ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অন্তরালের তারা শিল্পের আড়ালে

আঁখি সিদ্দিকা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ১ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অন্তরালের তারা শিল্পের আড়ালে

আঁখি সিদ্দিকা: ক’দিন ধরে কি এক বিষণ্নতায় ডুবে আছি! সব আছে ঠিকঠাক। আসলে ঠিকঠাকই বা কী! চলছে। আমি বেঁচে আছি অনেকটাই ভদ্রচিতভাবে।  সমাজে আমার একটা ঠিকানা আছে। খাওয়া-পরা, চলন-বলন সবই ঠিক আছে, সম্মানও কিছুটা আছে। দু’একজন চেনে বলেও মনে হয়। ভালোবাসা নামক এক নিমকের অংশও বটে। তবুও বিষণ্নতা কিসের? তবে কি বিষণ্নবিলাসী আমি? বিমলাকে নিয়ে অনেক কথা হলো গতকাল খামখেয়ালী সভায়। এই সভা আয়োজনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যই বা কী? এমন ভাবনা আমাকে ভাবায়। কি প্রয়োজন একশ বছর আগের এসব কপচানি? বিমলার নিজের কোনো কথা নেই বলেছিলাম। অথচ ‘বিমলার আত্মকথা’ নামে একটি অংশ লেখক লিখেছেন সুনিপুণভাবে। নারীর এই আত্মমগ্নতায় কি বোঝাতে চেয়েছেন শিল্পী-সাধকেরা। কতটুকু বুঝেছেন তার এমন মনীষীগণ? রবীন্দ্রনাথ নিজের বিছানায় যাওয়ার গল্প কোথাও যেমন লেখেননি, তেমনি কোনো চরিত্রেরও যৌনতা সর্ম্পকে কোনো ভাবনা বা বাস্তব চাহিদা থাকা, না-থাকার কথাও লেখেননি। তবে কি এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন তিনি? এতো বড় সত্যকে এড়িয়ে ভাবের গভীরে অলঙ্কার পরিয়ে কোন সমাজ তিনি প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন? যেখানে লরেন্স খুব অনায়াসে কনির অতৃপ্তের কথা জানান দেন নিজের সত্তার সামনে দাঁড়িয়ে, নিজের শরীর দেখেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, অক্ষম স্বামীর অক্ষমতায় জীর্ণ হয়ে নৈতিকতায় মুষড়ে গিয়েও চরম সত্য যৌনতায় নিজেকে সঁপে দেয় মের্লসের সুঠাম তেজী শরীরের কাছে।

রবি কেন লরেন্স হবেন? প্রশ্ন উঠতেই পারে। বিমলার সঙ্গে নিখিলেশ-এর শারীরিক তৃপ্ততা বা অতৃপ্ততার কথা আমরা জানতে পারি না। সুখী সুখীভাবে মোহিত বিমলা তবে কেন সুদীপ্তের তেজের কাছে নতজানু হলো তা কি কেবল বন্দে মাতরম-এর জন্য? তাই যদি হয় তবে স্বয়ং রবিই তো নিখিলেশ হয়ে সেই স্বদেশীতার বিরোধিতা করলেন। তবে কি সত্য? কৌশলে কি এড়িয়ে গেলেন রবি? অমূল্য ভালোবাসা নিয়ে এলে ফিরিয়ে দিয়ে বিমলাকে দিয়ে বলালেন- তুই পর জন্মে আমার ছেলে হবি। ভাই বললেও কি আশঙ্কা থেকে যায়? ছেলের সাথে প্রেম-যৌনতায় একাকার হওয়া যায় না বলে? তাই যদি হয় বহুযুগ আগে তো ইডিপাস হয়েছিলেন। আমরা স্বীকার করি না, আমরা বলতে চাই না। আমরা আড়াল করি। আর আড়ালের আড়ালে আমরা এই গোপন গোপনীয়তায় মত্ত হই। তা আবার শিল্প-সাহিত্যে শত পোষাক পরিয়ে সামনে আনি যাতে কোনভাবে উলঙ্গ হয়ে বেরিয়ে না আসে। এই পর্দা কেন? মুল থেকে মুলৎপাটন উপড়ে ফেলা কি যায়? রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেখানে যৌনতার ফুল ফোটে। তাহলে এই অস্বীকার, আড়ালচোখে, আড় চোখে কি দেখতে চাই আমরা? আজ পশ্চিম ছোট ছোট কাপড় পরা শিখিয়েছে আমাদের। আমরা খুব জোর গলায় বলি মেয়েরা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। আর যাচ্ছে বলেই তাদের আধখানি পোষাক দেখে বখাটেরা ইভটিজ করে বা নানারকম উত্যক্ত করে। আমি পোষাকের পক্ষে-বিপক্ষে সে কথা তুলছি না। ইউরোপ খোলামেলা যেমন পোষাকে তেমনি শিল্পে ও সাহিত্যেও। রবি লেখেননি বিমলার যন্ত্রণার কথা, আজ আমিও লিখবো না। তাই আমার কবিতার, শব্দের লাইনের ফাঁকে সরাসরি যৌনতা, স্তন, দুই পায়ের মাঝখানে মধ্যবর্তী ফাঁক, এসব শব্দ আলগোছে তুলে ফেলে প্রতিশব্দ খোঁজা হয়। আমার ব্রা শব্দটির প্রতিশব্দ তাই কাঁচুলি হয়ে ওঠে।আমরা গোপনে ব্রা খুলে নিপলে ঠোঁট রাখতে পারি, চুষে নিতে পারি তার সকল নির্যাস, কেবল ছবি আঁকতে গেলে, শব্দের সম্ভারে তাকে আড়াল করার শিল্পসম্মত বিকল্প খুঁজতে থাকি না কেবল, সেই মুহূর্তকেও অস্বীকার করে যেতে চাই। আমি বাংলা চটি লেখার কথা বলছি না, কিন্তু কেন দগদগে ঘা-এর স্বরুপ চিহ্নিত করতে আমাদের ভয়? এই সংকোচের মূল কী? আর এই সংকোচ আড়ালের ফলে বাস্তব-বঞ্চিতের পরিমাণের সংখ্যাও আমাদের অজানা। তাই যখন আমার বাবার বিছানায় আমার মা অতৃপ্ত হন তিনি তাকে ছেড়ে যেতে পারেন না অন্য কোনো বিছানায় তৃপ্ত হওয়ার জন্য। কিন্তু আমার স্বামী যে মুহূর্তে আমাকে নিয়ে অসুখী হন তিনি চিন্তা করেন বিকল্প। তার অন্যত্র গমনে বাধা থাকছে না। তা বৈধ-অবৈধের তকমায় পরিশুদ্ধ আইন ও ধর্মবলেও তিনি বিকল্প পছন্দে বিরাজিত থাকতে পারছেন। আমার সামনে মুক্তি নেই কারণ আমার বিকল্প পথ-পছন্দ কেবল সীমিত নয়, নেই বললেই চলে। তাই ভালোবাসার ভাবাবেগে আমার অক্ষম প্রেমিকও আমার কাছে ঈশ্বর হয়ে ওঠে, আমি সৎ হয়ে সততার কথা নিজের কানে কানে বলি, যে তোমার যোনি যতই ভিজুক তুমি ওর প্রতি নিবিষ্ট ও একনিষ্ঠ থাকবে। তোমার নিশ্বাসও তার। তাই তোমার চাহিদা-অচাহিদা তারই অক্ষমতার দানে পুষ্ট। যতটুকু তিনি তোমাকে দিতে পারেন ততটুকুই তোমার। এই ভাবালুতার আড়ালে আমার অপুষ্টি তৃষ্ণা গুমরে গুমরে উঠলেও আমার চরম আড়াল নিজের কাছে, আমার শিল্পের কাছে। আমার সাহিত্যের কাছে। আমার প্রেমিকের অক্ষমতার কারণে তার কোন ভাবালুতা হয় না, হয় না সংকোচ বা অপরাধবোধ! বরং আমার হয় কেন এমনটা আগ বাড়িয়ে গেলাম? কেন তাকে অপ্রস্তুত করলাম? এই আমি’র আড়ালে আমার চোখ ভিজে যায়, যোনি ভিজে যায়? তাতে কী? আমি তো কেবল বঞ্চিত, বিমূর্ত! আমি দেবী। কোন বিমূর্ত আলোচনার মাঝখানে তাই শুনতে হয়- তুমি ওভাবে ভাবছো কারণ তুমি নারী! এভাবে পুরুষের কাছ থেকে শুনে বিরক্তি ঠেকলেও প্রতিউত্তরে বলি, এভাবে ভাবছি কারণ এটা সত্যি! একথা বলে আলোচনা থেকে নিজেকে বিষয়গতভাবে নিজের অবস্থানকে আড়াল করি। প্রতুত্তরে কিন্তু বলি না, তুমি ওভাবে ভাবো কারণ তুমি পুরুষ। কারণ একজন পুরুষ পুরুষ বলেই সঠিক। তার আছে বিশিষ্টতা। নারীবাদে পণ্যের শিকার আমি আমরা। তবুও এই পণ্যের ঢোল বাজানো আমার কোনভাবে উদ্দেশ্য নয়। নিজের দেহকে পুরুষ ভাবে সরাসরি দুনিয়ার সাথে সংযোগ হিসেবে, বস্তুনিষ্ঠভাবে উপলব্ধি করে। সে সুকৌশলে এড়িয়ে যায় তার দেহেও গ্রন্থি আছে, যেমন টেস্টিকেল যা থেকে হরমোন নিঃসৃত হয়। কিন্তু নারীর বেলায় বলা হয় নারী তার গ্রন্থি বা গ্লান্ড দিয়ে চিন্তা করে। মহারথি এরিস্টটল খুব গৌরবের সাথে বলেছিলেন, স্ত্রী জাতি কিছু গুণের ঘাটতির কারণেই  স্ত্রী জাতি।নারী প্রকৃতিকে প্রাকৃতিক ত্রুটিতে পীড়িত বলেই আমাদের বিবেচনা করতে হবে। আর সেন্ট থমাস তো নারীকে অর্পূণ পুরুষ বা আকস্মিক সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এর প্রতীকায়ন জেনেসিসে, যেখানে ঈভকে দেখানো হয়েছে অ্যাডামের একটি সুপারনিউম্যারারি হাড় থেকে তৈরি।

ফলত মানব জাতি হচ্ছে পুরুষ আর পুরুষ নারীকে বর্ণনা করে স্বকীয়ভাবে নয় বরং নিজের সঙ্গে তুলনা করে, তাই বিমলার কোনো নিজের কথা থাকে না, তাই আত্মপীড়নের গ্লানিতে ভুগতে হয় সকল আমি’দের। পুরুষ যা ঘোষণা করে নারী তাই। আর তাকেই বলা হয় যৌনতা, যা দ্বারা এটাই বোঝা যায় নারী পুরুষের কাছে মূলত যৌনসত্তা। আর সেই যৌনতার নিজের পছন্দ অনুযায়ী ব্যবহার বা অব্যহার করার স্বাধীনতাও পূর্ণ তার। তাই নারী অপরিহার্যের বিপরীতে অ-পরিহার্য হয়ে ওঠে। পুরুষ বিষয়। পুরুষ পরম। নারী দ্বিতীয়, অপর-সত্তা অথবা দ্য আদার। নারীর কাছে পুরুষের আসা-যাওয়া তার পছন্দানুযায়ী। সেখানে পুরুষের মুক্তি। আড়াল ছাড়াই তার আসা-যাওয়ার বিকল্প অনেক পথ তৈরী। তাই সন্দীপ তার ইচ্ছেনুযায়ী আসে, স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে কেটেও পড়ে। পলিটিক্যাল ইকোনমি ধরিয়ে দিয়ে নিখিলেশ তার বৌ বিমলাকে আরও একটু জাতে উঠাবার চেষ্টা করে। বিনোদিনী তাই আশালতার বিছানায় গিয়ে ছটফট করে, নিজের শরীর নিজে কামড়ে ধরে, না পায় মহেন্দ্রকে, না পায় বিনয়কে। তার ভগাঙ্কুরের মাঝে তাই মহত্ব ঢুকিয়ে তাকে কাশি পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথ হাফ ছেড়ে বাঁচেন। বঙ্কিম রোহিনীর যৌনচেতনাকে অপমান অপদস্থ করিয়ে গুলি করে মারে। শশী তাই ইচ্ছে মতো ডাকে কুসুমকে। নোরার এক দরজা বন্ধের শব্দ নাড়িয়ে দেয় সকল পুরুষকে, এমনকি বন্ধ অন্ধ হয়ে যাওয়া নারীর ডানা ঝাপটানো আড়াল করা পাখাকেও। আন্না-কারিনাকেও শেষ পর্যন্ত ফিরতে হয়। কোনি বেরিয়ে গেলেও তার পরিণতি কি হয় আমরা ঠাওর করতে পারি না। আদরের তিস্তানা শেষপর্যন্ত যৌনতার কাছে হেরে গিয়ে খুনী হয়ে ওঠে।  হেকেটি সপ্রতিভ হলেও কোথায় মিটছে তার যৌনাকাঙ্ক্ষা? নানা ভণ্ডামির ফাঁক-ফোকর গলে তাকে তো নিজের পথ নিজেকে খুঁজে বের হতে হয়, যেখানে কোনো পছন্দসই পথ নেই খোলা? তবে কবে এই আড়াল ঘুঁচবে? কবে নিজের চেতনার কাছে, নিজের যৌনতার কাছে সত্যিকারের স্বীকারক্তি ঘটবে সকল আমি’দের?



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়