ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বই ও বইমেলা নিয়ে কিছু বৈষয়িক কথাবার্তা

আহমাদ মোস্তফা কামাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বই ও বইমেলা নিয়ে কিছু বৈষয়িক কথাবার্তা

একসময় সারাবছর অপেক্ষা করে থাকতাম ফেব্রুয়ারির বইমেলার জন্য। প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন মেলায় যেতাম কোনো কারণ ছাড়াই। এই পরিত্রাণহীন যন্ত্রণার শহরে কেবল ফেব্রুয়ারিতেই যেন সুবাতাসই বয়ে চলতো সারাক্ষণ। অন্তত বিকেলে অফিস থেকে ফিরে কোথায় যাব- বেড়াতে বা নিঃশ্বাস ফেলতে বা মন উজার করে আড্ডা দিতে- বইমেলা চলার সময় কথাটি চিন্তাই করতে হতো না। একটানা কুড়ি বছর ধরে এভাবেই মেলার দিনগুলো কেটেছে আমার। এখন আর ততটা যাওয়া হয় না। গত বছর সাকুল্যে ৪/৫ দিন মেলায় গিয়েছি। এক সময় নিতান্তই পাঠক হিসেবে যেতাম, দূর থেকে বিস্ময়ের চোখে লেখকদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, তাঁদের মনে হতো দূরতম গ্রহের বাসিন্দা। তাঁরাও যে রক্তমাংসের মানুষ, এই গ্রহেই বাস করেন, যে-কোনো মানুষের মতো তাঁদেরও সুখ-দঃখ, আনন্দ-বেদনা আছে সেটা কল্পনায়ও আসতো না। এখনো হয়তো ব্যাপারটা একইরকম আছে, নিজের পাঠকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের বিস্ময়মিশ্রিত কৌতূহল দেখে তেমনটিই মনে হয়! এই এক মেলা, যেখানে এমন সব মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, সারাবছরেও যাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকে না। সাধে কি আর একে মিলনমেলা বলি আমরা!
এই এতদিন ধরে- প্রায় তিরিশ বছর তো হলোই- লেখালেখি, প্রকাশনা, বই, বইমেলা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছি বলে আমাদের প্রকাশনা শিল্প আর বইমেলার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের নানারকম পরিবর্তনের প্রত্যক্ষদর্শী হবার সুযোগও ঘটেছে এই সময়ে। যেমন-

১. একসময়ের বারোয়ারি মেলা এখন পুরোপুরি বইমেলার চরিত্র ধারণ করেছে। এখন যারা মেলায় আসেন, বইকে কেন্দ্র করেই আসেন। কেনার সামর্থ্য থাকুক বা না থাকুক। অবশ্য এখন পাঠক-ক্রেতার চেয়ে দর্শক-ভ্রমণপিপাসুদের সংখ্যা বেড়েছে অনেক, এ-কথাও না বললেই নয়। বিশেষ দিনগুলোতে- পয়লা ফাল্গুন, ভ্যালেন্টাইনস ডে, একুশে ফেব্রুয়ারি- কেউ আর বই দেখতে বা কিনতে আসেন না, স্রেফ বেড়াতে আসেন। একসময় মেলা থেকে ফিরতি পথে যত মানুষের হাতে বই দেখা যেত, এখন আর তত দেখা যায় না। তারপরও দেখা যায়, আগের তুলনায় এখন বই বিক্রির সংখ্যা বেড়েছে। এর কারণ হয়তো এই যে, আগে মেলা ছিল ছিমছাম-পরিপাটি, খুব বেশি মানুষ আসতো না। এখন এটা উৎসবের অংশ হয়ে গেছে। কয়েকগুণ বেশি মানুষ আসেন, তাদের কেউ কেউ বইও কেনেন।

২. মেলার আকার-আয়তন ও পরিধি বেড়েছে। বাংলা একাডেমির সংকীর্ণ প্রাঙ্গন ছেড়ে সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে উঠে এসেছে মেলা; কয়েক বছর আগেই। যদিও মেলার ডিজাইন এখনো পাঠক-বান্ধব হয়ে ওঠেনি। শিশুদের জন্য নির্ধারিত কর্নারটি বেশ ছোট এবং ঘিঞ্জি, আড্ডা দেবার জন্য আলাদা কোনো জায়গা নেই, ধূমপায়ীদের জন্য আলাদা কোনো স্মোকিং কর্নার নেই। ছোট স্টলগুলো প্রায় চোখের আড়ালে পড়ে থাকে, খাবারের দোকানগুলো থাকে বহুদূরে। এসব নিয়ে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলে আসছি অনেকদিন ধরে। এগুলো গত বছরের দেখা থেকে বলছি। এ বছর কেমন হবে জানি না।

৩. বই প্রকাশের সংখ্যা এবং বিক্রির পরিমাণও বিপুলভাবে বেড়েছে। বেড়েছে লেখক, প্রকাশক, পাঠকের সংখ্যাও। এটা ঠিক যে, এখনো বই প্রকাশনার বিষয়টি পুরোপুরি পেশাদারি রূপ পায়নি। অনেক প্রকাশকই নিছক শৌখিন প্রকাশক, অনেক লেখকও তাই। এটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। সব আমলে সব দেশেই এরকম শৌখিন মানুষ থাকে। তবে শৌখিনতা কখনো স্থায়ী হয় না, ওটা সময়েই ঝরে যায়। বহু শৌখিন লেখক-প্রকাশককে ঝরে যেতে দেখেছি আমি নিজেই।

৪. পাঠক যে বেড়েছে সেটা বই বিক্রির একটা তুলনামূলক বিচার করলেই বোঝা যায়। এটাও অস্বাভাবিক নয়। দেশে শিক্ষার হার যতো বাড়বে, পাঠকও ততো বাড়বে। তবে স্বীকার করতেই হবে যে, এখনো দর্শনার্থীর তুলনায় পাঠকের সংখ্যা কম। অর্থাৎ পাঠকসংখ্যা যতটা বাড়ার কথা ছিল ততটা বাড়েনি। বলাবাহুল্য, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত বেশিরভাগ মানুষ বই পড়েন না, পড়লে পাঠকসংখ্যা আরো কয়েকগুণ বাড়তো। তবে এর ক্ষুদ্র একটি অংশ স্বাভাবিকভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক বইয়ের বাইরে গিয়ে অন্য বইগুলো পড়তে শুরু করেন, এবং এভাবেই পাঠক বাড়তে থাকে। এই ক্রমবর্ধমান পাঠকদের ভিন্ন ভিন্ন রুচি, সেগুলোর চাহিদা মেটাতে প্রকাশনা জগতে বিষয়-বৈচিত্র্যও বাড়ছে ধীরে ধীরে। এখন আর কেবল গল্প-উপন্যাস-কবিতার বই প্রকাশ করেই ক্ষান্ত দিচ্ছেন না প্রকাশকরা, মনোযোগ দিচ্ছেন অন্যান্য বিষয়ের প্রতিও। বেড়েছে শিশু-কিশোর পাঠকের সংখ্যাও- তবে তাদের চাহিদা অনুযায়ী বাড়েনি মানসম্মত বইয়ের সংখ্যা।

৫. লেখক-প্রকাশকদের সম্পর্ক হওয়ার কথা বন্ধুত্বপূর্ণ- যেহেতু দুই পক্ষই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু হয়ে উঠেছে বৈরিতাপূর্ণ। এর মূল কারণ উভয় পক্ষের ভেতরে পেশাদারিত্বের অভাব। লেখকরা স্বভাবজাতভাবেই অপেশাদারি-অবৈষয়িক। লেখার ক্ষেত্রে শৌখিন তারা নন, লেখাই তাদের ধ্যান-জ্ঞান ও জীবন-যাপন, কিন্তু নিজের বইয়ের প্রচার-বিপণন এবং প্রকাশকদের সঙ্গে লেনদেনের ব্যাপারে তারা খুবই অপটু। এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রকাশকরা তো তা নন। এটা তাদের ব্যবসা, অপেশাদারি হওয়ার সুযোগ তাদের নেই। অথচ বিস্ময়করভাবে অপেশাদারি মনোভাব রয়ে গেছে তাদের ভেতরে। এখনো অধিকাংশ প্রকাশক কোনো চুক্তি করেন না লেখকদের সঙ্গে, লেখকরাও ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামান না, পুরো ব্যাপারটি টিকে আছে মৌখিক কথাবার্তার ওপর, ভদ্রলোকি আচরণের ওপর। ফলে, ভুল বোঝাবুঝি হবার সুযোগও অনেক বেশি থেকে যায়। এবং এখন সেটা হচ্ছেও। পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাচ্ছেন উচ্চস্বরে, সম্পর্ক হয়ে উঠছে বৈরি। প্রতিষ্ঠিত-বয়োজ্যেষ্ঠ লেখকরা পর্যন্ত বলছেন, প্রকাশকরা তাদের বইয়ের হিসাব এবং রয়্যালিটি বুঝিয়ে দেন না এবং বই প্রকাশের পর প্রকাশকদের আর কোনো খোঁজ থাকে না। প্রকাশকরা বলছেন, তারা ঠিক মতোই সব হিসাব বুঝিয়ে দিচ্ছেন লেখকদের, কিন্তু এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারছেন না। অথচ এর সহজ সমাধান সম্ভব একটি মানসম্মত চুক্তিপত্রের মাধ্যমে এবং বইয়ের হিসাব-নিকাশ বুঝিয়ে দেওয়ার কাগজপত্র সংরক্ষণের মাধ্যমে।

৬. প্রকাশক-রয়্যালিটি ইত্যাদি নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা মিশ্র। কেউ কেউ আমার সঙ্গে লিখিত চুক্তি করেছেন, বই বিক্রির হিসাব এবং রয়্যালিটি বুঝিয়ে দিয়েছেন। কেউ বা চুক্তি করেছেন, কিন্তু বই বিক্রির কোনো হিসাব দেননি কোনোদিনই, তবে মাঝে-মধ্যে খেয়াল-খুশিমতো কিছু রয়্যালিটি দিয়েছেন। শত বার বলেও তাদের কাছ থেকে কোনো কিছুর হিসাব পাওয়া যায়নি। একজন প্রকাশক তো অতি আশ্চর্যের জন্ম দিয়েছেন। আমার একটি বইয়ের প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যাবার খবর দিয়ে দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য লিখিত চুক্তির আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। আমিও রাজি হয়ে যাই। তাঁর কার্যালয়ে সেদিন চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভোজনের আয়োজন করা হয়, কিন্তু প্রথম সংস্করণের রয়্যালিটি দেবার জন্য কিছুদিন সময় চান। তিন বছর পার হয়ে গেছে, সেই ‘কিছুদিন’ আর আসেনি! আবার কিছু প্রকাশক আছেন যারা চুক্তির কথা বলে পাণ্ডুলিপি নেন, তারপর আর চুক্তি করেন না। এমনকি সংস্করণ শেষ হয়ে গেলেও রয়্যালিটি দেন না। এরকম জগাখিচুড়ি অবস্থায় চলছে আমাদের প্রকাশনা জগৎ।

৭. বছর কয়েক আগে এক টেলিভিশনের লাইভ শো-তে এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ঘটেছিল। অনুষ্ঠান চলার সময়ই একটা চমৎকার এসএমএস পাঠান লেখক-অনুবাদক রফিক-উম-মুনির চৌধুরী: ‘বইমেলা শেষে খালি হাতে যিনি ঘরে ফেরেন তার নাম লেখক!’ মন ছুঁয়ে যাবার মতো একটা বাক্য। এটা নিয়ে আমি সেদিন অনুষ্ঠানে কথা বলেছি, ইউপিএল-এর প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ সেটাকে সমর্থনও করেছেন। আবারও বলি। বই প্রকাশ-পর্বে প্রতিটি স্তরে প্রকাশককে টাকা গুনতে হয়। কম্পোজ-মেকাপ-ছাপা কারখানা-কাগজ ব্যবসায়ী-বাইন্ডিং-স্টল তৈরি-বিক্রয়কর্মী সবাইকেই নগদ মূল্য পরিশোধ করতে হয়। শুধু লেখকরাই শূন্য হাতে ফেরেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিরকাল শূন্য হাতেই থাকেন। এমনকি কত কপি বই ছাপা হলো, কত কপি বিক্রি হলো অথবা হলো না, রয়্যালিটি হিসাবে কতো টাকা তার প্রাপ্য- সেই হিসাবটাও প্রকাশকরা দেন না। এই অভিযোগটি অবশ্য জনপ্রিয় লেখকদের পক্ষ থেকে ওঠে না। তাদেরকে অগ্রীমই দেওয়া হয়, আর প্রকাশকরা সর্বক্ষেত্রে সেটাকে উদাহরণ হিসেবে পেশ করেন। প্রকাশকরা যদি শুধু জনপ্রিয় লেখকদের নিয়েই থাকতে চান, আমাদের কোনোই আপত্তি নেই। ‘জনপ্রিয়’ বই বাণিজ্যলক্ষ্মী হলেও প্রকাশকের মর্যাদা তাতে বাড়ে না, বরং মর্যাদা বাড়ে শিল্পমূল্যসম্পন্ন বই প্রকাশ করেই। তাহলে একেক লেখকের সঙ্গে একেক আচরণ কেন?

৮. তবে অবস্থা পাল্টাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের কয়েকজন প্রকাশক এবং কোনো-কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক লেখকদের সঙ্গে চুক্তি করছেন, বই ও রয়্যালিটির হিসাব বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এটা শুভ পরিবর্তনের ইঙ্গিত। সব লেখক-প্রকাশক যদি এই চর্চাটি অব্যাহত রাখেন তাহলে বৈরি সম্পর্কটি আর বৈরি থাকবে না, হয়ে উঠবে সৌহার্দ্যপূর্ণ। একজন লেখক হিসেবে আমি সেই চমৎকার পরিবেশটি দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা   

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়