারণ করেছে। এটা অন্যায়।
নিসতার ঠিক করে এরপর থেকে সে আর বাদশা মিয়ার দোকানে যাবে না। গেলেও চা খাবে না।
হাঁটতে হাঁটতে নিসতার মতিঝিল কলোনির গেট পর্যন্ত চলে আসে। তখন তার মোবাইল বেজে ওঠে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে নিসতার দেখল একটা অপরিচিত নাম্বার মোবাইলের স্ক্রীনে কাঁপন তুলেছে। কে এই সন্ধ্যাবেলায় তাকে ফোন করল? সাধারণত কেউ তাকে ফোন করে না। আর ফোন করবেই বা কোত্থেকে! নিসতার কাউকে তার নাম্বার দেয় না। দেশ থেকে কখনো কখনো মা, নইলে সাহেলা বেগম তাকে ভুল করে ফোন দেয়। তাও অনেক রাতে। দু’চার লাইন কথা হয়। তারপর দীর্ঘ বিরতি। এই ভর সন্ধ্যাবেলায় কার ফোন!
নিসতার কলোনির মেইন গেটে ঢুকতে গিয়েও থেমে যায়। সামনে বড় রাস্তা। ওপাশে নটরডেম কলেজ। বড় রাস্তার পাশে অঘোষিত বাসস্ট্যান্ড। লাইন ধরে বাস দাঁড়িয়ে আছে। নিসতার মোবাইল ধরে-

: হ্যালো, কে বলছেন ?

ওপাশ থেকে কোন উত্তর নেই। নীরবতা।

: হ্যালো, কথা বলছেন না কেনো ?

এবারও ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। তাহলে কেউ কী নিসতারের সঙ্গে রসিকতা করছে? করছে দুষ্টুমি?

লাইনটা কেটে গেল। নিসতার একবার ভাবল সে কলব্যাক করবে। আবার চিন্তা করল- কী দরকার কলব্যাক করে! যার দরকার সে-ই প্রয়োজনে তাকে আবার ফোন করবে।

তিন.
টিউশনি থেকে বেরিয়ে নিসতার একটা রিকশা নিল। রমনা পার্কে যাবে। পূর্ণিমা রাতে নিসতার রমনা পার্কের ভেতর হাঁটাহাঁটি করে। লেকের পাশে বসে থাকে। লেকের পানিতে চাঁদ এসে পড়ে। তারপর সেই চাঁদ নাচে। গান গায়। নিসতার বসে বসে চাঁদ দেখে। নাচ দেখে। গান শোনে। চা খায়। সিগারেট খায়।
মৎস্য ভবনের কাছে এসে রিকশা থামে। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে নিসতার পার্কে ঢোকে। পূর্ণিমার আলোর দেখা নেই। চারদিক অন্ধকার। নিসতার সিগারেট ধরিয়ে রাস্তা পার হয়ে রমনার গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকে। রাতের বেলার ফুল, গাছের পাতা আর বিকেলবেলার ঘাস কাটার গন্ধ সব মিলিয়ে একটা ককটেল গন্ধ তার নাকে এসে আছড়ে পড়ে। নিসতার বড় করে একটা টান মারে সিগারেটে। এক কাপ চা খেতে পারলে মন্দ হতো না। ফ্লাস্কভর্তি চা নিয়ে লোকজন ঘোরে। চায়ের সঙ্গে সিগারেটও থাকে। নিসতার ভালো করে চারদিকে একবার তাকায়। না, কোথাও নেই চা-অলা।
পার্কের একদম পশ্চিমে চলে গিয়ে লেকের পাশে একটা সিমেন্টের খালি বেঞ্চি পেল নিসতার। বসল। থোকা থোকা অন্ধকার চারপাশের জায়গাটাকে দখল করে রেখেছে। নিসতার শুনেছে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পার্কের ঘন অন্ধকারে শুরু হয়ে যায় অসামাজিক কার্যকলাপ। সন্ধ্যার পর থেকে পার্কে বাড়তে থাকে উটকো মানুষের পদচারণা। নিশিকন্যারা ঘুরে বেড়ায়। পোশাক আশাক দেখে বোঝার উপায় থাকে না তাদের। আজকাল নিশিকন্যাদের উৎকট রূপসজ্জা নিয়ে বেরুতে দেখা যায় না। মেকআপ গেটআপ-এ তারা বিস্তর পরিবর্তন এনেছে। সবই স্যাটেলাইটের কল্যাণে। নাটক টিভিতে আজকাল আর আগের মতো কড়া মেকআপ, গেটআপ-এ নিশিকন্যাদের দেখা যায় না। তাদেরকে এমনভাবে দেখায় যেন তারাও পাশের বাড়ির মেয়ে।
নিসতার লেকের পাকা বেঞ্চিতে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখে আর সিগারেট টানে। চাঁদের আলো দরিদ্র মানুষের সঞ্চিত অর্থের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে পার্কে। লেকে। নিসতারের শরীরে।
আবার মোবাইল বেজে ওঠে নিসতারের। বেঞ্চিতে শোয়া থেকে কোনরকম কসরত করে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে নিয়ে আসে মোবাইল। সন্ধ্যার পর যে অপরিচিত নাম্বারটা বেজে উঠেছিল এখন আবার সেই নাম্বার থেকে ফোন। একটানা বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল।
বেঞ্চির সামনে কিছুটা খোলা জায়গা। তারপর জমাট অন্ধকার। ঝোঁপঝাড়। ওপাশে বুক সমান উঁচু সারিবদ্ধ ফুলগাছ। বেঞ্চিতে শুয়ে শুয়ে নিসতার ভাবে কে তাকে ফোন করে? কথা না বলে রেখে দেয়? এর মানে কী! আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিসতারের মনে পড়ে সাহেলা বেগমের মুখ। আর তার মায়ের মুখ।

এই পার্কে শুয়ে শুয়ে নিসতারের কেনো সাহেলা বেগমের মুখ ভেসে উঠল? সে তো আরেকজনের বিয়ে করা বউ। স্বামী সাত-আট বছর ধরে বিদেশ-বিভূঁই। সাহেলা বেগমের কোলজুড়ে বাচ্চা-কাচ্চা নেই এই অজুহাতে তার স্বামী তাকে ফেলে রেখে তার অনুমতি ছাড়াই দ্বিতীয় বিয়ে করে বউ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে থাকে। সাহেলা বেগম নিসতারের মা’র দেখাশোনা করে। গ্রামে মা একা থাকেন। নিসতার শহরে চাকরি-বাকরি টিউশনি করে মা’র খরচ চালায়। মাসে দু’মাসে গ্রামে গিয়ে মাকে দেখে আসে। ছোট বোন আয়েশার বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে। আয়েশাও মাঝে মধ্যে এসে মাকে দেখে যায়। সাহেলা বেগমের ঘর নিসতারদের বাড়ি লাগোয়া। অনেক বছর হয়ে গেল নিসতারদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকছে সাহেলা বেগম। নিসতার যখন কলেজে পড়ে তখন সাহেলা বেগম আব্দুর রহিমের বউ হয়ে এ বাড়িতে এসেছে।  এসেই নিসতারের মায়ের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে আপনা-আপনি। দু’জনের সে কী ভাব! যেন অসম বয়সী দুই সখী। বিয়ে করার দুই বছরের মাথায় রহিম কোম্পানির কাজ নিয়ে সৌদি আরব চলে গেলে সাহেলা বেগম নিসতারের মা’র চিরস্থায়ী বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। আর সাহেলা বেগমও যেন কেমন ধরনের মেয়ে মানুষ! কোনকিছুতেই তার কিছু এসে যায় না। সে তার মতো চলাফেরা করে। নিসতারের মা যদি সাহেলা বেগমকে জিজ্ঞেস করে, আইচ্ছা, তর জামাই যে আরেকটা বিয়া কইরা বউ লয়া বিদেশ থাকে তুই কিছু কছ না ক্যা?
আমি কী কমু? বাচ্চা না হইলে আমার কী দোষ?- সাহেলা বেগম কিশোরী বালিকার মতো শব্দ করে হেসে ওঠে। হাসলে সাহেলা বেগমকে অদ্ভুত রকমের সুন্দর আর মায়াবতী দেখায়। তারপর সে নিসতারের মাকে বলে, আমার তো কোনো সমস্যা নাই। মাস শেষে জামাই টাকা পাঠায়। আমি খাই-দাই, ফূর্তি করি। আমি তো ভালোই আছি।
নিসতারের মা সাহেলা বেগমের কথা শুনে বেশ অবাক হন! তার চোখে বিস্ময়ে টান টান দাগ- খাই দাই ফূর্তি করি-এই কথার মানে কী?
এই যে আপনের লগে দিন ভইরা আড্ডা মারি, গুলতানি মারি হেইগুলাই তো আমার লাইগা ফূর্তি বুঝলেন না?- বলে সাহেলা বেগম হো হো করে হাসতে থাকে।
সাহেলা বেগমের হাসি দেখে নিসতারের মা’র বুকের ভেতর যেন কেমন করে ওঠে। মেয়েটা পাগল নাকি!
গ্রামে গেলে নিসতার খুব ভালো করে টের পায় তার পেছন পেছন একজন মানুষ তাকে চোখে চোখে রাখছে। নিসতারের যখন যা কিছু দরকার তার সবকিছুই কেউ একজন ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখে। ঘরে-বাইরে নিসতার সাহেলা বেগমের দীর্ঘ ছায়ার অস্তিত্ব টের পায়। গ্রাম থেকে শহরে চলে আসার সময় সাহেলা বেগম নিসতারকে সবসময় একটা কথা দরদ মাখানো গলায় বলবে, আপনে ঠিকঠাক মতো খাওন-দাওন কইরেন। আমাগো কথা ভাইবেন না। নিজের খেয়াল রাইখেন।

পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে থেকে নিসতার আবার টের পেল প্যান্টের পকেটে মোবাইল বেজে উঠেছে। কল না। ম্যাসেজ এসেছে। মোবাইল কোম্পানিগুলো দিনের মধ্যে চার-পাঁচটা ম্যাসেজ নিসতারকে ভালোবেসে পাঠায়। গ্রাহক সেবা বলে কথা। সে কার থেকে যেন শুনেছে মোবাইল কোম্পানির ম্যাসেজ এলে টাকা গুনতে হয়। এভাবে দিনের মধ্যে ম্যাসেজ রিসিভ বাবদ নিসতারকে কত টাকা গুনতে হয়? ধরা যাক প্রতি ম্যাসেজে এক টাকা ত্রিশ পয়সা হারে চার ম্যাসেজে পাঁচ টাকা বিশ পয়সা। তার কাছ থেকে সমঝোতামূলক ভাবে নিয়ে যায়। নিসতার ভাবে, আগামী মাসে ফোনের সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে ওদের হাত-পা ধরে মাফ চাইতে হবে এই বলে যে, ভাইরে তগো হাতে ধরি, পায়ে পড়ি, উপকারের লাইগ্যা আমারে আর ম্যাসেজ পাঠাইছ না।
বেঞ্চি থেকে উঠে বসে নিসতার। স্যান্ডেল স্যু-টা পরে পার্কে বেরিয়ে আসার জন্য হাঁটতে শুরু করে। সে মোবাইল বের করে দেখে। ওয়ান ম্যাসেজ রিসিভড। ম্যাসেজটা ওপেন করে দেখল অপরিচিত সেই নাম্বার থেকে এসেছে ম্যাসেজটা। অপসনে গিয়ে নিসতার ম্যাসেজটা পড়ল। একবার না কয়েকবার। নিসতারকে কে পাঠিয়েছে এই ম্যাসেজ? নিসতার ম্যাসেজটা পড়ে খুব অবাক হয়। সেখানে লেখা: ‘আপনার কী মনে হয় আপনে যা চিন্তা করেন সব ঠিক। ভুল, সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সব ভুল।’
ম্যাসেজ-এর নাম্বারে নিসতার ফোন করল। রিং টোনে কবিতার লাইন, কেউ কথা রাখে নি। ওপাশ থেকে কেউ একজন ফোন ধরল, হ্যালো, কে বলছেন আপনি?

: হ্যাঁ, এই নাম্বার থেকে আমি একটা ম্যাসেজ পেয়েছি। কে বলছেন প্লিজ !

কাল অফিসে আসুন। আমার ম্যাসেজের শানেনযুল আপনাকে বোঝাবো- বলেই ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে দিল।

নিসতার পরপর কয়েকবার রিং করল। মোবাইল বন্ধ- এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব নয়।

নিসতারের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে কিছু না বলে অন্ধকারের ভেতর হাঁটতে থাকল।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়