ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দুটি অণুগল্প || কমলেশ রায়

কমলেশ রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০১, ২২ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুটি অণুগল্প || কমলেশ রায়

 

|| প্রতিক্রিয়া ||

মধ্যরাত। দীর্ঘ যানজট। ঢাকার মেগাসিটি হয়ে ওঠার যন্ত্রণা।

প্রখ্যাত চিকিৎসক চেম্বার থেকে ফিরছেন। ক্লান্তির চেয়ে বিরক্তি বেশি। গিন্নি একঘণ্টায় তিনবার ফোন করেছেন। ভালোবেসে নয়, কৈফিয়ত চেয়ে। শেষবার তো বলেই ফেললেন- এই বয়সে বাহানা ভালো লাগে না।

সময় কাটাতে মুঠোফোন বেশ কাজে আসে। ফেইসবুকে ঢুকলেন চিকিৎসক। স্ট্যাটাস দিলেন : ‘ইংরেজি ২৬টি অক্ষরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কোনটি জানেন? ডাব্লিউ। কেন জানেন? কারণ এ অক্ষরটি সবসময় টেনশন তৈরি করে। হোয়াট? হুইচ? হোয়াই? হোয়েন? হু? হুম? হোয়ার? ভেবেছেন শেষ? না, আরও আছে। ওমেন, বিশেষ করে ওয়াইফ।’

দিতে দেরি। শুরু হল লাইক আর কমেন্ট ঝড়।

দুই.

চিকিৎসকের বাসা। একমাত্র ছেলে পড়ছে। পাশে তার মাসি। পড়াশোনার তদারকিতে বসেছেন। তবে হাতে স্মার্টফোন। ফেসবুকে বরের সঙ্গে চ্যাট করছেন। হঠাৎ চোখে পড়ল ভগ্নিপতির স্ট্যাটাস।

এই দিদি দেখে যা তোর বর কী লিখেছে! নবপরিণীতা চিৎকার দিলেন।

দিদি হাতের কাজ ফেলে ছুটে এলেন। বললেন, কী হয়েছে? তোকে না বললাম, ওর পড়াটা একটু দেখিয়ে দে।

আরে, দিচ্ছি তো। তার আগে দ্যাখ তোর পতিদেবের কাণ্ড!

ফোন হাতে নিয়ে খুব মন দিয়ে স্ট্যাটাসটা পড়লেন চিকিৎসকের স্ত্রী। তার মুখ থেকে খসে পড়ল মাত্র দুটো শব্দ- আজ আসুক...।

কৌতূহলী ছেলে পড়া রেখে বলল, কী হয়েছে মা?

কিছু হয়নি। তুমি পড়ো।

ছেলে পড়তে শুরু করল। অ্যা পেঁপে অ্যা ডে, কিপ দ্য ডক্টর অ্যাওয়ে। প্রতিদিন পেঁপে খাও, ডাক্তারকে দূরে তাড়াও।

চিকিৎসকের স্ত্রী চলে যাচ্ছিলেন। ছেলের কথায় থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, আবার পড়ো তো।

কেন, ভুল হয়েছে মা?

না, পড়তে বলেছি পড়ো।

অ্যা পেঁপে অ্যা ডে, কিপ দ্য ডক্টর অ্যাওয়ে। প্রতিদিন পেঁপে খাও, ডাক্তারকে দূরে তাড়াও। ছেলে আবার পড়ল।

একটু ভাবলেন চিকিৎসকের স্ত্রী। তারপর চেঁচিয়ে ডাকলেন বাসার গৃহকর্মীকে। সে এলে বললেন, কাল বাজারে গিয়ে অবশ্যই পেঁপে আনবে। এখন থেকে এ বাসায় প্রতিদিন পেঁপে রান্না হবে। আমরা সবাই সেটা খাব।

কেন দিদি? এবার মুখ খুললেন গৃহকর্ত্রীর বোন।

কেন বুঝিসনি, প্রতিদিন পেঁপে খাও, ডাক্তারকে দূরে তাড়াও। ডাক্তার ভেবেছে কী ? যা ইচ্ছে তাই লিখবে!

বোন এ কথা শুনে করুণ গলায় বলল, তোরা সবাই খাস দিদি। আমি কিন্তু কিছুতেই খাব না। আমাকে জোর করিস না প্লিজ।

দিদি মুচকি হাসলেন। বেড়াতে আসা তার বোনটির বিয়ে হয়েছে মাস পাঁচেক আগে। স্বামীর সঙ্গে চট্টগ্রামে থাকে। ওর বরও ডাক্তার। আগামীকাল সে এখানে আসছে। আদরের বোন তাই পেঁপে খায় কী করে!

ঠিক আছে তোর খেতে হবে না। দিদি অভয় দিলেন।

এবার বোন হাসলেন। দিদিও হাসলেন। খিলখিল করে।

|| সুপ্ত শব্দ ||

আকাশে ঘন কালো মেঘ। চারপাশে আঁধার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা নামার আগেই রাত জেঁকে বসতে চাচ্ছে। ঝড় এলো বলে। পাহাড়ি এই এলাকায় ঘরবাড়িও বেশ ফাঁকায় ফাঁকায়। রাতে হিম ঠান্ডা পড়ে। সন্ন্যাসী মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। নিরাপদ একটা আশ্রয় খোঁজা দরকার।

বাঁকটা পার হতেই চোখে পড়ল একটা বাড়ি। সন্ন্যাসী দ্রুত পা চালালেন। বাড়িটা থেকে হালকা ঢালু হয়ে নেমে এসেছে রাস্তা। বাইরে থেকে বোঝা যায় না বাড়িটা এত সুন্দর। গোছানো, চমৎকার নকশার। তিনি দরজায় কড়া নাড়লেন। বাইরে ততক্ষণে ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করেছে। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা শুষ্ক মাটিতে পড়ছে সশব্দে।

দরজা খুললেন এক নারী। দীর্ঘাঙ্গী। বয়স মধ্যভাগ পেরিয়েছে। ধারালো চেহারা। চোখ দুটো গভীর, কাজলপরা। আগতের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার ভালো করে দেখে নিলেন নারী। তবে তিনি মুখে কোনো কথা বললেন না। চোখ নাচিয়ে মুখে এমন একটা ভাব ফুটিয়ে তুললেন যাতে স্পষ্ট বোঝা গেল প্রশ্নটা : কী চান ?

একটু আশ্রয়। এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাব মা। সন্ন্যাসী বললেন বটে, তবে একটা সন্দেহও তার ভেতরে কাজ করল। ভদ্রমহিলা বাংলা বোঝেন তো? দেখে তো অবাঙালিই মনে হচ্ছে।

কাম। দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘাঙ্গী নারী বললেন।

সন্ন্যাসী ভেতরে ঢুকলেন। তারপর কিছুটা আপন মনেই বললেন, ‘এই ভাব অনেক দিন আগেই মন থেকে চলে গেছে মা।’

জবাবে কিছুই বললেন না নারী। শুধু সন্ন্যাসীর মুখটা গভীর দৃষ্টিতে একবার দেখলেন তিনি।

দুই.

বিদ্যুৎ চলে গেছে। বৈদ্যুতিক লণ্ঠন জ্বলছে। সন্ন্যাসীর আহার পর্ব প্রায় শেষের দিকে। অন্নপূর্ণা নারী প্রতিটি পদ খুব যত্ন করে তুলে দিয়েছেন পাতে। তিনি নিজেও নিরামিষ খান। তাই সন্ন্যাসীর জন্য বাড়তি রান্নার প্রয়োজন হয়নি।

সন্ন্যাসীর হাত ধোয়া শেষ হলে একটি পরিষ্কার তোয়ালে এগিয়ে দিলেন গৃহকর্ত্রী। অতিথির হাত-মুখ মোছা শেষ হওয়ার পর তিনি খুব বিনীত ভাবে বললেন, একটা কথা বলার ছিল।

নির্দ্বিধায় বলো মা। সন্ন্যাসী আপ্লুত গলায় বললেন।

আমি খুব ভালো বাংলা জানি না, তবে ভালোই বুঝতে পারি। আপনিও নিশ্চয়ই ইংরেজি কিছুটা হলেও জানেন ও বোঝেন। ইংরেজিতে ‘কাম’ শব্দটার অর্থ আসুন বা এসো। আপনি তখন বলেছেন, কামভাব অনেক দিন আগেই আপনার মন থেকে চলে গেছে। হয়ত গেছে। কিন্তু মস্তিষ্কের ভেতরে রয়ে গেছে। আমার তো মনে হয় মস্তিষ্কের গভীরে কোথাও সুপ্ত অবস্থায় রয়ে গেছে শব্দটা। নইলে আপনার মুখ থেকে এমন কথা বের হতো না। আমি একজন নর্তকী। পুরুষদের খুব ভালো করেই চিনি। মুখে কিছু না বললেও শুধু চোখ-মুখ দেখে বলে দিতে পারি একজন পুরুষের মাথার মধ্যে কী ঘুরপাক খাচ্ছে। দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী গলায় কথাগুলো বললেন আশ্রয়দাত্রী।

এরপর সন্ন্যাসীর মাথা নিচু করে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। বাইরে প্রবল ঝড়বৃষ্টি। না হলে তিনি এখান থেকে দৌড়ে পালাতেন। লজ্জায় আর চোখ তুলতে পারলেন না তিনি। গ্লানিতে ভরা অবসন্ন গলায় সন্ন্যাসী বললেন, অসতর্ক এক মুহূর্তে মুখ থেকে শব্দটা বেরিয়ে গেছে মা। মাথার ভেতরের এই সুপ্ত শব্দটা বের করে দেওয়ার বাকি সাধনাটুকু আমি অবশ্যই করব। তুমি নিশ্চিত থাকো মা।

শিবু, সাধুবাবার শোবার ঘর তৈরি হলো? নারীটি গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যাঁ মা, তৈরি। বয়োবৃদ্ধ গৃহকর্মী শিবু লণ্ঠন হাতে কাশতে কাশতে এগিয়ে এলো।

যান, বিশ্রাম নিন। সন্ন্যাসীকে আন্তরিক গলায় বললেন ঋজু এক নারী।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়