ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অ্যাম্ফোরার সুগন্ধী গুঁড়ো

হামিম কামাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ১০ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অ্যাম্ফোরার সুগন্ধী গুঁড়ো

 

অসহনীয় দিন, পেরোনোর অতীত সব রাত

আমার তরুণ জীবনে অমন দিন আর কখনো আসেনি। যখনকার কথা বলছি তখন ভীষণ অসহনীয় দিন আর রাত আমি না-পারতে যাপন করে চলেছি। শুধু ভেবেছি একটা কোনো শুভ এসে আমার এমন জীবনাচারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে যাক। একটা কোনো দিব্যসত্তা এসে দেখা দিক। প্রকৃতি আমার প্রার্থনা শুনতে পেলেন। তিনি দূত পাঠালেন। এরপর এলো সেই দিন। যখন দিন সূর্যালোকে আলোকিত; সূর্যের অবসানে সেখানে প্রকৃতির নিয়মে রাত নামে। কিন্তু যে দিন মানুষের আলোয় উজ্জ্বল তার কোনো দিবাভাগ রাত্রিভাগ নাই। কারো কানে যত প্রগলভই শোনাক না এসব কথা, কিছুই করার নেই আমার। আমার অন্তর্গত সত্তা যে দায় বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, তার ভর আমার কাছে ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছে। লিখেই সে দায় আমাকে মোচন করতে হবে যতদূর। 

দৌড়া কাজল, দৌড়া!

অনবরত উসকে দিচ্ছে কেউ। ভি এস নাইপল তখন আমার কাছ থেকে মাত্র আড়াই মাইল দূরে। এবং তাঁর দিকে আমি দৌড়াচ্ছি। আমি হাঁপাচ্ছি, হোঁচট খাচ্ছি, দৌড়াচ্ছি। ভীষণ ক্লান্ত, ধস্ত, কিন্তু আমার মুখ আর গলার ওপর দিয়ে নেমে যাচ্ছে সড়কের সহাস্য আলোর রেখা। দৌড়া শালা! দৌড়ারে ক্ষ্যাপা! পাশার দান তোর চালা হয়ে গেছে। এখন আর দাঁড়ানোর উপায় নাই!
হাঁ, দারোয়ান দেখেছে আমি বেরিয়েছি। তার আগে ওপরে আমার উপপ্রধান সম্পাদক ত আড়চোখে দেখেছেন আমি বেরিয়েছি। আমি বেরিয়েছি এমন একটা সময়ে যখন প্রবল সবল বেগে, বন্যার তোড়ের মতো সারা দেশ থেকে অসংখ্য ঘটন-অঘটনের রিপোর্ট আসছে। তখন আমি একজন ডেস্ক এডিটর। আমার কাজ ছিল সেইসব রিপোর্ট গুরুত্ব অনুযায়ী বন্টন করে দ্রুত ছাপতে উদ্যোগ নেওয়া। তা না করে আমি কিনা পালিয়েছি। না, আমি নিচে ক্ষণিকের সিগারেট খেতে নামিনি। আমি আমার জট পাকিয়ে থাকা স্নায়ুতে তরল ঢালতে, হাওয়া খেলাতে বেরোইনি। আমি চট করে ফিরব বলে বেরোইনি। আমি কাউকে বলিওনি। কারণ বললে ওরা আমায় আসতে দেবে না। ওরা জানে না আমি কিসের মধ্য দিয়ে চলেছি। ওরা জানে না আমি কেন সব ছেড়ে মার্কেজের কথায় একদিন সাংবাদিকতায় এসেছিলাম এবং কেন তার কথামতোই একদিন এই সাংবাদিকতা ছেড়ে চলে যাব। ওরা জানে না আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য লিখে যাওয়া এবং আমার বিধেয়ও তাই- লিখে যাওয়া। ওরা জেনেও জানে না। সেক্ষেত্রে আমি কী করতে পারি? আমি এবং ভি এস নাইপল। মাঝে আড়াই মাইল পথ। বিধায় পালানো ছাড়া আমার কোনো গতি ছিল না।
হল্ট!
প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল পেছনে এই বুঝি এই কেউ ডেকে উঠবে। এই বুঝি কেউ পায়ের সামনে পা বাড়িয়ে দেবে আমার। কারণ আমি জানি, যখন কেউ তার লক্ষ্য জেনে দৌড়াচ্ছে তখন আরো অসংখ্য লোকের লক্ষ্যটা নির্দিষ্ট হয়ে যায়। আর তা হলো তার গতিরোধ করা। এ মুহূর্তে আমার গতিরোধক হয়ে দাঁড়াতে আমি কাউকে দেবো না!
থামো! আর এক পাও নয়!
আবারও কেউ একজন বলে উঠল। নারে বোকা, আজ আমায় তোমরা কেউ থামাতে পারবে না। আমি চলছি। আমি আজ সচল, আমার লক্ষ্য স্থির। তোমাদের লক্ষ্য দীর্ণ করে আমি ছুটে যাব। আমার দূত এসেছে। অনেক জরুরি বার্তা নিয়ে আমার দূত এসেছে হে। আমি তার দিকে ছুটে যাচ্ছি, ছুটে যাওয়া আমি উপভোগ করছি। আমার দিন রাত্রির হিসেব নেই, আমার গতির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই...

যে গল্পটা বলব বলে বেঁচে আছি
খানিকটা অপ্রসঙ্গে হাঁটি। তবে এই হাঁটাপথ ধরে আবার মূল সড়কে মিহিন পায়ে উঠে যাব, পাঠকের ভয় নেই।
আমার পড়াশোনার বিষয় ছিল প্রকৌশল। বিজ্ঞান ভালোবেসেছিলাম, প্রকৌশল নয়। কখনোই সচ্ছন্দ্য ছিলাম না তাই ওখানে। কিন্তু মধ্যবিত্তের ঠোঁটে আঙুল।
আমার সংবাদপত্র জীবনেরও আগেকার কথা। প্রকৌশলীর চাকরি করি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে সোনালি বিকেলের আলোয় ডুবে ছিল একুশে বইমেলা। প-এর মা এলেন; আমার দ্বিতীয় জন্মদায়িনী। বললেন, তোমাকে একটা বই কিনে দিতে চাই। আমি তো জানি না কোনটা পড়েছ, কোনটা পড়নি। তুমিই বরং বলো কোনটা চাও। লজ্জার কেবল মাথা নয়, গোটা দেহ আস্ত গিলে ফেলে আমি বলেছিলাম- যে গল্পটা বলব বলে বেঁচে আছি।
বই হাতে এলো। এরপর সেই সোনালি বিকেল পরবর্তী এক লাল সন্ধ্যা যে আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে কখনো ভাবিনি।
সেদিন, বিছানায় শরীর এলিয়ে আমি বইটার পাতা ওল্টাচ্ছি আর গলা ভেজাচ্ছি যেন সামান্য তৃষ্ণার কাছে হেরে গিয়ে আমাকে উঠতে না হয়। একবার উঠেছ তো মরেছ। যখন তুমি ঢাল বেয়ে নামছ, যখন বাতাসের গতিরেখা ধরে ছুটছ তার অনুকূলে, তখন কখনো সরে এসো না। কখনো না। আমি পাতা ওল্টাচ্ছি। আর মার্কেজের শব্দের বাক্যের জাদুময়তায় আবিষ্ট হয়ে যা নিচ্ছি তার নাম প্রাণ। হ্যাঁ- প্রাণ। মার্কেজ আইন পড়তে বেরিয়েছেন। মধ্যবিত্তের বড় সন্তান, মাংসাশী বাস্তবতার  সহজ শিকার। এবং বিরাট পরিবার। তার হাল ধরতে হবে। মনে বিকল্প কোনো ভাবনা তখনো আসেনি তাঁর। পৃথিবীতে আসা অগণিত অসংখ্য মানুষের মতোই আরো একজন মারকুইজ কালের স্রোতে ভেসে যাওয়ার পথে, হারিয়ে যাওয়ার পথে, তলিয়ে যাওয়ার পথেই যেন বেরিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ তাঁর হৃদয়ের ভেতর একটা কী যেন ঘটে গেল। আইন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রটি আর কোনোদিন আইনের দুয়ারে ফিরে গেল না। হয়ে গেল এক দিব্য আউট ল। বদলে গেল আরেক মহাদেশের আরেক সময়ের অপর এক তরুণের জীবন। আমার জীবন।
মার্কেজ বিড়বিড়িয়ে বলছিলেন, বাঁচলে লিখেই বাঁচব, মরলে লিখেই মরব। আমি চমকে উঠলাম। এ যে আমার উচ্চার্য! এ কথা তো আমার! কেবল শতদিকে তাকিয়ে, শতমুখের দুয়ো শোনার অনুচ্চার্য ভীতির পাথর সেই কথা চাপা দিয়ে রেখেছিল। সে পাথর সরিয়ে দেবো! হ্যাঁ, সরিয়ে দেবো। বাঁচলে লিখে বাঁচব। মরলে লিখে মরব।
নাইপলকে দেখতে না পেলে গোটা শহর জ্বালিয়ে দেবো
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ র, সাংবাদিকতা মার্কেজও ছাড়তে বলেছেন। তবে সময়ে। লেখকের জন্যে একটা বিশেষ সময়ে সাংবাদিকতা যেমন জরুরি, তেমনই আরেক বিশেষ সময়ে তাকে ছাড়াটাও জরুরি। নয়ত প্রাণঘাতী মার এড়ানো যাবে না। সেই এক কষাঘাত তোমার লেখক আত্মা ফালি ফালি করে ফেলবে। সাপের মতো ফুলে উঠবে দাগ তোমার সত্তার পৃষ্ঠের ওপর। হ্যাঁ, মার্কেজের কথা মানতেই আমাকে একবার চাকরি ছাড়তে হবে। কিন্তু ...
ইয়েস শ্রীমান হ, এইবার ঠিক জায়গায় থেমেছ তুমি। ঠিক পিছুটান। বিয়ে করেছ। হাল ধরার ব্যাপার আছে, ভবিষ্যত আছে। এবং এই কিন্তুর কাছে তোমাকে থামতেই হলো। জানো তো, বাংলাদেশে লেখকের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। বাংলাদেশের কোনো লেখকের বিশ্বের কোনো স্বীকৃতি নেই। বাংলা বিশ্ব রাজনৈতিকতায় কয় পয়সা মূল্য রাখে? নিজ দেশের মানুষই লেখা পড়ে না। ভয় পায়। এতো কিসের ভয়, এতো কিসের যে সংকোচ তা ওরা নিজেরাও ঠিকভাবে বলতে পারে না। পৃথিবীতে সময় বিনষ্টকারী সেরা জাতগুলোর একটা কিনা পড়তে গিয়ে সময়ের দোহাই দেয়। হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। পড়া ছাড়াই সবাই এতো জ্ঞানী! ওরা পড়বে না, ওরা লেখককে বাঁচাবে মনে করো তুমি? সেখানে বাইরের পৃথিবী তো অলীক স্বপ্ন। লেখককে বাঁচিয়ে রাখে যে পাঠক ওরা তোমার জন্য কোথাও নেই। জানি, তুমি কী বলবে আমাকে থামিয়ে দিয়ে। জানি হ। ওটা কি আমারও মনের কথা না যেটা তুমি বলে উঠতে চাচ্ছ হ্যাঁ? নয়ত টিকে আছি কী করে বলো? আমিও তো স্বপ্ন দেখি...
সাংবাদিকতা চলছে দুদ্দাড়। অবধারিতভাবে ক্ষয়েও যাচ্ছি। বাসায় ফিরে লিখতে বসে দেখি চিন্তার স্থিরতা নেই। পড়তে বসে দেখি লাইন একটা আরেকটার ওপর উঠে যাচ্ছে। পার্লিয়া তখন রাতের পর রাত আমার মনের চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছে। একদিন সাংবাদিকতার চাকরি আমার আপনা থেকেই বিদায় নিলো। প আমার হাত ধরে বলল, আমি তো আছি। কিন্তু মাতাপিতার কুসন্তানকে নিষ্ক্রান্ত হতে হলো বাড়ি থেকে। অনেক দিন আবার ফিরে গেছি। কিন্তু ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে। শত চাপ আর স্বপ্নভঙ্গের পরও আমার জীবনটা জীবনের রেলেই ছিল। চিরদিনের মতো তখন তা রেলচ্যুত হয়ে গেছে। একটা স্বাভাবিক সংসারজীবন, সংসারচিন্তা আমি চিরকালের জন্যে হারিয়েছি। আমি জ্বলন্ত শাপ, আমি মারী। আমি সব ভাঙচুর করতে থাকলাম! সব! কাচের গ্লাস থেকে চেয়ার! মেঝে থেকে মানুষের হৃদয়, সবখানে ক্ষত সৃষ্টি করলাম যেমন কৈশোরে একবার অপ্রকৃতস্থ হয়ে আমার শরীর খামচে বিক্ষত করেছিলাম। পৃথিবী! খবরদার বলছি, আমাকে খেপিয়ো না। আমি কক্ষচ্যুত হয়েছি। তোমাকেও কক্ষচ্যুত করব। আমার যদি আর পাওয়ার কিছু না থাকে তো জেনো, হারানোরও কিছু নেই!
‘তা তুমি নাইপল এসেছে শুনে সারাপথ দৌড়ে গেলে। আড়াই মাইলের মতো পথ, কম তো নয়। দৌড়ে কেন গেলে? নয়ত নাটকটা ঠিক জমে না, তাই তো?’
‘আরে ক্ষেপলা নাকি ভাই? ঢাকার রাস্তায় আরো বড় নাটক সারাক্ষণ মঞ্চায়িত হচ্ছে জানো না? সে নাটকের নাম যানজট। যানমহাজট। তোমার সময়, কাজ, আবেগকে ও দু’ পয়সার মূল্য দেয় না। তোমাকে দৌড়াতে হবে বন্ধু! নয়ত তুমি কোনোদিন কোথাও পৌঁছতে পারবে না। আড়াই মাইল পথ আমি সাধে দৌড়াই নাই। গোটা রাস্তা থম মেরে ছিল। তবে হ্যাঁ, ভেতর ভেতর দিয়ে পথ ভেঙে ভেঙে রিকশায় যাওয়া যেত, কিন্তু আমার কাছে টাকা ছিল না।
তা কি দেখলে সেখানে?
রোসো। আমাকে আরো খানিকটা কাব্য করে শুরু করতে দাও। আমি আসছি। তুমি যা জানতে চাও, তাতে আমি আসছি। এর আগে আমি কী পেরিয়ে গেছি, কী কী পেরিয়ে গেছি তা তোমাকে বলে যাই। আমি অগণিত, অসংখ্য চাকা, আলো, গর্জাতে থাকা-থরথরিয়ে কাঁপতে থাকা যন্ত্রদানব, নাভিশ্বাস ওঠা ঘর্মাক্ত মানুষ, শিশু, পথে গড়ানো ভিখারি, পাচক, আলো ঝলমলে হাসপাতাল, শপিং মল, সুখী দুঃখী আলো অন্ধকার- সমস্ত কিছু পাশ কাটিয়ে ছুটলাম। কখনো হেঁটে কখনো দৌড়ে। কোথাও  কোনো জড় জটলা পেরোতে দেরি হলে আরো জোরে দৌড়ে তা পুষিয়ে নিতে চেয়েছি। শহরের ভিড়ক্লান্ত মানুষ আর তৃষ্ণার্ত ট্রাফিক পুলিশের চোখের সন্দেহ, শিশুর মনে কৌতূহল, রূপসীর মনে প্রশ্ন জাগাতে জাগাতে আমি কখনো ফুটপাত ধরে কখনো রাস্তা তাতিয়ে ছুটে গেছি। কখনো রাস্তার এপার, কখনো ওপার। বাসের বাম্পার থেকে, সিডানের বনেট থেকে, রিকশার চাকা থেকে, মানুষের পদতল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়মিত বিরতির ল্যাম্পোস্ট আর সিগনাল বাতির সঙ্গে ঠোনা খেতে খেতে আমি পৌঁছলাম নীলক্ষেত। না, সেখানে নীল চাষের কোনো লক্ষণ আমি দেখিনি। সেখানে গাছে গাছে বিপ্লবীদের লাশ আমি দেখিনি। তবে হালের অনেক নিপীড়ন চিহ্ন দেখতে পেয়েছি। নিজেদের ভেতর বিদেশি নিপীড়কের ভূত আমি দেখতে পেয়েছি ওই সমস্ত চিহ্নে।
নীলক্ষেতের আলোর ঝিলিক, বইয়ের পসরা দেখার সময় আজ আমার নেই। নাইপলের কথা বলা বোধয় শেষও হয়ে এলো। তাহলে অফিস থেকে পালানো, পথের রণদুর্মদ পারদর্শিতা সব ভেস্তে যাবে।  সবচেয়ে যা বড়, যেদিকে তাকাতেও আমার ভয় করছে তা হলো আমার মন। আমার মন ভেঙে যাবে। মন হলো সেই বস্তু যা অক্ষত থাকলে সমস্ত ভাঙন জোড়া লাগানো যায়। আর যা ভাঙা থাকলে কোনো অ্যাডহেসিভ তা জোড়া লাগাতে পারে না আনটিল সে নিজেই জোড়া লাগে। আমি পূর্ব দিকে মোড় নিলাম। জহুরুল হক হলের সামনে এসে বাংলা একাডেমির কথা বলে রিকশা নিতে চাইলাম। টিএসসির দিকে মানুষ আর যানবাহনের জটলা দুর্ভেদ্য ছিল কি? পরপর বেশ ক’টি রিকশা যেতে অস্বীকার করল। একজন এমন ভাড়া হাঁকল যেন আমি তাকে আর বিরক্ত করতে না পারি। করিনি। রোখ চেপে যাওয়ায় হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করেছি। পরোয়া করি না। নাইপলকে কীভাবে দেখতে গেছি তা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাক। কিন্তু, দেখতে আদৌ পাবো তো? ঘড়ির দিকে তাকাতে পারছি না আমি। সাতটায় অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা ছিল আমার বেরোতে সাড়ে ছ’ টার মতো লেগে গেছে। এর ভেতর প্রায় দুই মাইল হেঁটেছি। না, আমি তাকাবো না ঘড়ির দিকে। আমি স্রেফ দপদপিয়ে পৌঁছে যাব বাংলা একাডেমির মিলনায়তনে এবং নাইপলকে দেখতে না পেলে গোটা শহর জ্বালিয়ে দেবো।

পরমাণু কমিশনের সামনে এসে আমার সমস্ত শক্তি আচমকা শেষ হয়ে গেল। কোনোক্রমেই নিজেকে আর টেনে নিতে পারছিলাম না। শরীর বা মন কোনোটার ওপরই কখনো জোর খাটানো চলে না। এর আগে যতবার জোর খাটিয়েছি, উল্টো ফল ফলেছে। কিন্তু বিশ্রামের কথা এখন মনে আনাও পাপ হবে। মনকে ভার দিলাম। ও মন, তুমি মরিয়া হয়ে শরীরকে বোঝাও। শরীরের প্রাণরসায়নে প্রভাবক হওয়ার মতো শক্তি তোমার মতো করে আর কার আছে? ও মন!
বাংলা একাডেমির কালো ফটকে যখন পৌঁছলাম তখন আমার চেহারার দিকে বোধয় আর তাকানো যাচ্ছে না। রং-চটা বিরাট ফটক আটকে রাখা ইউনিফর্মিত অফিসার খুবই সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে একবার ওপর-নিচ তাকিয়ে আমার পাস দেখতে চাইলো। দ্বিতীয়বার বাধার মুখে পড়লাম আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনের রুদ্ধ প্রবেশদ্বারের সামনে। গলায় পরিচয়পত্র ঝোলানো স্বেচ্ছাসেবক কিশোর কিশোরীরা আমাকে চিবুক উঁচিয়ে আটকে দিলো।
মনে মনে বললাম, ছেলেমেয়েরা, আমি উড়ে উড়ে এতোদূর এসেছি। আমাকে পথের দুর্ল্যঙ্ঘতা, শরীরের শ্রান্তি, পকেটের বায়বীয়তা, কর্মক্ষেত্রের দায়- কিছুই আটকে রাখতে পারেনি। আমি এতো মরিয়া। আমায় বাধা দিয়ে তোমরা আর কলঙ্ক কুড়াও কেন?
ইংরেজি বাংলার বিচিত্র মিশেলে ওরা বলছিল, ভেতরে একটা খড়ের কুটোরও দাঁড়ানোর মতো জায়গা নেই। এখন আর ঢোকা যাবে না। ক্ষমা করবেন, ক্ষমা করবেন। আগের দলের সঙ্গে একজন দুইজন তিনজন করে জড়ো হতে থাকল। সবার মুখে ক্ষমা করবেন। যেন উদ্ভট এক কথাচক্রের ফাঁদে ওরা পড়ে গেছে, বেরোতে পারছে না। এই বালক বালিকাকূল, আমি তোমাদের সাহায্য করতে চাই। আমি জানি তোমরা তোমাদের কর্তব্য করছ। দেখো আমার নীতিবোধের পরিধি ছোট হতে পারে। কিন্তু তার ভেতর তোমাদের কাজে সহায়তা করার বোধটুকু পড়েছে সুতরাং তোমাদের ভাবনা নেই। আমি তোমাদের ভাবনাবদলের নতুন বাঁক এঁকে দিচ্ছি। তোমরা ঘোরো। ঘুরে দাঁড়াও।
আমি এবার শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলাম যেটা আমি প্রয়োগ করতে একদম চাইনি। যারা এই অনুষ্ঠানের আয়োজক, আমার পত্রিকাটিও তাদেরই সুতরাং আমার সংবাদকর্মীর পরিচয়পত্রটি তাদের কয়েকটি দলে বিভক্ত করে দিলো। এবং এইবার আমার শাসন করাও সহজ হয়ে উঠল। এই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক ইতিহাসের শোষিতপক্ষের ব্রাত্য লিপিকাররা নিশ্চয়ই আমার কথায় করতালির আওয়াজ তুলবেন।
যখন ওদের পেরিয়ে যাচ্ছি, কেউ একজন শেষবারের মতো মনে করিয়ে দিলো, ভেতরে একটা খড়ের কুটোরও...
আমি বললাম, ‘আমি বাতাস হইয়া জড়াইব কেশ। আমার অসুবিধা নাই।’

অ্যাম্ফোরার সুগন্ধী গুঁড়ো
চা থেকে একটু গা তোলো হে কাজল কালো! আমার বয়াম শেষ হওয়ার জোগাড়। আর পাইপটাও ছাড়ো। গোটা ঘর নোংরা করে ফেললা।
জানালার পাশ দিয়ে যেতে যেতে অচেনা লোকটা কী ভাবছিল আমাকে কে জানে। একবার থেমে পর্দা উল্টে ভেতরে সে তাকাত যদি এটা নব্বইয়ের দশক হতো। লোকে এখন ব্যক্তিত্বের মূল্য দিতে শিখে গেছে। নাকি সবটাই ভান তাও বা কে জানে। এখন সে ভার্চুয়াল জগতে ‘স্টকিং’ করতে শিখে গেছে। পর্দা না ওল্টালেও তার চলে।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সুগন্ধী অ্যাম্ফোরার গুঁড়ো ঝাড়লাম। তারপর টেবিল থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে চললাম রান্নাঘরের দিকে। যেতে হলে মধ্যখানে আরো একটা শোবার আর খাওয়ার ঘর পেরোতে হয়। শোবার ঘরটা পেরোনো গেল ভালোয় ভালোয়। কিন্তু খাবার ঘরে পা রাখতেই দেখি বিরাট সেই হলঘরের উত্তরপ্রান্তে রহস্যময় হলুদ আলোর নিচে অবতারের মাহাত্ম্য নিয়ে কারা বসে আছে যেন আর ঘরময় অসংখ্য মানুষ।
হাহাহা, ভালো ছিল। হ্যাঁ,  এবার তাহলে বাকিটা শোনাও।
ঘরে অনেক মানুষ সন্দেহ নেই। তবে একটা খড়ের কুটোরও দাঁড়ানোর জায়গা নেই- এটা অতিরঞ্জন। আমার মতো ভারি শরীরের লোকও লোকশরীরের ফাঁকফোকর গলে দিব্বি দাঁড়িয়ে যেতে পারে। চাইকি দেয়ালেও হেলান দিতে পারে। পরের কথাটা বললাম এটা বোঝাতে যে, পরিস্থিতি যতটা বলছি ততটা সহনীয়ও আসলে নয়। কিন্তু আমার কোনোই সমস্যা হচ্ছিল না। আমি ঢাকাই লোকাল বাসের যাত্রী, হে মহোদয়। মানছি, ভদ্রস্থ যানবাহনের কোনো যাত্রীর জন্যে জায়গা সে হলঘরে আসলেই কম।
আমার চারপাশে সুপ্রচুর তরুণ-তরুণী। আজকাল তরুণরা খুব দাড়ি রাখছে। আমার মতো নাকের নিচটা দাগিয়ে রাখা এমন ষাটদশকীয় বর্তমানের জীবাশ্ম আর একটিও নেই। ঘরের আলো-আঁধারীতে তরুণীদের ভীষণ মায়াবিনী দেখাচ্ছিল। ঘরটা যতই মঞ্চের কাছাকাছি হয়েছে তত ক্রমশ নিচু হয়ে গেছে। মানে কিংবা বয়সে; বড়রা সামনের আসনগুলো দখল করেছে। নীলচে অন্ধকারে সভ্য মাথাগুলো সেখানে স্থির। কোনো নড়াচড়া নেই। তাদের সামনে আলোকিত মঞ্চ। মঞ্চে তিনজন মানুষ বসে আছে। একপাশের সৌভাগ্যবান তরুণটিই বোধয় সঞ্চালক। তার হাতের মুঠোয় একটা বেতার ক্ষুদে মাইক। অপর পাশে উজ্জ্বল কোনো রঙের ফতুয়া আর শতরঙা ফুল আঁকা ঘাগরা পরে বসে আছেন ভীষণ সপ্রতীভ এবং রূপসী এক ষাটোর্ধ্ব তরুণী। তিনি লেখকপত্নী নাদিরা নাইপল নিঃসন্দেহে। আর এ দুই জনের মধ্যখানে একটা চাকার চেয়ারে মাথা হ্যাট পরে অভিজাত ইংরেজ বুড়ো সেজে বসে আছে গালফোলা এক সুবোধ বালক। হ্যাঁ, এই বালকটিকেই দেখব বলে আমি এতো দূর দৌড়ে এসে এখনও অল্প অল্প হাঁপাচ্ছি। তিনিই সেই করাল দার্শনিক, শক্ত শব্দের শাক্ত বাক্যের জাদুকর, লেখক স্যার বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ ন্যায়পাল। সবার চেনা ভিএস নাইপল।
ওরে! কোথায় তার মুখে চোখে কপালে কপোলে সেই তাচ্ছিল্যের ভ্রুকুটি? কোথায় তার ঠোঁটে সেই চিরচেনা অবজ্ঞার হাসি, আলোকছবিতে যা দেখে আমার ঠোঁট শুকিয়ে যেত? এ হাসিটাই যেন আমার দিক থেকে তাকে ভালোবাসার সব রকম প্রস্তুতি থাকার পরও একটা আকাট প্রতিবন্ধক হয়ে পথ আগলে দাঁড়িয়ে ছিল, এগোতে দিচ্ছিল না। কোথায় এখন সেসব। কিছুই তো নেই। বরং দেখছি গালফোলা আত্মতুষ্ট এক বালক বসে আছে যাকে কবিতা আবৃত্তি করতে বললেই বুঝি লাজুক মুখে রাজি হয়ে যাবে। বয়স কি মানুষকে এতোখানি বদলে দিতে পারে? শেষ জীবনে এসে তিনি কিসের সন্ধান পেলেন?
ঘরময় নীল অন্ধকার। নাইপলের কণ্ঠ খানিকটা ভীত, খানিকটা আমোদিত। অনেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি মৃদু স্বরে বললেন, মনে নেই। একবার কি দু’বার যেন বললেন, আর সমস্ত অনুভবের বাইরে একটা অনুভবের কথাই তাঁর মনে আছে আর তা হচ্ছে উদ্বেগ। একটা প্রবল, সবল উদ্বেগ তাকে সারাক্ষণ পাশবদ্ধ করে রাখত, এটুকু তাঁর মনে আছে। বৃ্দ্ধের হাস্যগম্ভীর মুখশ্রী খানিকটা কেঁপে উঠে ভয় ছড়াল আর বেশ ক’বার যেন বললেন,  Anxiety! Anxiety!
কী নিয়ে উদ্বেগ? কী নিয়ে নয়? লেখক জীবন; সুতরাং অ্যাম্ফোরার সুগন্ধী গুঁড়োর বিপরীতে ফুসফুসে ক্ষয়রোগ বাসা বাঁধবে, এটাই নিয়মিত।
আহা, বিস্রস্ত, অধীর, শঙ্কিত লেখক জীবন। কত প্রতীজ্ঞা, সংগ্রাম, ঘুমহীন রাতের পর রাত, যুদ্ধংদেহী দিনের পর দিন- তাঁর মনে নেই, একেবারেই মনে নেই। শুনছিলাম আর বলছিলাম মনে মনে, হে প্রাজ্ঞ প্রকৃতি, হে মহানিয়ম, একদিন আমার অতীতও কি এইভাবে বিস্মৃত হবো? আমিও কি কেবলই হাতড়ে বেড়াব আবার তাবৎ কাজ আর প্রেমচাঞ্চল্যে মুখর সোনালি সব দিনের সুর তোলা ছড়ি? ঝাপসা আয়নায় রুমাল ঘষব বারবার, তবু কি স্পষ্ট হয়ে উঠবে না আর একজন বন্ধুর মুখও? এসব তৎক্ষণের দান কি কেবল ইথারের সম্পদ হয়ে থাকবে? মাইকেলসন ও মর্লি তো সেই ইথারকেও অলীক প্রমাণ করে ছাড়লেন।
নাইপলকে অনেক কথা হাসিমুখে মনে করিয়ে দিতে অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে গেলেন তাঁর ঝলমলে অথচ বিষণ্ন বধূ। তাঁর চেষ্টা কিন্তু একেবারে বিফলে যাচ্ছিল না। কখনও কখনও রীতিমতো সফল হয়ে উঠছিলেন। নাইপলের স্মৃতিসুড়ঙ্গের শেষপ্রান্তে একেকবার যেন আলোর দেখা মিলছিল। কিন্তু পরমুহূর্তে আবার অন্ধকার। স্মৃতির ওই সমস্ত অলিগলিপথ হয়ত বাকিটা সময় নিজেকে অনাবিষ্কৃত রেখে দিতে চায়। এর হয়ত কোনো জৈবনিক ব্যাখ্যা আছে। স্মৃতির ভেতর গ্লানির উপাদান থাকে। আর গ্লানির ভেতর থাকে হত্যাকারী বিষ। বিস্মৃতি হয়ত মানুষকে বাঁচাতে চায়।
আমি ততক্ষণে লোকসমাজ ঠেলে আরো খানিকটা সামনে যেতে পেরেছি। নাইপলের চোখজোড়া দেখতে পাওয়ার মতো কাছে, কিন্তু তাদের ভাষা পড়তে পারার মতো কাছে নয়। তবে আঁচ করতে পারার মতো ঘনিষ্ঠতা প্রকৃতি অনুমোদন করেছে। তাঁর মাথার ছোট বারান্দার ইংরেজ টুপিটাকে ধন্যবাদ, ধন্যবাদ একাডেমি মঞ্চের এই আলোকসজ্জা। নাইপলের চোখের ওপর ওরা ছায়া ফেলেনি।
আমি দেখলাম, হাসির ছোঁয়া লাগা কিন্তু কাঁদতে প্রস্তুত একজোড়া চোখ। আমাকে যেন বললেন, তুমি এসেছ? আমাকে তবে বের করে নিয়ে যাও। আচ্ছা রাতে ঢাকার ফুটপাতে কী কী আছে আনন্দ দেওয়ার মতো বলো তো? আমরা না পাশাপাশি একেবারে যৌবনের বন্ধুর মতো বসে থাকব। কেউ কাউকে কোনো প্রশ্ন করব না যেন সব জানি। এখানকার মতো কোনো প্রশ্ন শুনতে চাই না আমি আর। তুমি আমাকে বুঝতে পারছ? তুমি কি শুনতে পারছ আমার কথা? এই এরা বুঝতে চাইছে না। তুমি ভাবতে পারো একবার? আমি যা মনে করতে পারছি না তার দুর্বহ ভার কি ওরা বহন করে? ওরা কী জানে এই যন্ত্রণার? কিন্তু দেখো, প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন চাপিয়ে যাচ্ছে। মনের ওপর কী প্রচণ্ড চাপ ফেলছে আমার। ঈশ্বর! ও নিরীশ্বরের মতো ঈশ্বর, ওরা কি জানে না, বৃদ্ধ লেখক যখন তার সোনালি যৌবনের কথা মনে করতে পারে না তখন তার কেমন কষ্ট হয়? লেখক যখন তার প্রথম যৌবনের সেই লেখার টেবিলের ছবি মনে আঁকতে পারে না তখন তার কেমন লাগে এরা জানে না? মানুষের একমাত্র ধনের নাম স্মৃতি। স্মৃতি সমস্ত প্রাণির একমাত্র ঐশ্বর্যের নাম। এরা কি বোঝে না? বুঝলে আমার ঐশ্বর্যলুপ্তির কথাই কেন এরা বারবার, বারবার শুধু মনে করিয়ে দিতে চাইছে? তুমি আমাকে এই নির্দয় পরিবেশ থেকে বাইরে নিয়ে চলো কাজল! মহাভারতবর্ষের বঙ্গসন্তান, আমি তোমার কাছে মিনতি করছি।

বৃদ্ধের চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল। বলল, তোমাকে, তোমাকে আশীর্বাদ করব আমি। তোমাকে লেখার গোপন মধুর সন্ধান দেবো আমি হ্যাঁ! নিয়ে চলো, শুধু নিয়ে চলো আমাকে।
আমার দু’ কানের পাশ দিয়ে মেঘনার স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রশস্ত সময়েরা বয়ে চলেছিল।
ন্যায়পাল! ন্যায়পাল এসব কী বলছেন। সত্যিই যাবেন আপনি? বেশ। এক কাজ করুন তাহলে। ধীরে ধীরে পেছাতে শুরু করুন। আমি এক দিক ধরে এগোচ্ছি। মঞ্চের পেছনে চলে যাব। সিঁড়ির ওপর দিয়ে শরীরটাকে স্রেফ ছেড়ে দেবেন, অবশ্যই গাড়িসহ। বাকিটা আমি দেখছি। একটু চোট লাগতে পারে কিন্তু পরোয়া করলে চলবে না। আমি উঠলে বড় দেরি হয়ে যাবে পালাতে পারব না।
নাইপলের চোখে যেন মুহূর্তে হারানো দিনের প্রত্যয়ী আলো খেলে গেল। কিন্তু ওই একমুহূর্তই। পরক্ষণে একটা দ্বিধা, শঙ্কা, শেষমেশ পরাজয়ের ধূসরতা সেই প্রত্যয়ের আলো এমনভাবে ঢেকে দিলে যেন ওই আলো কখনো ছিল না। এবং প্রকৃতিকে ধন্যবাদ যে ঠিক সেই মুহূর্তে লেখকপত্মী তার দিকে তাকালেন। এবং এতোটা ক্ষণের যাতনামলিন অন্তর্বচন সমস্ত তিনি চোখের পলকে বুঝে নিলেন। কৈশোরের অনেকটা সময় ঢাকায় থাকা আজকের এই প্রৌঢ়া মঞ্চে অনেকটাই সায়ত্ত্বশাসকের মতো ক্ষমতা রাখেন। তিনি সঞ্চালককে চোখের ভাষায় অর্থপূর্ণ এক আভাস দিতেই সঞ্চালক বুঝতে পারলেন বটে, কিন্তু নিরুপায় চোখের ভাষায় তিনিও কিছু বললেন যেন।
সুতরাং আসর তখনই না ভেঙে ভাঙল আরো পরে। কিন্তু তারও বহু আগেই যে আমি যা জানার সব জেনে ফেলেছি! যা দেখার তা আমি দেখে নিয়েছি! চাইলে এবার বেরিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু বেরোলাম না। এমন আশ্চর্য সন্ধ্যা আর কোথায় পাব?
আসরের বাতি নিভে এলে বেরিয়ে এসে ভাবলাম- এটা স্বর্গপতন। স্রেফ স্বর্গপতন। আবার ক্লিষ্ট মর্ত্য কর্ষণাবেগ জড়ো করো, ঝাঁপিয়ে পড়ো। কিছু হলো? হামিম কামালের, অর্থাৎ কাজলের ডেস্ক ফাঁকা পড়ে আছে, নিশ্চয়ই এতোক্ষণে খবর হয়ে গেছে। একের চাপ অন্যকে নিতে গিয়ে মূল হারিয়ে সবাই নিশ্চয়ই ভীষণ ভাসমান। ভীষণ ছুটন্ত। কারণ হাওয়া তো বইছে বৈরি। ওই ছুটন্ত কণার ফুটন্ত কড়াইয়ের ভেতর এখন আমাকেও গিয়ে পড়তে হবে আবার, ভাবতেই মনটা কুঁকড়ে গেল। কিন্তু, আমি যে পালিয়ে এলাম তার প্রায়শ্চিত্তও তো আমাকে দু’কানে ঝাঁঝগরম শীসা ঢালতে দিয়ে করতেই হবে।
ভয় নেই কাজল। তুমি যা পেয়েছ, তার বিপরীতে মানের কতকটা কুড়ালে কেটে নিয়ে নিজেদের ভেতর বেঁটে নিলেও তোমার কিছুই ফুরোবে না। কিছুই এড়াবে না তুমি। ঠিক অফিসে যাবে।
রিকশা নিয়ে নীলক্ষেত এলাম। একটা বাসে চেপে বসতে আর বেশি সময় খরচ করতে হলো না। এরই ভেতর অফিস থেকে ফোনের পর ফোন আসতে শুরু করেছে। কয়েকবার এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু ক’বার আর এড়ানো যায়? দুরুদুরু বুকে ধরলাম অবশেষে। ওপারে তুন্দ্রাকঠিন শীতলতা। ঝড়টা সহজেই অনুমেয়।
অবশেষে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পরে যখন আবার সেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বার্তাকক্ষে প্রবেশ করলাম, দেখলাম আমার দিকে তাকানোর মূল্যটুকু দিতেও কেউ রাজি নয়। প্রায় নিঃশব্দে চেয়ার টেনে বসে পড়ার পর উপপ্রধান সম্পাদক করুণা করে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘কাজটা ভালো করোনি হামিম।’
আমি জানি, ঘরে গিয়ে গলা থেকে সংবাদকর্মীর পরিচয়পত্রটি খুলেই তিনি আরো একবার আমার আজ সন্ধ্যার বেয়াড়াপনার কথা মনে করবেন আর বলবেন, ‘হয়ত তুমি ঠিক কাজটাই করেছ।’
এরপর দয়িতার সঙ্গে আলাপ করতে করতে আমার প্রসঙ্গ তুলে হয়ত বলবেন, ‘নীলা বুঝলে, এই নাটকীয়তা ব্যাপারটা যাদের জীবনে এসে উপস্থিত হয়, তারা স্রেফ কুশীলব। তারা স্রেফ সেই নাটকের চরিত্র। কিন্তু নাটকীয়তা যারা ডেকে আনতে পারে তারা নাট্যকার।’
আমার কল্পনায় ত-কে তখন কথায় পেয়েছে।
‘নাট্যবিস্ময় সেলিম আল দীন আমার ব্যাপারে ভাবতেন, ছাত্রদের ভেতর যারা তাঁর স্থান নিতে  হয়ত পারবে একদিন, তাদের ভেতর আমিও একজন। একসময় আমি তাঁর ভীষণ প্রীতিভাজন ছিলাম, ভীষণ  আদর করতেন আমাকে। আমার বেয়াড়াপনা, ঔদ্ধত্য হাসিমুখে সয়েছেন। আমাকে কত স্বপ্ন দেখিয়েছেন, নিজেও দেখেছেন কত। এখন? সব স্মৃতি। ব্যথার স্মৃতি। এক মিনিট। না, ব্যথার না। আমি যা করেছি, জেনে বুঝেই করেছি। কোনো অনুতাপ নেই। সুতরাং এখানে ব্যথার কোনো স্থান নেই।
শ হয়ত প্রত্যুত্তরে তাকে বলবেন, ব্যথায় অভ্যস্ত মানুষ আর অভিযোগ  করে না। ব্যথাটাকেই তার নিয়তি বলে মেনে নেয়। একসময় সেটা অভ্যাসের ভেতর ঢুকে পড়ে। তখন ভুলেও যায় যে তার কোনো ব্যথার যোগান আছে। ক্ষয়সূত্র। বুঝলে না?
হয়ত তাদের ভেতর এমন আলাপ হয়ে থাকবে, হয়ত নয়। এ ঘটনার কিছুদিন পর যেদিন ভাবলাম, সংবাদপত্রের কাজে আর নয়, সেদিনই আমার আচরণে কিছু পরিবর্তন চলে এলো। এমন পরিবর্তন নিম্নবিত্ত পরিবারের বাবার হাতে হঠাৎ কিছু টাকা চলে এলে সাধারণত হয়ে থাকে। এরপর ঘটতে থাকল বিচিত্র এবং অম্লমধুর ঘটনাপুঞ্জ। যেদিন আমি স্বেচ্ছায় অব্যাহতিপত্র জমা দেবো ভাবছিলাম সেদিন ওরাই আমায় ছাড়িয়ে দিলো। ভেবেছিলাম দাপটে বেরিয়ে আসব, তা আর হলো না। ধানমণ্ডি হ্রদের ধারে সেই ‘রিজাইন লেটার’ হাতে বসে থেকে থেকে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমার মন খারাপ হচ্ছে। সেকি! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। আমার তো বরং আনন্দিত হওয়ার কথা ছিল।
বাসায় ফিরে অফিস থেকে জবাব পাওয়ার কথা প-কে বলতেই সে আমায় জড়িয়ে ধরল যেন এর চেয়ে আনন্দের খবর আর হতে পারে না। গাঢ় কণ্ঠে বলল, বেশ হয়েছে।

সেই বিকেলের পর থেকে আজ অবধি চলছে। ‘ভালোবাসিবারে’ যে অবসর পাওয়ার জন্যে কবি শুধিয়েছিলেন তা আমি পেয়েছি। কিন্তু এও জেনেছি, অবসর বড় ভয়ঙ্কর! আমি জেনেছি অবসরে অভ্যস্ত হতে পারার মস্ত এক পরীক্ষার ভেতর দিয়ে এর যাপনকারীকে যেতে হয়। এই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যে কত কঠিন হতে পারে তা একমাত্র সেই একাকী পরীক্ষার্থীই জানে। মৃত্যুমতি বিষণ্নতা জেঁকে ধরে। তাকে খসিয়ে দেওয়া যায় না, জোঁককে যেমন যায়। সেই বিষণ্নতাকে বরং যাপনের ভেতর দিয়ে পোষ মানাতে হয়। আমিও তাই করলাম।
নাইপলের স্ত্রী নাদিরা হাসি মুখে বলছিলেন, হয়ত আমি কাছের কারো মৃত্যুসংবাদ নিয়ে গেছি; নাইপল তখন লিখছে। সেই সংবাদ দেওয়ার পরও ও লেখা ছেড়ে ওঠেনি। নাদিরার চোখজোড়া যুগপৎ অহম আর বিস্ময়ে হাসছে।
আমি ভাবছিলাম, এতোই নিবিঢ় যে নিবেদন তার ঠাসবুনোটের চাপ হালকা করার পথ কি নাইপল কোথাও রাখেননি? রেখেছিলেন।
নাদিরা বললেন, ‘কিন্তু যখনই ওর বেড়াল লাফ দিয়ে ওর টেবিলের ওপর উঠে পড়ত...।’
যখনই এমন হতো, নাইপল থেমে যেতেন। তাঁর মুখে তখন হাসি ফুটে উঠেছে। এই তো সেই শ্বাস ফেলার পথ। হয়ত বেড়ালকে পোষ মানানোর ভেতর দিয়ে তিনি থমকে ওঠার মতো, হঠাৎ থেমে যাওয়ার মতো বিষণ্নতাকে ভালোবাসায় পোষ মানিয়েছিলেন। বেড়াল আর বিষণ্নতা হয়ত তাঁর কাছে সমার্থক ছিল। আমার কাছে মনে হয়, বিষণ্নতাকে যদি একটা প্রাণিতে রূপান্তরিত করা যেত, তো সে একটা খামখেয়ালি কিন্তু আদুরে বেড়াল হয়ে যেত।
এরপর দু’ বছর গড়াল। নাইপল একদিন কালঋষির বিভূতিতে পরিণত হলেন। যেমনটা হয়েছিলেন তার পূর্বসুরীগণ। বিষণ্নতায় আক্রান্ত মন হঠাৎ চমকে উঠে টের পেল, শোকের ঘরে আর কেউ যেন প্রবেশ করছে। অপর কোনো অনুভব এবং তার ভাবগতিক দুরধিগম্য। সেই অনুভব আমাকে বলিয়ে ছাড়ল, বড় বাঁচা বেঁচে গেছ!
‘কী করে?’
উত্তর মিলল তার কাছেই। সেই কথায় আসার আগে খানিকটা ভণিতা করা যাক। দিনের শুরুতে এবং শেষে ভণিতাই আমাদের রক্ষক আভরণ, রক্ষাকবচ। একে তুচ্ছ জ্ঞান করার উপায় নেই।
ভণিতা-
আমার কাছে মনে হয়েছে, ব্যক্তিগত অপরাধবোধ সবচেয়ে বড় শক্তি বিষণ্নতার। আর তার মৃত্যুদাতা হলো ক্ষমা। আমার বরাবরই মনে হয়েছে, মানুষকে ক্ষমা করার চেয়ে নিজেকে ক্ষমা করা কঠিন। তাই নিজে ক্ষমা পাওয়ার আগে আমি অপরকে ক্ষমা করা দিয়েই পথ শুরু করি। যেভাবে হিমালয় আরোহনের প্রথম ধাপ আগে আরোহীরা আইল্যান্ড পিক কিংবা অন্নপূর্ণার চূড়ায় ওঠে। তারও বহু আগে হয়ত এদেশে কেওকারাডং দিয়ে আরোহীর শুরুটা হয়। প্রকৃতি খেলাপ্রিয়। এবং তার সমস্তই ভীষণ খেলানির্ভর। একদিকে কোনো খেলা শুরু হলে ধীরে ধীরে সমস্ত দিক সেই খেলায় অংশ নিতে শুরু করে। আমি দেখেছি, যখনই বিষণ্নতাকে আমি পোষ মানানোর বেশ কাছে চলে আসি, তখনই আবার সেই বেড়ালটাকে বন্য করে তোলার মতো একটা কিছু ঘটে। এবং সেটা এতোই প্রাকৃত যে এড়ানোর কোনো উপায় নেই। মানুষকে এমন প্রায়ই বলতে শুনি, যখনই সব কিছু সে গুছিয়ে ওঠে, তখনই সব তছনছ হয়ে যায়। আসলে তার গুছিয়ে ওঠার ভেতরই কোথাও তছনছের বীজ লুকিয়ে থাকে। যেভাবে জন্মের শর্তেই লুকোনো থাকে মৃত্যু। এই মৃত্যুর চেয়ে অমোঘ প্রাকৃত কিছুর কথা আর মনে পড়ে না।
নাইপলের মৃত্যু সংবাদ আমাকে ভয়ানক বিষণ্ন করে তুলেছিল। কিন্তু সেই বিষণ্নতার শক্তিকে পরাভূত করার সবচেয়ে বড় যে অস্ত্র, ক্ষমা, তারও পর্যাপ্ত যোগান ছিল আমার সংগ্রহশালায়। কথাটা যেন ঠিক পঙ্‌ক্তিতে বসতে চায় না। তাই বলে
অপাঙ্‌ক্তেয়ও নয়।
আমার গুরুদের সিংহভাগ আমাকে দেখা না দিয়ে তো বটেই, পৃথিবীর হাওয়ার আমার শ্বাস নেওয়ারও আগে অলখের পথে যাত্রা করেছেন। যারা করেননি তাদের সবার দেখা আমি পাইনি। যেমন আমার জন্মের সবচেয়ে বড় বাঁক বদলে যিনি মন্ত্রণাদাতা, সেই গাব্রিয়েল গার্সিয়ার দেখা আমি পাইনি। যখন তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনেছি বিহ্বল হয়ে পড়েছি। কিন্তু আমার ভেতর কোনো অপরাধবোধ জন্মেনি কারণ তেমন কোনো বোধের যোগ ঘটারও কোনো অবকাশ তাঁর সঙ্গে আমার ঘটেনি। যেটা ঘটেছিল নাইপলের সঙ্গে। সেই দিন আমার বন্য কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারিনি, নাইপলকে আমি সেই আসর থেকে বের করে নিতে পারিনি। হুইলচেয়ারের সঙ্গে কেউ তাকে বেঁধে না রাখলেও প্রত্যেকের মতো তিনিও জানতেন, কতটা শক্ত পাশে তিনি আবদ্ধ; সেই পাশের নাম জরা।
আমি তাকে সেদিন ভীষণভাবে অনুভব করেছি। আমি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়েছি। তিনি অতো দূর থেকে শত মানুষের ভেতর লড়াই করে দাঁড়িয়ে থাকা একটি শ্যামল তরুণকে দেখেছেন কিনা আদৌ, বলতে পারি না। কোনোদিন তা জানা যাবে না। কিন্তু সেদিন সেই শ্যামল তরুণটি যে করে হোক, সেই বৃদ্ধের কাছে এসেছিল। তার বাবা তাকে বলেছিল, যখন গভীর সংকটে পড়বে, তিন মাথাওয়ালা লোকের কাছে যাবে। নাইপল ছিলেন সেই কাজলের কাছে তিন মাথার লোক। এবং বড় প্রজ্ঞার নিদর্শন এটা যে, তাঁর সঙ্গে একটি বাক্য ব্যয় না করেও কথা বলা যায়। তাঁর পরিপাশের আবহ থেকে বোধি আহরণ করা চলে। তাঁর দিকে আড়াই মাইল এগোলে আড়াই হাজার মাইল পথ অতিক্রান্ত হয়। নেহাৎ দৈবাৎ এতো কাছে পেয়েও এমন মানুষের সান্নিধ্যে সেদিন যদি সব ছিঁড়ে কাজল ছুটে না যেত, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যেত। আজ তার মৃত্যুর খবরে তার প্রতিক্রিয়া কতখানি তীব্র হতো তা বলা যায় না। নিজেকে কখনও সে ক্ষমা করতে পারত না।
তার বদলে এখন এ নিয়ে দু’কথা লেখার স্থৈর্য সে অর্জন করেছে। অবসরে অভ্যস্ত হওয়ার পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছে তা বলাই যায়। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে নাইপলের করোটিতে কী ঘটেছিল তা কি বলা যায়? সেই অদ্ভুত অবিশ্বাস্য অথচ বিশ্বাস্য সময়ে আলঝেইমার্সে মৃত সমস্ত সুখস্মৃতির ছিন্ন টুকরাংশ কোনো অলখের আলোকপাতে ক্ষণিকের জন্যে কি ঝলসে উঠেছিল? কী এসে যায়।




 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ নভেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়