ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একুশে গ্রন্থমেলা

ক্রমশ ধূসরতা

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২১, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ক্রমশ ধূসরতা


বইমেলা এমন এক স্মৃতির অংশ যা প্রতিবছর ফিরে এসে স্মৃতিতন্তুতে যোগ করে নতুন সিকোয়েন্স। আমার সেই স্মৃতিযাপন শুরু বহুকাল আগে যখন ফোকলা দাঁতে আমি বাধোবাধো কথা বলতে বলতে ছুটোছুটি করে বেড়াতাম। বাংলা একাডেমির পুকুরপাড় ঘেঁষে স্টল হতো, তার মাঝে যদি এক চিলতে অংশ ফাঁকা পেয়ে যেতাম, ছোট্ট একটা নুড়ি কুড়িয়ে ছুড়ে মারতাম। বেশিদূর যেত না, ওইটুকু শরীরে শক্তি আর কত থাকবে? মা আমাকে টেনে হিঁচড়ে পুকুরপাড় থেকে সরিয়ে আনত।
এরপরের আগ্রহটা থাকত ‘উন্মাদ’র স্টলে। আর বিস্ময় নিয়ে দেখতাম ইমদাদুল হক মিলনের ‘ভালোবাসার সুখ দুঃখ’ উপন্যাস কেনার জন্য মানুষের উপচে পড়া ভিড়। এগুলো আমার স্মৃতির অংশ বটে তবে পুরোটাই শোনা মায়ের মুখে। শুনতে শুনতে সব দৃশ্য আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। ঐ তো দেখতে পাচ্ছি- একটু বড় হয়েছি আর সেবা প্রকাশনীর ভিড়ের সামনে থেকে আমাকে নড়ানোই যাচ্ছে না, কিংবা আরেকটু যখন বয়স বাড়ল; জীবনের প্রথম প্রেমপত্র হয়ত লিখে ফেলেছি তখন হুমায়ূন আহমেদের নতুন বইয়ের জন্য হা-পিত্যেশ অপেক্ষা। সেই সময়ে একটা সুবিধা ছিল, এক প্রকাশনী অন্যদের বই রাখতে পারত। যাদের নিজস্ব বই কম থাকত তারা কেবল বিক্রেতা হিসেবেই বই বিক্রি করত। তাই হুমায়ূন আহমেদ কিংবা ইমদাদুল হক মিলনের বই প্রায় সকল স্টলে পাওয়া যেত। প্রকাশক ছিল কম। যত বয়স পার হলো, তত বাড়ল স্টলের সংখ্যা। হালকা ভিড়, লেখকদের আড্ডার, পাঠকদের কিচিরমিচিরকে ওভারট্রাম্প করে মেলার শ্বাসকষ্ট বিজয়ী হয়ে উঠল। কেমন একটা হাহাকার মেশানো আক্ষেপ নিয়ে উদ্যানের মেলায় গিয়ে অবারিত জায়গাকে মনে হলো বিষের মতো কিছু! কোথায় গেল একাডেমির ভেতরে সেই ভিড়মুখর মেলা?  অথচ খুব দ্রুত আমার মতো প্রায় সবাই আগের মেলাগুলোকে স্মৃতির সিকোয়েন্সে ফেলে দিল।
অনেক কিছু হয়ত বদলে গেছে, আবার কিছুই হয়ত বদলায়নি। খোলসটা হয়ত বদলেছে কেবল। তবে সবচেয়ে বড় বদলটা ঘটেছে বোধহয় আমার ক্ষেত্রে। বইমেলায় কেবল পাঠক হিসেবে যাবার অধিকার প্রায় এক যুগ শীতমর্মর এক সন্ধ্যায় হারিয়ে ফেলেছি। মন সেদিন বলেছিল- তুই লেখক হবি। কী এক আশ্চর্য শব্দ ছিল সেটা! লেখক! সন্ধ্যা থেকে রাত হলো। ‘ইউনিভার্সিটি’ লেখা রোল টানা একটা গণিত খাতায় জীবনের প্রথম গল্পটা লিখে শেষ করে উত্তেজনায় থরথর কম্পমান। কাকে দেখাই? এই ঐশ্বর্য কাকে দেখাই? মা তো বাসায় নেই, বাবা শহরের বাইরে। কোনো বন্ধুকে? ওরা বুঝবে তো? আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনি। একটা লেখার কোনো পাঠক না-পাওয়ার বেদনায় আমার নয়ন শিশির হয়ে উঠল।


জীবন যেমন সরল থাকল না, বইমেলার আনন্দও সরলতার ভেতরে আটকে থাকতে চাইল না। হুমায়ুন আজাদের ওপরে নারকীয় সেই হামলা দিয়ে শুরু। মাঝে কয়েকটা বছর শান্ত ছিল বেশ। বড় কোনো ঝড়ের আগে পরিস্থিতি বোধহয় ওমনই থাকে। সাহিত্য যখন ক্রমশ ধ্যানের হয়ে উঠছে, চোখে বেশ একটা ক্রিটিক ক্রিটিক দৃষ্টি জন্ম নিয়েছে, তখন বইমেলা থেকে ফেরার পর অভিজিৎ রায়কে হত্যার খবর জানতে পেরেছিলাম। এরপর আবার অনেক কিছুই বদলে গিয়েছিল। তবে সেটা যে কেবল খুব বাজে কিছুর শুরু সেদিনই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। প্রকাশক দীপন ভাইকেও নির্মমতায় মেরে ফেলা হলো, শুদ্ধস্বরের টুটুল ভাইকে দেশ ছাড়তে হলো, কবি তারেক রহিমও বাঁচলেন না সেই হামলা থেকে। শৈশোব-কৈশোরের নিরপরাধ বইমেলা এভাবে কেমন করে যেন রক্তাক্ত হয়ে উঠল!
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেঁটে বেড়ানোর সময় চোখ দীপন ভাইয়ের হাসিমুখ যেমন খুঁজে বেড়ায়, কোথাও শুদ্ধস্বরের স্টল দেখতে না-পেয়ে অক্ষম একটা আক্রোশ আমাকে বেদনার্ত করে। লেখালেখির জন্য যেন আর কাউকে প্রাণ দিতে না হয়, আগের হত্যাগুলোর বিচারকাজ যেন দ্রুত সম্পন্ন হয়। আরেকটি বইমেলা শুরুর আগে এই চাওয়াটি কি খুব বড় কিছু?


বইমেলায় কতশত বই বের হয় আমরা জানি। তবে সেই বইগুলোর অধিকাংশ যে মেলার পরপরই হারিয়ে যায়, তাও আমরা জানি। তাই বলে বই বের হওয়া থেমে নেই। শতাংশের হিসেবে বলতে পারব না, তবে এটা জানি, প্রচুর বই লেখকরা নিজের টাকা দিয়ে বের করেন। এমনও হয়, টাকা দেয় কিন্তু বই বের হয় না। তবে বই বের হওয়ার এই কালচারটা আমার ভালো লাগে না। নিজেকে প্রকাশ করার যে আনন্দ সেটা থেকে মানুষকে দূরে থাকতে বলার আমি কেউ নই। তারপরও এই লেখার সুযোগে নিজের মতামত দিয়ে রাখার একটা সুযোগ পাওয়া গেল। আমাদের এখানে বইয়ের প্রুফ রিডিং হয় (সব প্রকাশক করেন কিনা জানা নেই), কিন্তু সম্পাদনা সেই অর্থে হয় না। প্রকাশকরা লগ্নি করতে চান না। আবার লেখকদের সম্পাদনা নিয়ে বলতে গেলে খুব সম্ভবত তারা খেপে যাবেন। এই ব্যাপারটিও আমি মেলাতে পারি না। সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল মানুষেরা এইসব ব্যাপারে কেন যেন সবসময় একটু রেগেই থাকেন। থাক, আমার বেশি বুঝে কাজ নেই। আবার হাতেগোনা কয়েকজন লেখক বাদে রয়্যালিটি কেউ পান না। বই তো চলেই না, রয়্যালিটি দেব কীভাবে? কথাটা পুরো মিথ্যা নয়। অনেকাংশে বরং সত্য। কিন্তু ঐ প্রচারের দায়িত্ব কার? মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের লেখকদের যদি একজন এজেন্ট থাকত, যে প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তিসহ বইয়ের প্রচারের যাবতীয় কাজগুলো দেখত আর লেখক শুধুই লিখতে পারত। মনে হওয়াটা বুদবুদ তুলে হারিয়েই হয়ত যায়। এরকম কত কিছুই তো আমাদের মনে হয়।



 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়