ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নজরুলের কবিতায় সৈনিকজীবনের প্রত্যক্ষতা

মোহাম্মদ আজম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৫, ২৭ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নজরুলের কবিতায় সৈনিকজীবনের প্রত্যক্ষতা

|| মোহাম্মদ আজম ||

 

নজরুলের সৈনিকজীবনের সাথে তাঁর সাহিত্যিকজীবনের এক প্রত্যক্ষ সম্পর্ক এই যে, কলকাতার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম রচনাগুচ্ছ এ সময়েই লেখা। এ সময়ের গল্প ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’ ইত্যাদিতে একজন সৈনিককে পরিষ্কার পড়া যায়। এ লেখক নিজে সৈনিক, সৈনিকতা তাঁর কাছে একদিকে উপভোগ্য কাজ, অন্যদিকে দেশ ও দশের বৃহত্তর কল্যাণের সাথে যুক্ত। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ব্যথার দান’-এর কোনো কোনো গল্প নতুন আবহ তৈরির সাফল্যে প্রশংসিত হয়েছিল। এ আবহ যুদ্ধের আবহ। ‘বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকা’র মাঘ ১৩২৯ সংখ্যায় ‘ব্যথার দান’-এর সমালোচনায় লেখা হয়েছিল: ‘... কোন কোন গল্পে যুদ্ধক্ষেত্রের যেরূপ উজ্জ্বল চিত্র অঙ্কিত হইয়াছে তাহা বাংলা সাহিত্যে যেমন নতুন, তেমনই সৌন্দর্যপূর্ণ...’।
সৈনিকজীবনের স্মৃতি তাজা থাকতে থাকতে লেখা আরো অনেক রচনায় আমরা এরূপ ‘উজ্জ্বল চিত্র’ পেয়েছি। এর শ্রেষ্ঠ নমুনা বোধ করি ‘কামাল পাশা’ কবিতা।

‘কামাল পাশা’ বাংলা সাহিত্যের এক অতুলনীয় নাট্যকাব্য। পুরোপুরি বাস্তবসম্মত আবহ তৈরি করে ছন্দ-সুর-শব্দের নিখুঁত লীলায় কবিতাটি এক স্মরণীয় নান্দনিক সৃষ্টি। নজরুল সমালোচকদের অনেকেই— যেমন রফিকুল ইসলাম এ কবিতার মোটামুটি নির্ভরযোগ্য ভাষ্য তৈরি করেছেন। আমরা এ মুহূর্তে কবিতাটি পড়তে চাই কেবল সৈনিকবৃত্তির সাথে নজরুলের একাত্মতার নিগূঢ় নমুনা হিসাবে।
কামাল পাশা নজরুলের কাছে সবসময়ের জন্য আদর্শ বীর। কামাল সেই নেতার সাক্ষাৎ মূর্তি, যার আগমন-প্রত্যাশায় নজরুল রচেছেন বহু আন্তরিক আকুতি। এ কবিতায়ও কামাল পাশার নেতৃত্বের সৌরভ প্রকটিত হয়েছে। কিন্তু প্রধান হয়ে উঠেছে লড়াকু বীর সৈনিকেরাই, যারা সত্য ও ন্যায়ের সমরে সর্বদাই নির্ভীক। এরা সৈনিকের ন্যায় সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, কর্তব্য পালনে অকুতোভয়। প্রতিপক্ষের অনৈতিক অবস্থান সম্পর্কেও সুনিশ্চিত:
        হিংসুটে ঐ জীবগুলো ভাই নাম ডুবালে সৈনিকের,
        তাই তারা আজ নেস্ত-নাবুদ, আমরা মোটেই হইনি জের!
            পরের মুলুক লুট করে খায় ডাকাত তারা ডাকাত!
        তাই তাদের তরে বরাদ্দ ভাই আঘাত শুধু আঘাত!

এ সৈন্যদলের ফূর্তি তাই শুধু যুদ্ধজয় নয়, আরো বড় কিছু। বন্দী মানুষকে আজাদ করা এবং অধীন দেশ স্বাধীন করার মতো বৃহৎ-মহৎ কারণের সঙ্গে তা যুক্ত। তাই তাদের উল্লাসের এই জোয়ার। মোটেই ব্যক্তিগত নয় এ উল্লাস, বরং অন্তর্গত আবেগের দিক থেকেই সামষ্টিক। ঠিক সৈন্যদলের মতোই সামষ্টিক। একই সাথে তারা বেদনার রক্তেও রঞ্জিত। তাদের কেউ কেউ আহত হয়েছে, কেউ নিহত। কিন্তু সৈনিক হিসাবে মৃত্যুও তাদের কাছে বীরত্ব বৈকি:
        সাচ্চা ছিল সৈন্য যারা শহীদ হল মরে।
        তোদের মতন পিঠ ফেরেনি প্রাণটা হাতে করে, —
            ওরা   শহীদ হল মরে! ...
        খুন দেখেছিস্ বীরের? হা দেখ্ টকটকে লাল কেমন গরম তাজা!
                            মুর্দারা সব যা যা!!

আবার এই মৃত সৈনিকদের জন্য শোক প্রকাশ করতে গিয়েই কবি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে একাকার করে নিয়েছেন সৈনিকজীবনের সাথে। সমষ্টির মধ্যেই আবিষ্কার করেছেন ব্যক্তি সৈনিককে। সামষ্টিকতা ক্ষুণ্ন না করেই। দুই দিক থেকে। এক. কবি বিলাপ করেছেন তাদের জন্য, যারা জীবনের শুরুতে, আমোদ-আহ্লাদের কোনো খায়েশ পুরা হওয়ার আগেই, হারিয়ে গেল জীবন থেকে। নারীসঙ্গবঞ্চনা সৈনিকজীবনের সাধারণ বাস্তবতা। ফলে বিবাহিত জীবন, স্ত্রীসঙ্গ আর সংসার তাদের পরম আকাঙ্ক্ষার ধন। সন্ধ্যাকালের আরেকটি সাধারণ বাস্তবতা হলো ‘অস্ত-রবির আশ্চর্য রঙের খেলা’। এ দুই সাধারণ বাস্তবতা ব্যবহার করে নজরুল সৈনিকের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা আর কল্পনাকে চিহ্নিত করেছেন কয়েকটি অসাধারণ চিত্রকল্পে। দুই. সৈনিকদের মৃত্যুতে ভদ্রলোকশ্রেণির প্রতিক্রিয়ার ধরনকে তীব্র ব্যঙ্গে আক্রমণ করেছেন, যেখানে সৈনিকের শ্রেণি-অবস্থান পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে:
        তাই যত আজ লিখনে-ওয়ালা তোদের মরণ ফুর্তি-সে জোর লেখে!
            এক লাইনে দশ হাজারের মৃত্যু-কথা! হাসি রকম দেখে!
        মরলে কুকুর ওদের, ওরা শহীদ-গাথার বই লেখে!
                        খবর বেরোয় দৈনিকে,
        আর একটি কথায় দুঃখ জানান, ‘জোর মরেছে দশটা হাজার সৈনিকে’!

‘কামাল পাশা’ কবিতায় যুদ্ধের কাব্যিক প্রকাশ প্রথম থেকেই পাঠক-সমালোচকের নজর কেড়েছে, প্রশংসিতও হয়েছে। ‘বিজলী’ পত্রিকার ৬ জানুয়ারি ১৯২২ সংখ্যায় ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার সমালোচনা প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে: ‘কবিতাটি যুদ্ধের ‘মার্চে’র ছন্দে গাঁথা। এরূপ কবিতা বোধহয় বাংলার কাব্যসাহিত্যে এই প্রথম’। এরকম শনাক্তির নজির বিস্তর পাওয়া যায়। কিন্তু কবিতাটিতে স্বয়ং সৈনিক হয়ে সৈনিকদলের সাথে লীন হয়ে যাবার যে বাস্তবতা, তা বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে বিশেষ চাউর হয় নাই। আমাদের বিবেচনায়, নজরুলের বহু রচনার তীব্রতা, অন্তরঙ্গতা আর কেজো ভঙ্গির আস্বাদনে সংবাদটি খুব জরুরি ভূমিকা রাখবে।
সমালোচকরা নজরুলের বিদ্রোহ ও বিপ্লবের মূল সুর এবং আকুতি ভালোভাবেই শনাক্ত করেছেন। দেখা যাচ্ছে, তাঁর বিদ্রোহ বহুমাত্রিক। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক দাবি সে বিদ্রোহের একাংশ মাত্র। খুব গভীরতর অর্থে ব্যক্তির মুক্তি এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক যে কোনো জড়তা থেকে একটা সচলতায় উত্তরণ সবসময়ই তাঁর বিদ্রোহের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল। আর বিপ্লব প্রসঙ্গে বলা যায়, বিধিবদ্ধ রাজনৈতিক কর্মসূচির বদলে তাঁর আকাঙ্ক্ষায় ছিল এক ব্যাপক জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিমূর্ত রূপরেখা, যাকে একাট্টা কোনো সূত্রে বেঁধে ফেলা মুশকিল। ফলে নজরুলের বিদ্রোহ ও বিপ্লব একটি নিত্য প্রক্রিয়া, যা চলমান থাকবে প্রস্তুত ব্যক্তিদের প্রাত্যহিক সক্রিয়তায়। এগুলো তাঁর কাছে ভাবগত উপাদানই বটে, কিন্তু কিছুতেই কর্মের বাস্তবতা থেকে আলাদা নয়। তাঁর অন্যতম প্রধান দুই প্রত্যয়— বিদ্রোহ ও বিপ্লবের— এহেন বিশিষ্টতার কারণেই সৈনিকতা তাঁর সাহিত্যকর্মের অন্তরাত্মার সাথে একাকার হয়ে মিশে গেছে।

এই মিশামিশিটা হয়েছে যেমন ব্যক্তির অংশগ্রহণের দিক থেকে, ঠিক তেমনি সামগ্রিক পরিস্থিতির রূপায়ণেও। এক্ষেত্রে সৈনিকতা আসলে একটি ছাড়পত্র। এই পরিচয় নির্দেশ করে একটি যুদ্ধপরিস্থিতি, যেখানে জীবন দেয়া-নেয়া বৈধ, পরিবর্তনের দাবি স্বাভাবিক, সামষ্টিকতা অবশ্যম্ভাবী, উচ্চকণ্ঠ জয়ধ্বনি আর উজ্জীবনী বাণীসকল পরিবেশের স্বাভাবিক দাবিতেই ন্যায্য। নজরুলের বহু গুরুত্বপূর্ণ কবিতা রূপ পেয়েছে এই ন্যায্যতার ভিত্তিতে।
‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যের ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ কবিতায় কবি দেবীর ‘দনুজ-দলনী’ রূপের পুনরাবির্ভাব কামনা করেছেন। পৌরাণিক বরাতের ব্যত্যয় না ঘটিয়ে বর্তমানের জরুরত অনুযায়ী নির্মিত হয়েছে এই রূপ। কবিতাটি শেষ হয়েছে ‘ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর/ সৃষ্টির নব পূর্ণিমা’— এই আকাঙ্ক্ষায়, যা নজরুলের সাহিত্যকর্মের পৌনঃপুনিক উচ্চারণ। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, নজরুল এই পুরা কবিতায় দেবীকে সাজিয়েছেন এক সৈনিকের বেশে। সর্বাংশে প্রস্তুত ও সর্বপ্রকারে তৎপর একজন সৈনিকই কেবল আজকের জন্য দরকারি কাজ হাসিল করতে পারে। তাই তাঁর প্রস্তাব:
        রক্তাম্বর পর মা এবার
            জ্বলে পুড়ে যাক শ্বেত বসন।
        দেখি ঐ করে সাজে মা কেমন
            বাজে তরবারি ঝনন-ঝন্।
কিংবা,                  মেখলা ছিঁড়িয়া চাবুক করো মা,
            সে চাবুক করো নভ-তড়িৎ,
        জালিমের বুক বেয়ে খুন ঝরে
            লালে-লাল হোক শ্বেত হরিৎ।
পরের কবিতা ‘আগমনী’ ও দেবীর আবাহন। এবার সম্পূর্ণ যুদ্ধপরিস্থিতিতে:
        হৈ     হৈ রব
        ঐ      ভৈরব
        হাঁকে,   লাখে লাখে
        ঝাঁকে    ঝাঁকে ঝাঁকে
        লাল     গৈরিক-গায় সৈনিক ধায় তালে তালে
        ওই      পালে পালে
                ধরা কাঁপে দাপে।

এ কবিতায় পূজামণ্ডপের বাদ্য যেন অতীতকালের সুরাসুরের যুদ্ধক্ষেত্রের রণবাদ্যে পরিণত হয়েছে। তাতে সৈন্যদলের বহুমাত্রিক রণমূর্তি পরিষ্কার পড়া যায়। তার মাঝেই আবির্ভূত হন রণরঙ্গিণী জগতমাতা— হয়ত সৈনিকবেশে, হয়ত সৈন্যদলের নেতা রূপে; কিংবা হয়ত তাঁর একার মহারণেই চিহ্নিত হয় নতুন জমানার নতুন সৈনিকতা।
‘কামাল পাশা’ কবিতার কথা আগেই বলেছি। এখানে আরো দুই কবিতার কথা তুললাম। ‘রণ-ভেরী’র নামও এসঙ্গেই উচ্চার্য। এসব কবিতা আকার পেয়েছে সার্বিকভাবে যুদ্ধের এবং বিশেষভাবে সৈনিকের রূপে ও কল্পে। অন্য অনেক কবিতায় আংশিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এসব রূপ ও চিত্রকল্প। ‘চিত্তনামা’ কাব্যের ‘ইন্দ্র-পতন’ কবিতা শুরু হয়েছে যুদ্ধসাজের বর্ণনায়:
        আকাশে আকাশে বাজিছে এ কোন ইন্দ্রের আগমনী?
        শুনি, অম্বুদ-কম্বু-নিনাদে ঘন বৃংহিত-ধ্বনি।
        বাজে চিক্কুর-হ্রেষা-হর্ষণ মেঘ-মন্দুরা-মাঝে,
        সাজিল প্রথম আষাঢ় আজিকে প্রলয়ঙ্কর সাজে।
এরপর পুরো কবিতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এ বিষয়ক নানা উপাদান। শুধু ‘ইন্দ্র-পতন’ কেন, ব্যক্তি-ভজনার যে কবিতাগুলো লিখেছেন নজরুল, তার বেশির ভাগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁর নজরে পড়েছেন তাঁদের সৈনিকসুলভ মনোভাব আর কাজের জন্য, কিংবা নজরুলের উপস্থাপনায় তাঁরা হয়ে উঠেছেন জীবন-বাজি-রাখা সৈনিক। খালেদ তাঁর কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ কেবল এ বৈশিষ্ট্যের মানুষ বলেই। তাঁর পুনর্নিমাণে খালেদ শুধু মুসলমানদের রণ-ইমাম থাকেন না, হয়ে ওঠেন মজলুম মানুষের সেনাপতি। ‘খালেদ’ ও ‘উমর ফারুক’— উভয় কবিতায় কবি মুক্তির পথ রূপে কামনা করেছেন সশস্ত্র সংগ্রাম।

তাঁর ইসলামি ঐতিহ্যপ্রধান কবিতায় দেখি ‘জুলফিকার’ আর ‘হায়দরি হাঁক’। ঠিক তেমনি হিন্দু ঐতিহ্যের কবিতায় পাই ‘ওঙ্কার ধ্বনি’। দুটোই যুদ্ধের হাঁক। নজরুলের কবিতায় ন্যায়ের যুদ্ধে প্রাণদানকারী শহীদের মর্যাদা অন্য যে কারো চেয়ে বেশি; দিলির বা অসম সাহসীও তাঁর কাছে পরম মর্যাদাবান। আর ভীরু ও কাপুরুষরা ঘৃণার পাত্র। ‘শাত-ইল-আরব’ কবিতায় দেখি, স্থানবিশেষকে নজরুল পড়ছেন বহু বীরত্বপূর্ণ জয়গাঁথার আশ্রয় হিসাবে। অন্য কোনো পরিচয় নয়, তাঁর কাছে ইরাক মূল্যবান হয়েছে ‘শহীদের দেশ’ হিসাবে। একই রকমের ব্যক্তিত্বখচিত পাঠ পাওয়া যায় তাঁর কোরবানি বিষয়ক কবিতাগুলোতে। ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যের বিখ্যাত ‘কোরবানি’ কবিতায় তিনি দেখতে চেয়েছেন ‘হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন’। এই শক্তি— তাঁর কাছে— নিজের জান কোরবান দিতে পারার প্রত্যয়। এ কারণেই অন্যত্র, ‘ভাঙার গান’ কাব্যে, কোরবানির ঈদের নামই তিনি দিয়েছেন ‘শহীদী-ঈদ’। 

‘সর্বহারা’ কাব্যে কয়েকটি কবিতা আছে যেগুলো সামষ্টিক সৈনিকতার জাগরণমন্ত্রে মুখর। এগুলো হল: ‘কৃষাণের গান’, ‘শ্রমিকের গান’, ‘ধীবরদের গান’ ও ‘ছাত্রদলের গান’। এর মধ্যে শেষের কবিতাটি নানা লক্ষণে নিটোল নজরুলীয় রচনা হয়ে উঠেছে। ছাত্র মানে তরুণ; আর তরুণ মানেই— নজরুলের কাছে— একগুচ্ছ সম্ভাবনা, অসম্ভবকে সম্ভব করার তুরীয় আশ্বাস। এ কবিতার আঁটসাঁট শরীরে পরিমিতির নৃত্যপর দোলায় সে সম্ভাবনা আর আশ্বাসের রূপায়ণ ঘটেছে। অন্য তিনটি কবিতার ক্ষেত্রে হয়ত এতটা বলা যাবে না। কৃষক, শ্রমিক আর ধীবরের প্রতিনিধিত্ব করার প্রশ্নে নজরুলের মধ্যবিত্তীয় সীমাবদ্ধতা তো ছিলই। কাব্যিক প্রকাশ হিসাবেও এগুলো সম্ভবত অতটা সফল নয়। তবু কবিতাগুলোর অন্তত তিন ধরনের গুরুত্ব আছে। এক. এগুলো নজরুলের প্রকল্পের বিস্তার নির্দেশ করে। তাঁর জনগণতান্ত্রিক প্রস্তাবে শ্রমজীবী-পেশাজীবী মানুষেরাও অন্তত অংশত অঙ্গীভূত ছিল। দুই. পেশাজীবীদের সামষ্টিকতার মধ্যে তিনি দেখতে চেয়েছেন সামষ্টিক সৈনিকতার উদ্বোধন। তিন. বিশেষ পেশার বাস্তবতা আর অন্তর্নিহিত কর্মগুণ অক্ষুণ্ন রেখেই তিনি তাঁর কথামালা সাজিয়েছেন। তিন কবিতা থেকে তিনটি ছোট অংশ উদ্ধৃত করা যাক:
        ও ভাই    আমরা শহীদ, মাঠের মক্কায় কোরবানি দিই জান্।
         আর      সেই খুনে যে ফলছে ফসল, হরছে তা শয়তান।
                                                                        [কৃষাণের গান]
        আমরা    হাতের সুখে গড়েছি ভাই,
                পায়ের সুখে ভাঙব চল।
                ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল।।
                     [শ্রমিকের গান]
        ঐ     চৌদ্দ লক্ষ দাঁড়-কাঁধে ভাই,
                মল্লভূমির মল্ল-বীর আয় রে,
        ঐ            আঁশ-বঁটিতে মাছ কাটি ভাই,
                কাটব অসুর এলে!
                      [ধীবরদের গান]

নজরুলের কবিতায় সামষ্টিকতার প্রতাপের মধ্যেও ব্যক্তি-সৈনিকটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। আমরা জানি, ‘আধুনিকতাবাদী’ অর্থে তো নয়ই, এমনকি রোমান্টিক কবিদের মতো করেও নজরুল ব্যক্তিগততাকে প্রশ্রয় দেননি। তা সত্ত্বেও সৈনিক হিসাবে ব্যক্তিকে এতটা পরিসর দেবার কারণ হয়ত এই যে, তিনি চেয়েছেন পৃথকভাবে প্রতিটি মানুষের ভেতরেই বেড়ে উঠবে একেকজন লড়াকু সৈনিক। এতে করে অবশ্য সামষ্টিক অগ্রযাত্রার কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। লক্ষ্য এক হওয়ায় প্রাণের ঔদার্যে তারা মিলবে সমষ্টির ঐকতানে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ নভেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়