ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বইমেলা নিয়ে আবারও পুরোনো কথা

প্রশান্ত মৃধা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বইমেলা নিয়ে আবারও পুরোনো কথা



ফেব্রুয়ারিই যেন একমাত্র মাস যখন বইয়ের মেলা আর বই নিয়ে কথা বলা যায়। বাকি এগারোটি মাস এ নিয়ে শীতঘুমে একবছর! ‘শীতঘুমে একজীবন’ নামে তাঁর প্রথম গল্পের বইয়ের নামকরণই করেছেন ইমতিয়ার শামীম; ওই নামকরণ জীবনের জড়তারই এক রূপক! এই ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা আর বই নিয়ে কথা বলতে ইমতিয়ার শামীমের দেয়া ওই অসাধারণ রূপকের কথা মনে এলো।
শুধু এই একমাস, মাঘ আর ফাল্গুনের ২৮/২৯ দিন, অথবা আগের ক’টা দিন, পৌষের জড় দিন থেকেই বই নিয়ে কথা হবে, তারপর ফাল্গুন শেষ হতে না-হতেই সব ভুলে যাব। এমনিতেই তো আমাদের কথা বলার বিষয়ের অভাব নেই। তা বোঝার, তা জানার জন্য সংবাদপত্রের উপসম্পাদকীয় আর টেলিভিশনের টক-শো নামক কথাবার্তার অনুষ্ঠান কিছুমাত্র মনোযোগ না-দিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। ফলে বই আর বইমেলার মতো একটি বিষয় মার্চ পয়লাই আলোচনার বাইরে চলে যায়। এটা এ সময়ের এক স্বাভাবিক খতিয়ান হিসেবেই ধরে নিয়েছি। এই ফেব্রুয়ারিতেই এই দেশের লেখকরা, প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা যেন ‘সুযোগ’ পেয়ে বই নিয়ে কথা বলেন।
কিন্তু এ তো হবার কথা ছিল না। বই নিয়ে কথা তো চলতে পারত বছরজুড়ে। বই নিয়ে কথাবার্তা যে এই একমাসে এসে দাঁড়িয়েছে এর পেছনের প্রধান কারণ একুশে বইমেলা। এটা একমাসব্যাপী আয়োজন। আর প্রচারমাধ্যমসহ সকলের ধারণাটাও যেন বই নিয়ে যা কথাবার্তা তা এ মাসেই বলা যায়। এ সময় একটু হলেও যেন মনে হচ্ছে; আমি আঙুল তুলছি বইমেলার দিকে। বিষয়টি কোনোভাবেই তা নয়। বরং উল্টো দিক দিয়ে আবার চাইছি, বই নিয়ে কথা এই ফেব্রুয়ারি থেকেই শুরু হোক। একথা এজন্য বলছি, প্রতি ফেব্রুয়ারিতে ক’টি ভালো বই বের হয়, তা আমাদের জানা। সারা বছর সেই বইগুলো নিয়ে সে-কথা চলতে পারে। তা হয় না, তার কারণ যেন এই, এক ফেব্রুয়ারিতেই বই নিয়ে কথাবার্তা প্রায় সবই আমরা শেষ করে ফেলেছি।
এই কথাগুলো বলে; আবারও এই ফেব্রুয়ারিতে বই আর বইমেলা নিয়ে কথা বলার প্রস্তুতি নিয়েছি। অর্থাৎ এই সময়ে এই কথাগুলো বলছি আমরা। এসব কেন হয়েছে তার কয়েকটি কারণ যদি তাৎক্ষণিকভাবে ভেবে বের করা যায় তাহলে বিষয়টি এই:

এক. বইমেলায় এতো মৌসুমী বই প্রকাশিত হয় যে, ভালো বই সেই বইয়ের ফাঁকে হারিয়ে যায়। লেখককে ‘মৌসুমী’ বলতে পারলে কথাটি হয়তো যথার্থ হতো। কিন্তু বইমেলায় লেখক উপস্থিত হোন বা নাই হোন, বইখানিই তো শোভা বাড়িয়ে চলছে। আর তা কোনোভাবেই বাংলা ভাষার যে মান, এই ভাষার সাহিত্যের যে অবস্থান, তাতে বইটি প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল না। তবুও বেরিয়েছে সে বই! কীভাবে বেরিয়েছে, কেন বেরিয়েছে, সে উত্তর ওই বইটির প্রকাশক দিতে পারবেন। কিন্তু এতে পরে যে বিষয়টি ঘটে; ওই যে প্রায় তিন, সাড়ে তিন হাজার বই বের হয়, মেলায় এর প্রকাশকেরা বেশ গরম থাকেন। প্রকৃত বইটি নিয়ে বইমেলার পরে তার আর কোনো চিন্তা থাকে না। আর পাঠক বলে যাদের জানি, তারা ওইসব বইয়ের চাপে ভালো বইটির কাছ থেকে দূরে সরে যান। একে তো আমাদের বইপড়ুয়ার অবস্থা বেশ কাহিল। ভালো বই চেনানোর তেমন কোনো উপায় প্রচার মাধ্যমগুলো সেভাবে রাখেনি।

দুই. প্রকাশকদের পক্ষ থেকেও বলার মতো অনেক কথা নিশ্চয়ই আছে। কোনো কিছুই একতরফাভাবে গড়ে ওঠে না কিংবা ওঠেনি। কিন্তু অনেক জনপ্রিয় বই, অথবা জনপ্রিয় লেখকের বই, যে বই হাজার কপিরও বেশি ছাপা হয়, তেমন বইও কেন সম্পাদনা ছাড়া আর বানান ভুলসহ প্রকাশিত হয়? আর এইসব মৌসুমী বই রচয়িতাদের বই যে পরিমাণ অসম্পাদিতভাবে প্রকাশিত হয়, এ নিয়ে কোনো কথা না তোলাই ভালো।

তিন. ওই মৌসুমী বইয়ের লেখকদের নিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা আমাদের জানান কোনো কোনো প্রকাশক। তা জানলে, শুনলে বোঝা যায়, এই বইয়ের রচয়িতাদের প্রায় কারও ভাষাপ্রেম কি মাতৃভাষাপ্রেম তো নেই-ই; এমনকি সাহিত্যচর্চা করার কোনো ধরনের মানসিকতা আর প্রস্তুতি নিয়ে তারা আসেননি। বইয়ের পাণ্ডুলিপির সঙ্গে যে জিনিসটা নিয়ে তাঁরা প্রকাশকের দপ্তরে হাজির হন, সেটি টাকা। একথা কড়া সত্যি। উচ্চবিত্তের হাতে টাকা ছিল, আছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতেও ‘একখানা’ বই যে-কোনো দামে প্রকাশ করার মতো টাকা হয়েছে। এতে নিশ্চয়ই তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। প্রকাশকেরও ট্যাঁকে কিছু জমে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয় প্রকৃত লেখকের আর ভালো বইয়ের। প্রকাশকের খেয়াল সরে যায়। তিনি পুঁজি খাটিয়েছেন যে বইটির পেছনে সেটি যদি আর বিক্রি না-ও হয়, প্রচার আনুকূল্য না পায়, সেটির আলোচনা না প্রকাশিত হয়, এর কোনো কিছুতেই তার তখন আর কিছু যায় আসে না।

চার. বইমেলা থেকে কে ফেরে খালি হাতে? তিনি লেখক। সুকান্তের ‘প্রিয়তমাসু’ কবিতার সেই পঙ্‌ক্তির মতো লেখক যেন সেই বাতিঅলা, যে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাতি জ্বালিয়ে ফেরে, অথচ তার নিজের ঘরে বাতি জ্বালানোর সামর্থ নেই। বইয়ের সঙ্গে যুক্ত সবাই টাকা পায়। একমাত্র লেখক নয়। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। কোনো কোনো লেখক পান, জ্যেষ্ঠ লেখকরা পান, বইয়ের সংস্করণ বা মুদ্রণ শেষে হলেও কেউ কেউ পান। কিন্তু ওগুলো ঘটার পরেও পান না, এমন ঘটনাও প্রচুর। তরুণ লেখকদের বিষয়টি আরো করুণ। সম্প্রতি আহমাদ মোস্তফা কামাল, রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী একটি কথা আমাদের জানিয়েছেন। সেই কথাটি বেশ কাব্যিক, কিন্তু সেই পঙ্‌ক্তির ভেতরে লুকিয়ে আছে লেখকদের করুণতর সাতকাহন। কথাটা এই: বইমেলা থেকে যিনি খালি হাতে ফেরেন তিনি লেখক।
এমন একটি কথা বলার জন্য আর সামনে আনার জন্য আমার এই দুই সহযাত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।

পাঁচ. তাই কখনও কখনও যেন মনে হয়, মহান ভাষা আন্দোলনের যে সিঁড়ি বেয়ে আসা এই বইমেলা নিজেই এতো আলোর মাঝে অন্ধকারে রেখেছে প্রকৃত বই আর সত্যিকার সাহিত্যচর্চাকারীকে। (এখানে সাহিত্যচর্চাকারী বা লেখক একটু বড়ো অর্থে, কোনোভাবেই শুধু কবিতা, কথাসাহিত্য, নাটক, প্রবন্ধ রচয়িতাকে মনে রাখছি না। যে কোনো ভাষায় চিন্তার, যে কোনো বিষয় যিনি লেখেন, আর তা বইয়ে রূপ পায়, তিনি)।
এর কারণ, এমন আয়োজন যদি না হতো, এতো আলো আর আলোচনার যদি সুযোগ না হতো, তাহলে প্রকৃত পাঠক খুঁজে নিতেন তাঁর পছন্দের লেখককে। এ কথা তো এখন দিনের আলোর মতো সত্য: বইমেলায় প্রকাশিত প্রায় চার হাজার বইয়ের খুব অল্পই পাওয়া যাবে বইয়ের দোকানে। এমনকি মার্চ মাসেই সিংহভাগ বইয়ের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। সেজন্য এই উৎসব আর আয়োজন তো কোনো দোষ করেনি। আমাদের স্বভাবদোষে আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় শিক্ষা আর অর্থনীতির মুনাফা চরিত্র এজন্য দায়ী। কতটুকু দায়ী, কীভাবে দায়ী- সেই হিসেব ‘অবসরে ভাববার কথা’। যদিও সেই অবসর আদৌ আমাদের জুটবে বলে মনে হয় না।

এই কথাগুলো সবই প্রায় তাৎক্ষণিক তোলা। তবে এ বিষয়ে আমাদের ভেতরের উষ্মা আর হতাশা দিনকে দিন বাড়ছে। যে সাহিত্যকর্মী বইমেলা মানে রমনার এই ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার নিচে আলো ঝলমল বৃক্ষশোভিত প্রাঙ্গণে নিজের মুখ বারবার টেলিভিশনে দেখানোকে বোঝেন, তাঁর কাছে এই কথাগুলোর আদৌ কোনো দাম নেই। একটি ভাষার গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাগুলো এক জায়গায় করার ভেতরে যদি এতো গোজামিল থাকে, তাহলে ভালো কাজ ধীরে ধীরে নিরুৎসাহিত হয়। মহৎ তো দুরস্ত; তা হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু সেটি জাতীয় উদ্যোগের অংশ হতে পারে না। জাতি হিসেবে ধীরে ধীরে আমরা সেদিকেই যাচ্ছি।
বই নিয়ে কথা শুধু ফেব্রুয়ারিতেই নয়, সারা বছর হোক। আর বইমেলা ফেব্রুয়ারিতে, কিন্তু তার প্রস্তুতি চলুক মার্চ থেকেই। প্রকৃত বই পাঠকের হাতে পৌঁছাক। অল্প বই বের হোক; সুমুদ্রিত ও সম্পাদিত। সে বই যেন সারাবছর পাওয়া যায় বইয়ের দোকানে।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়