ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

বিদীর্ণ, রক্তাক্ত হয়ে কলম হাতে নিয়েছি

হরিশংকর জলদাস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৩, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিদীর্ণ, রক্তাক্ত হয়ে কলম হাতে নিয়েছি

আমার প্রথম উপন্যাস ‘জলপুত্র’ ২০০৮ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়; মাওলা ব্রাদার্স থেকে। এর আগে, গ্রন্থমেলার সঙ্গে আমার নিয়মিত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি, একথা বলতেই হবে। লেখালেখি শুরু করেছি ২০০৭ সাল থেকে। সে বছর ‘যুগান্তর’ ঈদসংখ্যার জন্য নতুন লিখিয়েদের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি আহ্বান করেছিলো। আমি তখন বয়সে নবীন ছিলাম না, তবে লেখক হিসেবে নবীন। আমার দু’জন ছাত্র টিপু সুলতান এবং মোহাম্মদ মহিউদ্দীন যারা আগেই আমার লেখাটি পড়েছিলো তারা লেখাটি পাঠিয়ে দেয়। সেখানে উপন্যাসটির খণ্ডিত অংশ ছাপা হয়। এর কারণ, ওই উপন্যাস যাদের নিয়ে লেখা, তাদের জীবন ক্লেদাক্ত, অন্ধকার। তারা ক্ষুধায় জর্জরিত একটি সম্প্রদায়। যারা ক্ষুধার্ত, তাদের মুখের ভাষা মধুর হয় না। তাদের সংলাপে গালিগালাজ, খিস্তি আছে, অস্থির কথাবার্তাও আছে। যে ভাষাকে বলা হয়ে থাকে ‘অশ্লীল’। অথচ জেলেরা নিজেদের আনন্দ-নিরানন্দ প্রকাশ করার জন্য এই ভাষার আশ্রয় নেয়।

আমি যেহেতু জেলেদের কথা লিখেছি, তাদের ভাষা অতিক্রম করিনি। এজন্যই হয়তো সম্পাদকের মনে হয়েছিলো উপন্যাসের বেশ কিছু অংশ ছাপানোর উপযুক্ত নয়। পরের বছর ২০০৮ সালে পরিপূর্ণভাবে বইটি প্রকাশিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। এই হলো শুরু। আমি যেন বৃত্তে বাধা পড়লাম। গ্রন্থমেলাকেন্দ্রীক এক ধরণের কর্মপরিকল্পনা বছরজুড়ে শুরু হলো। আমার লেখা অধিকাংশ বই মেলাকেন্দ্রীক প্রকাশিত। পঞ্চান্ন বছর বয়সে লিখতে বসেছি। যে বয়সে মুসলিম হলে মানুষ হজে যাওয়ার চিন্তা করে, হিন্দু হলে গয়া-কাশী যেতে চায়; পূণ্যলাভের আশায়। সেই বয়সে আমি কলম ধরলাম।

আমি লিখি মূলত সামাজিক অপমানের জবাব। বিদীর্ণ, রক্তাক্ত হয়ে কলম হাতে নিয়েছি। ২০০৮ সালে বই প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর প্রতিবছর একটি করে উপন্যাস লিখতাম- প্রথম দিকে। প্রকাশকদের চাপে সেই অভ্যাস আমাকে ত্যাগ করতে হয়েছে। কোনো বছর মেলায় আমার দুটো উপন্যাসও বেরিয়েছে। এবছরও তার ব্যতিক্রম নয়। গত বছর গ্রন্থমেলায় আমার আত্মজীবনী ‘নোনাজলে ডুব-সাঁতার’ প্রকাশ হয়। আমার বইগুলো একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে সেগুলো ফেব্রুয়ারিতে প্রথম প্রকাশিত। অন্য সময় প্রকাশ করবার মতো লেখা হয়ে ওঠে না। একটু-আধটু পত্রিকায় লিখি। যারা সম্মানী দিতে রাজি থাকেন তাদের পত্রিকায় লিখি। কারণ, পত্রিকাগুলো যতো আগ্রহ নিয়ে লেখা চায় সম্মানী দিতে ততো আগ্রহী হয় না। এটা অনুচিত।

যদি প্রতিদিনের কথা বলি, আমি একেবারে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকি। মানুষ লিখতে লিখতে বিরতিতে যায়। আমি অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ- বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া বা রান্না ঘরে ডেকচি-পাতিল মাজতে মাজতে যখন হয়রান হযে যাই, তখন লিখতে বসি। একঘণ্টা-আধঘণ্টা কখনও দুইঘণ্টা লিখি। যতো সময় লিখি তারচেয়ে বেশি পড়ি। বই কেনার জন্য আমি মেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকি না। বছরজুড়ে বই কিনি। সুতরাং বলা যায়, বই কেনার উৎসব বছরজুড়ে, আর বই প্রকাশের উৎসব এই গ্রন্থমেলা। এখন তো মেলার জন্য হৃদয়ের টান অনুভব করি। ভালোবাসা অনুভব করি।

প্রকাশক অনেক সময় আমন্ত্রণ জানান মেলায় আসার জন্য। ব্যক্তিগতভাবে শামুকের খোলসে থাকা মানুষ আমি। অবগুণ্ঠিত একজন লেখক; এই লেখককেও কিছু পাঠক ভালোবাসেন। গ্রন্থমেলায় তাদের সঙ্গে কথা হয়, দেখা হয়, শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। যদিও আমি মনেপ্রাণে চাই- পাঠক আমার লেখা জানুক, দেখুক- আমাকে নয়।বর্তমানে গ্রন্থমেলার যে ব্যাপ্তি ঘটেছে এই পরিবর্তন আমার ভালো লেগেছে। আপনি আমাকে নিমন্ত্রণ করে, একটা নোংরা, সংকীর্ণ জায়গায় খেতে দিলেন; যত ভালোই রাঁধুন না কেন, আমার ভালো লাগবে না। সুতরাং পরিবেশের জন্য এটা জরুরি। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আগে যে মেলা হতো সেগুলো ছোট জায়গায় হতো। শৃঙ্খলারও অভাব ছিলো। তখন প্রকাশকের সংখ্যাও কম ছিলো। তারপরও সবাই স্টল পেতো না। বঞ্চিত হতো। যারা পেতো তাদের কেউ কেউ হয়তো ব্যক্তিগত প্রভাব খাটাতো। এখন বিস্তৃত জায়গায় মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে অনেক নতুন প্রকাশকও স্টল পাচ্ছেন। পাঠক হিসেবে বা দর্শনার্থী হিসেবে আমার চোখ সন্তুষ্টি পায়। হাঁটতে ভালো লাগে। আমি একটা স্টলে গিয়ে হাতে নিয়ে একটি বই ধরে দেখবার সুযোগ পাই। বইয়ের ঘ্রাণ নেয়ার তৃপ্তি পাই। বইয়ের ঘ্রাণ- সে যে কত ভালোলাগার; তা একজন বই পাগলের জানার কথা।

মেলায় একসঙ্গে অনেক বই দেখার সুযোগ হয়। সেগুলো থেকে পছন্দের বই কিনে নেয়া যায়। তারপর বছরজুড়ে পড়া। অনলাইনের স্ক্রিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকার মতো বিষয় কিন্তু নয়। বই হাতে নিয়ে আরাম করে শুয়ে-বসে, একটু কাত হয়ে, টেবিলে পাতা ছড়িয়ে, চেয়ারে হেলান দিয়ে বই পড়ার আনন্দ তুলনাহীন। এই আনন্দ আমি হারাতে চাই না। গ্রন্থমেলায় কবিতার বই অনেক বেশি প্রকাশ হয়। আমি কবি নই, কিন্তু কবিতার অনুরাগী। আমি শব্দ শিখি কবিদের কাছ থেকে। নতুন শব্দের আবিষ্কর্তা তারা। কবিরা জীবনের সারমর্ম লিখিয়ে। আমরা যারা গদ্য-গল্প-উপন্যাস লিখি তারা জীবনের ভাব সম্প্রসারণ লিখি। আমরা জীবনের নানা অভিজ্ঞতা বিস্তৃত করতে করতে প্রসারিত করি। আর কবিরা জীবন সারাংশ করে দেখান। যারা সারমর্ম করতে পারেন তারা নমস্য। ফলে কবিতার বই বেশি প্রকাশ হওয়ার বিষয়টিও আমার কাছে আনন্দের।

অনুলিখন: স্বরলিপি



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়