ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

‘কষ্ট পেয়েছ বাবা’

আসাদ আল মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৫, ৫ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘কষ্ট পেয়েছ বাবা’

||আসাদ আল মাহমুদ||

শিক্ষাজীবনে কয়েকজন ভালো শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। সব শিক্ষকের প্রতিই আমি শ্রদ্ধাশীল। এদের মধ্যে যে শিক্ষকের আদর্শ ও শিক্ষা  গভীরভাবে আমার মনে ছাপ ফেলেছে তিনি আবুল খায়ের। বরিশালের বানাড়ীপাড়া উপজেলার গাভা হাই স্কুলের গণিতের শিক্ষক।

স্যারের বাড়ি স্কুল থেকে ২.৫ কি.মি. দূরে কাচাবালিয়া গ্রামে। স্যার প্রতিদিন দীর্ঘ এই পথ হেঁটে স্কুলে আসতেন। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে নির্ধারিত সময়ের আগে নিয়মিত স্কুলে উপস্থিত হতেন। শুধু তাই নয়, স্কুল শুরুর ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা আগে তিনি স্কুলে আসতেন। ক্লাস শুরুর আগে যতটুকু সময় পেতেন তিনি পড়াতেন। আবার ক্লাস ছুটির পরেও পড়াতেন। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি ছুটির দিনে এসেও তিনি ছাত্রদের পড়াতেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড থেকে পরিদর্শকসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা এসে অন্য কোনো শিক্ষককে না পেলেও স্যারকে পেতেন। তার সার্ভিসবুকে কখনও লাল দাগ পড়েনি।

গণিতের শিক্ষকদের অনেকেই রাগী হন। কিন্তু আবুল খায়ের স্যার সে রকম ছিলেন না। তিনি সব সময়ই আন্তরিক। বলা যায়, অতুলনীয় একজন শিক্ষক। কেউ একবার না বুঝতে পারলে বারবার বুঝিয়ে দিতেন।  কখনও রাগ করতেন না। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ। ফলে তার সংস্পর্শে এসে ছাত্রছাত্রীরাও নীতিবান হতে উৎসাহী হতো। আদর্শ শিক্ষকের অন্যতম গুণ কঠিন কোনো বিষয় সহজভাবে ছাত্রদের বুঝানো। স্যার আমাদের খুব সহজভাবে গণিত বুঝিয়ে দিতেন। অথচ বিষয়টি অনেকের কাছেই ছিল ভয়ের। স্যার আমাদের উৎসাহ দিয়ে ভয় দূর করতে চেষ্টা করতেন। যে কারণে অন্য বিষয়ে ফেল করলেও স্যারের কোনো ছাত্র এসএসসি পরীক্ষায় গণিতে ফেল করেনি।

১৯৯৬ সালের কথা। স্যারের কাছে পড়ছি। স্যার বললেন, বীজ গণিত বইয়ের এত নাম্বার পৃষ্ঠা খুলে এত নাম্বার অঙ্কটা করো। স্যার অঙ্কের ফলও বলে দিলেন। আমরা অঙ্কটা করলাম। এবং অবাক হয়ে দেখলাম, ফলটা তাই হয়েছে। একদিন এক সহপাঠী স্যারকে প্রশ্ন করেছিল, স্যার আপনি কোন পেজে কোন অঙ্ক আছে মুখস্ত কীভাবে করলেন? জবাবে স্যার হেসে বলেছিলেন, ‘বাবা, আমি অঙ্ক মুখস্ত করিনি। তোমাদের দীর্ঘ ২৫ বছর একই বিষয় পড়াতে পড়াতে বইয়ের কোথায় কী আছে তা চোখ বুজে বলতে পারবো। আমি চিরদিন শিক্ষক থাকবো না। চাকরি থেকে একদিন অবসর নেব। দুনিয়া থেকেও বিদায় নেব। তোমরাও আমার মতো শিক্ষকতা করলে পড়াতে পড়াতে সব আয়ত্বে চলে আসবে। তোমরা আমার চেয়ে আরো সুন্দরভাবে পড়াতে পারবে। আমার চেয়ে অনেক বড় বড় পদে চাকরি করবে। সেই বছর অক্টোবর মাসে স্যার ঐকিক নিয়মের অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন। আমিসহ তিনজন গল্প করছিলাম। স্যার আমাদের দেখে দাঁড় করালেন এবং অঙ্কটি ব্লাকবোর্ডে এসে করতে বললেন। আমরা অঙ্কটি ভুল করায় লাঠি দিয়ে দুই হাতে চারবার মারলেন এবং কান ধরে ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। সময় শেষ হওয়ার পর তিনি সিটে গিয়ে বসতে বললেন। এই ঘটনায় আমার বেশ মন খারাপ হয়েছিল। স্যারের পড়ানো শেষ হলো। স্যার এবার আমাকে পুনরায় ডাকলেন। বললেন, ব্যথা পেয়েছ বাবা? আমি কোনো উত্তর দিতে পারছিলাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি দেখে পুনরায় জানতে চাইলেন, কষ্ট পেয়েছ বাবা? আমি তোমার বাবার মতো। আমি তোমার ভালোর জন্যই করেছি। আমায় ক্ষমা করো। এই বলে হাতে ১০ টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, বাড়ি যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে যাবে।

স্যার কখনও আমাদের তার কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য চাপ দেননি। গরিব ছাত্রদের কাছে স্যার টাকা নিতেন না। প্রাইভেট পড়ানোর টাকা কখনও চাইতেন না। যখন টাকা দিতাম তিনি খুলে না দেখে পকেটে রেখে দিতেন। দেখবেনই বা কেন? স্যার তো টাকার জন্য পড়াতেন না। আমি একবার প্রাইভেট পড়ানোর টাকা পুরোটা না দিয়ে অর্ধেক দিয়েছিলাম। স্যার গুণে দেখেননি। পকেটে রেখে দিয়েছেন। স্কুলের শিক্ষকসহ এলাকার মানুষ স্যারের কাছে টাকা আমানত রাখতো। যে যেভাবে টাকা রাখতো, সেভাবেই স্যার তাদের টাকা ফেরত দিতেন।

১৯৯৭ সালের ঘটনা। স্যার স্কুল থেকে তার বাড়ির পাশের স্কুলে বদলি হয়ে যাবেন। চলে যাওয়ায় খবর শুনে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকরা কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। স্যারকে কেউ যেতে দেবে না। যারা এই মতের পক্ষে তারা সবাইকে ডেকে সভা করে স্বাক্ষর সংগ্রহ করল। প্রায় ২১০০ জন  অভিবাবক, ছাত্রছাত্রী স্যারকে রাখার পক্ষে সেদিন সাক্ষর দিয়েছিল। এদের মধ্যে প্রাক্তন ছাত্ররাও ছিল। এরপর সাক্ষরসহ উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে আবেদন করা হলো। পরে শিক্ষা অফিসার, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান স্যারকে স্কুলে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি থেকে যান। স্যার  ধার্মিক ছিলেন। ছাত্রদের পড়ার ফাঁকে ধর্ম পালনের কথা বলতেন। অন্য ধর্মের ছাত্রদেরও তিনি উৎসাহ দিতেন। স্যার বলতেন, সষ্ট্রা একজন। তোমরা যে যেভাবে তাকে ডাকো, তিনি সাড়া দেবেন। তোমরা যার যার ধর্ম সঠিকভাবে পালন করবে। স্কুলে অনেক ছাত্র ছিল যারা বিভিন্ন শিক্ষককে নিয়ে কথা বলতো, কিন্তু কেউই আবুল খায়ের স্যারকে নিয়ে কিছু বলার সাহস পায়নি। স্যার সবার মন জয় করেছিলেন।

২০০৮ সালে স্যার অবসরে যান। বিদায় অনুষ্ঠানে স্থানীয় এমপি, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, গণ্যমান্যব্যক্তি, অভিভাবকসহ হাজার হাজার মানুষ চোখের জলে তাকে বিদায় জানান। সেদিন স্কুলের বিশাল মাঠ হয়ে উঠেছিল লোকারণ্য। এর পরের বছর স্যার মারা যান। স্যার রেখে গেছেন তার আদর্শ। স্যারের সেই আদর্শ এখনও মেনে চলছে তার অনেক ছাত্র।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়