ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

সারমেয় কিংবা জর্জ হ্যারিসন

ইশরাত তানিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৮, ১১ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সারমেয় কিংবা জর্জ হ্যারিসন


উত্তর কমলাপুরের একটা মধ্যবিত্ত গলি ভাতঘুম শেষে জেগে উঠেছে। কিছুক্ষণ আগেও রোদ মাথায় নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল দালানগুলো। সে রোদ নেমে এসেছে কার্নিশের গ্রীবায়।

টঙ দোকানে ঢাউস কেটলির ঘন দুধে চা ফুটছে। কড়া লিকারের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশে। কাবাবের দোকানের বাইরে শিক কাবাবগুলোর এক পাশ প্রায় হয়ে এসেছে। শিক নেড়ে উল্টে দিল কাবাবওয়ালা। কয়লাপোড়া ধোঁয়া গরম বাড়িয়ে দিল মুহূর্তেই। সামনে দিয়ে যাবার সময় কাবাবের গন্ধ আর আঁচটুকু সে টের পেল।

গলির মোড়ে এসে একবার সে পেছন ফিরে তাকায়। ওর বাঁ হাতে কয়েকটা পেয়ারাপাতা আর ডান হাতে সাদা নেটের ব্যাগে দুলছে চারটা ম্যাগি নুডলস। জলদি সে গলির ভেতর ঢুকে যায়। পেছন পেছন আসছে দুটো কুকুর। হাঁটার গতি বাড়ায় সে। বাসার সামনে সরু প্যাসেজে ঢুকে লোহার গেট টেনে হ্যাচবোল্ট লাগিয়ে দেয়। গেট না বলে পাত বলাই দস্তুর। যথেষ্ট হালকা আর এখানে-সেখানে মরচে পড়া। কোনো কালে ফিরোজারঙা ছিল। রোদে-জলে সে রং উধাও। এমনিতে ভিড়িয়ে রাখলেই হয়। শক্ত করে এঁটে যায় পাশের সবুজাভ শ্যাওলামাখা দেয়ালে। ভেতর বা বাইরে থেকে খুলতে হলে জোর এক ধাক্কায় কাজ হয়ে যায়। রাতে অবশ্য লোহার গেটে তালা দেয়া থাকে।        

বুকটা ধড়ফড় করছে ওর। শোবার ঘরের জানলার পর্দা বাতাসে উড়লে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কুকুর দুটো দেখা যায়। বালুর ওপর দুটো দীর্ঘ ছায়ার একটা অচল আরেকটা সচল। একটা বালির ওপর আরাম করে চোখ বুজে আছে। আরেকটা সামনের ডান পা দিয়ে কানের পেছনে চুলকাচ্ছে। শোবার ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুম। সাদা বেসিনের ওপর একটা হাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত কলের ঠাণ্ডা পানিতে হালকা গোলাপি রং হয়ে ধুয়ে যায়। চুমকির হাত বেশ খানিকটা কেটে গেছে। ক্ষয়ে আসা হ্যাচবোল্টের হাতল ধরে টানতে গিয়ে হঠাৎ এই বিপত্তি। চিনচিনে একটা ব্যথা কাটা জায়গাজুড়ে। নিজের ওপর বিরক্ত হয় সে।  

ফ্রিজ খুলে চুমকি কোকাকোলার বোতল বের করে দুই ঢোক খায়। পানীয়র ঝাঁঝে গরম থিতিয়ে আসে। ৫০০ এমএল কোকাকোলার প্লাস্টিক বোতলে অর্ধেকটুকু রয়ে গেছে। বোতল আবার ফ্রিজে রেখে দেয়। ফ্রিজের দরজা লাগানোর সময় একটু বেশি জোরেই শব্দ হয়। ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে সে জানলা দিয়ে তাকায়।         

গলির মুখেই ডান দিকে ডেভেলপারের কাজ চলছে। বাঁ দিকে একটা পুরনো রেকর্ডিং স্টুডিও। নাম হ্যারিসন স্টুডিও। ততক্ষণে রোদ দোতলা স্টুডিও’র গা বেয়ে গড়িয়ে পা অব্দি নেমে গেছে। শুধু নরম আলোয় লেগে আছে দুপুরের দীর্ঘশ্বাস। খুব একটা বড় কমার্শিয়াল স্টুডিও না হলেও হ্যারিসন টিকে আছে। অডিও বাজারের যা অবস্থা, কেউ আর ঝুঁকি নিতে চায় না। না শিল্পী, না প্রযোজনা কোম্পানি। এছাড়া হোম স্টুডিওতে যখন-তখন মিউজিক ট্র্যাক করা যায়। শুধু ডিজিটাল কী-বোর্ড, সাউন্ড কার্ড আর সফটওয়্যার থাকলেই হলো। পছন্দ মতো শিফট পাওয়ার ঝামেলা নেই। এসব কারণেই কমার্শিয়াল স্টুডিও একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এলাকার তরুণ ছেলে নাইমের কাছ থেকে এসব শুনেছে সবাই। নাইম কলেজে পড়ে। পাড়ার  ইয়াং ম্যারিনার্স ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলে। চে’র ক্যাপ মাথায় আর হাতে সব সময় অ্যাকুস্টিক স্প্যানিশ গিটার। চমৎকার গান গায়। বীটলস ওর প্রিয় ব্যান্ড।


হ্যারিসন স্টুডিও’র পাশে ছোটখাট জটলা। এলাকার কয়েকজন লোকের মুখ চেনা গেল। অফিসফেরত আলিমুল হক কী ভেবে উঁকি দিল জটলায়। ওর হাতে পঞ্চাশটা লিচু। কিনেছে পঞ্চাশটাই এবং এটাও নিশ্চিত জানে গুনলে এখানে পঞ্চাশটা লিচু পাওয়া যাবে না। 

হ্যারিসন স্টুডিও প্রায় চল্লিশ বছরের পুরনো। আগের সেই রমরমা ব্যবসা নেই। তবু হঠাৎ কখনো মুখচেনা শিল্পী আসে গান রেকর্ড করতে। তখন এক নজর দেখতে ভিড় করে লোকজন। তেমনই কিছু ভাবছে আলিম। উঁকি দিয়ে দেখে অনেকগুলো পায়ের ভিড়ে ওপাশে এক সারমেয়ী শুয়ে। সদ্য চারটা বাচ্চা প্রসব করেছে। গত বছর ছয়টা ছানার জন্ম দিয়েছিল। কীভাবে কুকুরের বংশ বৃদ্ধি কমানো যায়, এ নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। একটু একটু করে জটলা বড় হচ্ছে।  

‘না না, এইভাবে চলে নাকি?’ ব্যবসায়ী সালাম সাহেব বললেন, ‘আরে কয়েকদিন আগে আমার ভায়রা ভাই অল্পের জন্য কামড় খায় নাই।’    

ভ্রু কুঁচকে ব্যাংকার মশিউর সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ। শুনছি এই ঘটনা। আচ্ছা কী যেন ইঞ্জেকশান আছে কুকুরের জন্য। সেগুলা দিয়ে একটা ব্যবস্থা নেয়া যায় না?’    

‘পশু হাসপাতালে যোগাযোগ করা দরকার, কী বলেন?’ সালাম সাহেবের গলার স্বরে উদ্বিগ্নতার  কাঁপন টের পাওয়া যায়। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না কেউ।  

আলিম হাতের লিচু সামলিয়ে বলল, ‘অস্বাভাবিকভাবে কুকুর বাড়তেছে। সিটি কর্পোরেশান করে কী?’  

‘ঘোড়ার ঘাস কাডে,’ ফোড়ন কাটল টিভি মেকানিক। মশিউর সাহেবের টিভি ঠিক করে সে বেরিয়েছে একটু আগে। মেকানিকের চলে যাবার কথা দোকানের দিকে। মশিউর সাহেব বিকেলে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন। দুজনই এদিকে এসে দাঁড়িয়েছে আলম সাহেব আর ওয়ার্ড কমিশনারকে দেখে।        

‘মেয়র বলছে কোনো অবস্থায় কুকুর নিধন করা যাবে না। এইটা নিষিদ্ধ,’ বললেন ওয়ার্ড কমিশনার।

প্রাইমারী স্কুলের অঙ্কের স্যার বাঁ হাতের কব্জি সামান্য সোজা করে ঘড়ির ডায়াল দেখে নিলেন। ঘণ্টা আর মিনিটের কাঁটা সোয়া ৬ এর কথাই বলছে। সাতটায় কোচিং করাতে হবে ছেলেদের। ঢের সময় আছে হাতে। চিন্তাটা তাই একশ আশি ডিগ্রী ঘুরিয়ে তিনি বললেন, ‘নিধনের কাজ কী? নিবীর্য করলেই চলে।’ 

বাদ আসর মিলাদ পড়িয়ে মসজিদের দিকে ফিরছেন ইমাম সাহেব। বাতাসে আতরের গন্ধ ছড়িয়ে তিনিও জটলায় উঁকি দিলেন। নাইমকেও দেখা গেল। কাঁধে স্প্যানিশ গীটারের লম্বা ব্যাগ। এক মাথা চুল ঢাকা পড়েছে ক্যাপের নিচে। এই বয়সের ছেলেরা সাধারণত বয়স্কদের এড়িয়ে চলে। কিন্তু নাইম যেহেতু নাইম তাই সে এসে জটলার আয়তন বাড়ায়। ডান কাঁধে ব্যাগের বেল্ট টেনে ধরে আছে সে।

পেছন থেকে ওর গলা শোনা যায়, ‘ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা যায় না, আঙ্কেল? ট্রেইন্ড কুকুর বিক্রিও করা যায়।’    

সালাম সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। নাইমের নির্বোধসুলভ কথাবার্তায়। ছেলেটাকে ওনার ফাজিল ধরনের মনে হয়। আলিমসহ বাকিরা বোঝে না কুকুরের উপদ্রব কিংবা বংশবৃদ্ধি নিয়ে তাদের কী বলা উচিত। মশিউর সাহেবের ভ্রু দুটি আরও কুঁচকে বলিরেখার গভীরতা বাড়িয়ে দেয়। 

সমর্থন পাবার আশায় ইমাম সাহেবকে লক্ষ্য করে নাইম বলে, ‘খেয়াল করেছেন হুজুর? আযানের সময় কুকুরগুলা আরো বেশি ঘেউ ঘেউ করে।’            

সুরমা পরা চোখ ইমাম সাহেবের। অপুর্ব করুণায় নীলাভ ধূসর দুটো চোখ তুলে তিনি নাইমের দিকে তাকান। শান্ত গলায় বলেন, ‘মনিবভক্ত হলেও কুকুরের মধ্যে শয়তানের প্রভাব বেশি।’


চুমকি তখন পর্দা সরিয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়েছে। সেভাবেই আছে কুকুর দুটো। আরও কয়েকটা জুটেছে। গলির রাস্তা গরম সান্ধ্যবাতাস পোহায়। ক্রমশ মুছে যায় কুকুর এবং আশেপাশে কয়েকজন পথচারীর ছায়া। কুকুর আর মানুষ কারো দিকে কারোর কৌতূহল নেই। আবছা আলোয় আলিম বাসার দিকে হেঁটে আসছে।    

লিচু দেখে চুমকি খুব খুশি। ওর প্রিয় ফল। লিচুতে ভিটামিন ‘সি’ আছে। ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। কিন্তু কাটা হাতে সে লিচুর খোসা ছিলতে পারে না। চুমকির উজ্জ্বল ত্বক নিষ্প্রভ হয়ে আসে। ওর হাতের দিকে তাকিয়ে অবাক হয় আলিম।  

‘কাটল কীভাবে?’

‘তাড়াহুড়া করে গেট লাগাইতে গেছি...’    

‘কিসের তাড়াহুড়া?’ শঙ্কিত গলায় প্রশ্ন করে আলিম।   

‘আরে দুইটা কুকুর পিছনে আসতে ছিল। ভয়ের চোটে তাড়াতাড়ি গেট লাগাইতে গিয়ে এই অবস্থা।’ 

শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে আলিম এটা আর চুমকিকে বলে না যে ভয় পেয়েছে সে নিজেও।  ওরাই শুধু নয়।  এক আশ্চর্য ভয়ে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন পাড়ার মানুষ। অথচ কেউই কাউকে এ প্রসঙ্গে কিছু বলে না। বালুর মাঠে মাল্টিসোরেড বিল্ডিং-এর কাজ শুরু হয়েছে। সারাদিন নির্মাণ কাজ চলছে। নানান মেশিনের আওয়াজ মানুষের কানে সয়ে গেছে। দলবাজ কুকুরগুলোর দাপটের সামনে একেক সময় সিঁটিয়ে যায় নির্মাণ শ্রমিকরা।  বড় বড় ইটের চাই ছুঁড়ে মারে। সামান্য দূরে সরে কুকুরের দল। নেড়ী কুকুরের মতো গা ভরা ঘা নিয়ে কুঁইকুঁই  করে না। ডাঁটসে লেজ নাড়ায়। ছরছর করে মুতে দেয় এখানে সেখানে। এদের আচরণ প্রতাপশালীদের মতোই। কুকুরের ছিপছিপে গড়ন থেকে ছলকে পড়ে তেজ। সূঁচালো চোয়ালে শয়তানের দৃঢ়তা।       

পরশু রাতে আলিম লন্ড্রিতে কাপড় দিতে যাবে, দেখল ওয়ার্ড কমিশনারের কালো প্রিমিও হর্ন দিচ্ছে। কিন্তু কুকুরগুলোর কোনো হেলদোল নেই। রাস্তা থেকে এক হাতও সরল না। লেজ নাড়ল কিছুক্ষণ। তারপর পা দিয়ে কান চুলকে রাস্তায় চোয়াল ঠেকিয়ে বসে রইল নির্বিকার। ইদানীং রাত দশটা বাজতেই রাস্তাঘাট নিঝুম। দিনরাতের ত্রাস হয়ে উঠছে কুকুরগুলো অথচ এই পাড়ার মানুষ সবাই খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। যেন তেমন কিছু হয়নি। মশিউর সাহেব তখন হাতের পাতায় কপাল ঘষছিলেন। হয়তো কুঁচকে যাওয়া ভ্রু সোজা করতেই কিংবা এমনও হতে পারে মাথা ধরেছিল। আলিমকে দেখে লিচুর দাম জিজ্ঞেস করলেন। সে মুহূর্তে লিচুর মতো অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপারে কথা বলল সবাই।  

‘যেই দাম লিচুর!’ 

‘চায়না লিচু সবচে ভালো।’

‘এই বছর এখনও লিচু কিনি নাই।’ 

এসব কথায়, এটা ঠিক, বিকেলের গুরুগম্ভীর পরিবেশ হালকা হয়ে এসেছিল। 

রাতে ভাত খেয়ে আলিম আর চুমকি টিভি দেখে। জি বাংলা একের পর এক সিরিয়াল নিয়ে তাদের জীবনে ঢুকে পড়ে। অন্যদিন শুতে যাবার সময় গলায় কাঁধে বাহুমূলে পাফ দিয়ে থুপে থুপে ট্যালকম পাউডার লাগায় চুমকি। আজ হাতের  জন্য ভালো করে পাউডার লাগানো হয় না। তবু চুমকির শরীরটা খুব টাটকা লাগে আলিমের। কোনো কারণ আছে কি না সে জানে না। শরীরী কায়দাকানুনে চুমকি খুব একটা পারদর্শী না হলেও জুবুথুবু নয়। যেন তূষে ভরা গলা থেকে ঘরঘরে আহ্লাদী স্বর বেরিয়ে আসে। চুমকির সরু নির্মেদ কোমর দেখে বিভ্রান্ত হয় আলিম। কুকুরীর নাকি চিতাবাঘিনীর বুঝতে পারে না। সে যখন পুরুষ হয়ে উঠছে, একটানা ট্রেনের হুইসেল ভেসে আসছে দূর থেকে। স্টেশান ছেড়ে যাচ্ছে কোনো ট্রেন।


উত্তর কমলাপুরের পাশেই সুবিশাল ‘কমলাপুর রেল স্টেশান’। সেখান থেকেই সালাম সাহেবের শালী আর ভায়রা ভাইয়ের ঘটনা পাড়াময় হলো। সিলেট থেকে পারাবত এক্সপ্রেস ঢাকা এসেছিল রাত দশটায়। ট্রেন থেকে নেমে দুজন কুলি ঠিক করছে। রেল স্টেশানের চত্বরজুড়ে ছড়িয়ে আছে কুকুরের দল। প্রায় শ’ তিনেক কুকুর হবেই। প্ল্যাটফর্মে তাদের অবাধ বিচরণ। দূরপাল্লার ট্রেনযাত্রীরা গভীর রাতে স্টেশানে নেমে বুঝতে পারে না, চারদিকে এত কুকুর কেন?          

শালী আর তার স্বামীর সামনে একদল বেওয়ারিশ কুকুর। হঠাৎ কুকুরের সম্মিলিত ডাকাডাকিতে ভয়ানক হয়ে উঠল পরিবেশ। কামড়াকামড়ি শুরু হতেই আতঙ্কে প্ল্যাটফর্মের উল্টোদিকে দৌড় দিল শালী। স্বামী বেচারা বাক্সব্যাগ ফেলে বউ বাঁচাতে ছুটল। কুকুর তার পায়ে দাঁত প্রায় বসিয়ে দিচ্ছিল। নিরাপত্তা কর্মীরা লম্বা লাঠি হাতে দৌড়ে এসে কুকুর তাড়াল। ফাঁকতালে দুটো ব্যাগ লাপাত্তা। সকাল হতেই পাড়ায় এসব খবর চাউর হয়ে যায়। 

শুক্রবারের সকালটা রয়েসয়ে শুরু হয় বলে খবরটা হাওয়ায় ভেসে ভেসে পাড়া অতিক্রম করে গিয়েছিল। লু হাওয়ায় না পোড়া, না পঁচা, না আঁশটে, না ধুলোটে গন্ধ। এমন অদ্ভুত ভোঁতা শুকনো বাতাসে পেয়ারা পাতাগুলো নড়ে ওঠে। প্রথমে কিছু বুঝতে পারে না নাইম। ভালো করে তাকালে ভিড়ের ওপাশে দৃশ্যটা স্পষ্ট হয়। পেয়ারা গাছের নিচে জোড়লাগা কুকুর দুটো দেখে চলতিফিরতি মানুষ অতি আগ্রহে দাঁড়িয়ে গেছে। দোতলার বারান্দা থেকে লিপ্ততার পূর্ণাঙ্গ দৃশ্য দেখে নাইম। একটা ঢিল টার্গেট মিস করে ঠাস করে পেয়ারা গাছে বাড়ি খায়। কার উৎসাহী হাত থেকে এটা উড়ে এলো, ভিড়ের মধ্যে ধরা যায় না।   

দুটো কুকুরের আচরণ তেমন একটা পাবলিক নুইসেন্স তৈরি করতে পারে না। এই তামাশার ভিড়ে মেয়েদের তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। একটা মেয়ে টিস্যু দিয়ে কপাল মুছতে মুছতে মুরগিওয়ালার পাশ দিয়ে চলে গেল। আরেকজন গেল দর্জির দোকানের দিকে। ‘ওই, যা যাহ্’ বলে এক কিশোরকে ডাক দিল কাবাবওয়ালা, ‘চুলায় কয়লা ঢাল গিয়া’। 

কাবারের দোকানে লাউড স্পীকারে গলা খুলে লতা গাইছে- ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে নাকো মন...’। বাতাস বুঝে গানের শব্দ একবার বাড়ছে আরেকবার কমছে।          

হ্যারিসন স্টুডিও’র সামনে গিটার টিউন করছে নাইম। সঙ্গে ওর কলেজের দুই বন্ধু। এ বয়সের ছেলেদের ঘরে মন টেকে না। ঝাঁ ঝাঁ আঁচে সূর্য যখন পৃথিবীটাকে সেঁকছে, এমন সময়েও বাইরে থাকা চাই। অবশ্য আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। যে কোনো বন্ধ পেলেই নাইমদের চারতলা বিল্ডিংয়ের নিচে গাড়িবারান্দায় কিংবা স্টুডিও’র সামনে তিনজনের প্রায়ই আড্ডা চলে। দুর্জয়ের হাতেও গিটার। ‘হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলী হুইপ্স’ এর স্কেল ঠিক করছে নাইম। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পর  সায়েন্স ল্যাবের মোড় থেকে কিনে এনেছিল। গিটারের বয়স দুই বছর প্রায় হয়ে গেল। রামীমের আঙুল অ্যানড্রোয়েডের কী প্যাডে ঘুরছে।  

‘বীটলস এর লীড গিটারিস্ট ছিল জর্জ হ্যারিসন,’ স্ট্রিং এ হাত রেখে বলল নাইম। হ্যারিসনের মহাভক্ত সে। বব ডিলান আর এরিক ক্ল্যাপ্টনের গানও পছন্দ করে। তবে হ্যারিসনের সব কটা গান নাইমের কন্ঠস্থ।    

‘জানি। হ্যারিসন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ করেছিল,’ ফোন থেকে চোখ তুলে তাকালো রামীম, ‘উনিশশ একাত্তরে।’

‘হু। যুদ্ধের সময়।’

 বাবার কাছে সেই গল্প শুনে গুগল করেছে নাইম। নিজের লেখা ‘বাংলাদেশ’ গানটা হ্যারিসন গেয়েছিল সে রাতে। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে। প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ বাংলাদেশের কথা শুনেছিল সেই গানে। 

‘কনসার্ট থেকে যে আড়াই লাখ ডলার উঠেছিল সেটা ইউনিসেফকে দিয়েছিল হ্যারিসন। বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য,’ নাইম বলল। যেদিন এসব জেনেছে, সেদিনই সে গিটারে ঝটপট তুলে ফেলেছে এই গানের সুর। সেই থেকে হ্যারিসন নাইমের খুব কাছের একজন হয়ে গেছে।

গিটার টিউন করতে করতে ওরা গল্প করে। এইচএসসি’র পর দুর্জয় স্যাট এ বসবে। স্কোর ভালো হলে অ্যামেরিকায় আন্ডার গ্র্যাড করতে চলে যাবে। কয়েকদিন আগে সে ড্যান ব্রাউনের ‘লস্ট সিম্বল’ পড়ে শেষ করেছে।

‘এইটা কোনো থ্রিলার হলো?’ খুব বিরক্ত দুর্জয়, ‘এইটা হলো ম্যাসনদের ওপর রিসার্চ পেপার।’    

উত্তর দিতে গিয়ে নাইমের চোখ পড়ল একটা কুকুরের ওপর। অবিকল এইচএমভি’র লোগোর কুকুরের ভঙ্গীতে বসে আছে। সেদিনের দুটো কুকুরের জোড়লাগা দৃশ্যটা ওর তখনই মনে পড়ে যায় কিন্তু দুর্জয় আর রামীমের কাছে সে কিছু বলে না কিংবা বলতে চায় না। এমনও হতে পারে ব্যাপারটা কীভাবে বলা যায় সেটা সে বুঝে উঠতে পারে না।


মাইকের গমগম শব্দে ইমাম সাহেবের চেনা স্বর শোনা যায়। ‘জীবজগৎ আর জড়জগৎ এই দুই উপাদান নিয়েই পৃথিবী। পৃথিবীর সব প্রাণী আল্লাহর একেকটি বিশেষ সৃষ্টি। সুবহানাল্লাহ!’ এসব কথার কিছু শব্দ বোঝা যায়। বাকি শব্দগুলো অর্থহীন ধ্বনি হয়ে হারিয়ে যায় অস্পষ্টতায়। জুম্মার নামাযের পর ইমাম সাহেব খুৎবা পড়েন। কুকুর সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা বয়ান করেন।          

তিনি মুসলিম ও তিরমিজি হাদিসের কথা শোনান, ‘যে ব্যক্তি শিকার করা আর গবাদি পশু অথবা শস্যক্ষেত পাহারা দেয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া কুকুর লালন-পালন করে, প্রতিদিন সেই ব্যক্তির দুই কিরাত পরিমাণ নেকি হ্রাস পায়। এক কিরাত মানে হলো উহুদ পাহাড়ের সমপরিমাণ। তবে কুকুরকে খাবার বা পানি দেয়া সওয়াবের কাজ। শিকারি বা পাহারাদার কুকুর মেরে ফেলা হারাম। সাধারণ অবস্থায় থাকা কুকুর নিধন ইসলামের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয়। পাগলা কুকুর বা কষ্টদায়ক কুকুর মেরে ফেলা আলেমদের মতে বৈধ।’        

শেষ বাক্যটিতে অনেকেই নীরবে মাথা ঝাঁকায়। মুসল্লীরা যে যার মতো ‘আল্লাহুম্মা আমীন’ বলে জামাত ভাঙে। বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। মাথায় টুপি, হাতে ভাঁজ করা জায়নামাজ নিয়ে হাঁটে আলিমও। আজ তার মনটা ভালো না। চুমকির বেশ জ্বর হয়েছে। অবশ্য সে দুশ্চিন্তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। চারপাশে কুকুর দেখে আলিম। কয়েকটা কুকু্র আপাতত শান্ত হয়ে বসে আছে। এর একটা হাই তোলে। আরেকটা পা তুলে গলা চুলকায়। আরেকটা লকলকে জিভ দিয়ে অণ্ডকোষ চাটে। কোমর চাটে ঘাড় বাঁকিয়ে। এই এলাকায় কুকুরগুলোর জন্ম, এখানেই বেড়ে ওঠা। শত শত হিংস্র কুকুরের আঁচড়-কামড়ে দিন দিন সবাই অতিষ্ট। কুকুরগুলোকে মেরে ফেলা দরকার নাকি অন্য কোনো ব্যবস্থা হবে এসব চিন্তায় আলিমের মাথা ভারী হয়ে ওঠে।


সালাম সাহেবের ভায়রার বৃত্তান্ত শুনে হাই তুললেন রেলওয়ের সিকিউরিটি ইনচার্জ। ছোটখাটো টেবিলের ওপাশে কাঠের চেয়ারে তিনি বসে আছেন। কয়েক মাস ধরে যাত্রী আর রেলকর্মীরা কুকুরের কামড় খাচ্ছে এসব তথ্য তার জানা আছে।

টেবিলের দিকে সামান্য ঝুঁকে বললেন, ‘কথা শুনেন। পাঁচ দিন আগের কথা। ৮টা কুকুরকে লোহার খাঁচায় ভরে একজন সকালের ট্রেনে করে ভৈরবের ফাঁকা জায়গায় ছেড়ে দিয়ে আসে।’    

টেবিলের এ প্রান্তে আগ্রহে ঝুঁকে আসে সালাম সাহেবের মাথা, ‘এইটা ভালো কাজ করসে।’ 

‘সেই রাতেই ৬টা কুকুর ফিরে আসে। এই প্ল্যাটফর্মেই জায়গা নেয়,’ উদাস গলায় কথাগুলো বললেন সিআই।    

কথাটা হজম করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে সালাম সাহেবের। জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেয়র জানে?’

টেবিলের ওপর স্বচ্ছ সবুজ গোলাকার পেপার ওয়েট। ডান হাতের পাঁচ আঙুলে সেটা বাম থেকে ডানে ঘোরাচ্ছেন সিআই।  

‘সেইটা বলতে পারব না কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেছে,’ খপ করে পেপের ওয়েট মুঠোবন্দী করলেন তিনি, ‘মেডিকেল অফিসার বলছেন কিছু করার নাই।’ 

মুঠো করা হাত তখনও টেবিলের ওপর। মুঠোর ভেতর পেপার ওয়েট।      

হতাশ হয়েই সিআই-এর রুম থেকে বেরিয়ে আসেন সালাম সাহেব আর তার ভায়রা। তখনও কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী লাঠি হাতে ঘোরাঘুরি করছে। কুকুরগুলোকে ছেড়ে এসে লাভ হয়নি। ঢাকা-ময়মনসিংহের ঈশা খাঁ লোকাল ট্রেনে চেপে ভৈরব গেলেও, ওরা ফিরে এসেছে শত কিলোমিটার পথ হেঁটে। 

সালাম সাহেবের কাছ থেকে এই ঘটনা শুনে উত্তর কমলাপুরের মানুষের মনে কুকুরাতঙ্ক বাড়তেই থাকে। বাড়তে থাকে অগনিত বেওয়ারিশ কুকুর। সারাক্ষণ উচ্ছিষ্ট খাবার ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া। এত কুকুরের খাবারই বা কোথায়? কপাল জোরে এক টুকরা মাংস পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে লোভী আর ক্ষুধার্ত কুকুরের দল। মানুষজন প্রাণ হাতে নিয়ে চলাফেরা করে রাস্তাঘাটে। ইদানীং ইনফেকশানের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পাড়ায়।  জরুরী কাজ না হলে ঘর থেকে কেউ বেরোয় না। এতে অবশ্য কুকুরদের কিছু আসে যায় না। শুধু উত্তর কমলাপুরের মানুষরা জেনে গেছে দরজার ওপাশেই অপ্রতিরোধ্য বিভীষিকার ঘেউ ঘেউ। তবু ওপাশে যেতেই হয়। গলিতে দেখা যায় আলিম প্রায় জ্ঞানহীন চুমকিকে নিয়ে রিকশায় উঠছে।

 আলিম তখনই বলেছিল লোহার গেটের হাতল জং ধরা। ইনফেকশান হতে পারে। চুমকি পাত্তা দেয়নি। খাটের ওপর এলিয়ে পড়ে আছে সে। চুমকির কাছে বসে জ্বরের ভাপ টের পায় আলিম।  

 গায়ে জ্বর জ্বর ভাব নিয়েই নুডলসের জন্য সবজী কাটছিল চুমকি। কাটা হাত নিয়েই। বটির ধারালো ফলা বেয়ে টমেটোর রস গড়িয়ে পড়ছিল নিচে পেতে রাখা প্লাস্টিকের পুরনো ডালায়। আলিম ম্যাগী নুডলস খেতে পছন্দ করে। লম্বা লম্বা লুডলস তার ঠোঁটের বাইরে ঝুলতে থাকে বেসামাল হয়ে। ঝুলন্ত নুডলসগুলোকে সুবিধা মতো সে কিছুতেই মুখের ভেতর ঢোকাতে পারে না। কাঁটা চামচ নিয়ে এই অবিরাম কসরত দেখে চুমকি। সেটা ভেবে একা একাই নীরবে হেসে ফেলে।   

গাজর কাটতে গিয়ে ডান চোখের পাতাটা কেমন ভারি লাগে চুমকির। সবজীর ডালা ঠেলে সরিয়ে রাখে। চুলায় তাওয়া বসিয়ে ফ্রিজ থেকে পেয়ারা পাতা বের করে আনে। গরম তাওয়ায় পাতা নেড়ে নরম কাপড়ে জড়িয়ে নেয়। তারপর চোখের ওপর মৃদু চেপে ধরে।      

প্রতি বছর বর্ষায় তার চোখে অঞ্জনী ওঠে আর সারাক্ষণ খচমচায়। পেয়ারাপাতায় অঞ্জনী সারে। তাই সে প্রায়ই নাইমদের বাড়ি যায় পেয়ারাপাতা আনতে। অন্য সময় পেয়ারা পাতার গরম সেঁকে চোখে আরাম পায়। ঘুম ঘুম লাগে। এবার বর্ষার আগেই, গরমের মাঝামাঝি অঞ্জনি উঠেছে। কিন্তু গরম সেঁকে আর আরাম লাগছে না। গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে ওর। চোখ জ্বলছে। হাতের ঘা এখনও শুকায়নি। কাটা জায়গাটা তখনও টনটনাচ্ছে। নরম কাঁথা গায়ে টেনে শুয়ে পড়ে চুমকি।  

দুই ভ্রু থেকে শীতল ধারা ওর চোখের গভীরে ঢুকে যায়। এতে সামান্য আরাম লাগে কিন্তু জ্বলতে থাকা আগুনের কুণ্ডলী বুজে যায় না। পরক্ষণেই আগুন শীতলতাকে শুষে নেয়। গম্ভীর মুখে আলিম জলপট্টির ভেজা কাপড় চুমকির কপালে বিছিয়ে দেয়। মুহূর্তেই গরম হয়ে যায় ভেজা কাপড়ের টুকরা। টিটেনাস ইঞ্জেকশান দেয়া দরকার ছিল হয়তো। কী গজব নাজিল হলো ঘরে-বাইরে বোঝে না আলিম।

পাড়াটা শুনশান হয়ে আছে। আলিমের অবশ্য সেদিকে নজর নেই। হাসপাতালে যাবার আগে সে নাইমকে ফোন করেছে। আলিম ছাড়া কে এত ছুটোছুটি করবে? নাইম সাথে থাকলে একটু ভরসা পাওয়া যায়। কিন্তু নাইমকেই ফোন করা কেন, সেটা পরিষ্কার আন্দাজ করা যায় না। হতে পারে ফোনের ডায়াল লিস্টে নাইমের নাম আছে কিংবা প্রতি বছর পেয়ারাপাতা আনার সময় নাইমদের সাথে চুমকির বেশ ভাব হয়েছে। কিন্তু নাইমের ফোনে আলিম মিসড কল হয়ে থাকল।    

চুমকিকে সে নিয়ে এলো ইমার্জেন্সিতে। হাসপাতালে এসে তাজ্জব আলিম। রোগী গিজগিজ করছে। বেশির ভাগই কুকুরের কামড়ের শিকার। কে নেই? হাসপাতালের বেডে টিভি মেকানিক, বাবুর্চি, শিশু, গৃহিণী, আমলা, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চাওয়ালা‌, কাবাবওয়ালা, ওয়ার্ড কমিশনার শুয়ে আছে। এমন কি খোদ মেয়রও বাঁ হাতে স্যালাইন নিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। রোগীরা এখনও জানে না জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন শেষ। ডাক্তাররা শুধু বুঝতে পারছেন চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। এমন অবস্থায় হাসপাতালে একে একে  ভর্তি হলো রেলওয়ের সিকিউরিটি ইনচার্জ, ইমাম সাহেব, সালাম সাহেব।

একদিন আলিমও ক্যাজুলটি ওয়ার্ডের বেডে শুয়ে পড়ে। পাগলা কুকুরের কামড়ে রক্তাক্ত শরীর। বুকের ওপর ভাঙা ডান হাতে প্লাস্টার করা। জসীমউদ্দীন রোড দিয়ে রাতের বেলা সে বাসায় ফিরছিল। আচমকা একদল কুকুর আক্রমণ করায় ভারসাম্য হারিয়ে সে রাস্তায় পড়ে যায়। এক্সরে প্লেটে দেখা গেল রেডিয়াস আর আলনা দুটো হাড়ই ভেঙে গেছে। 

হাসপাতালে নাইম ছুটে ছুটে যায় এর-ওর কাছে। একবার ইমার্জেন্সিতে আরেকবার জেনারেল ওয়ার্ডে। সবার চোখে মৃত্যুর সুগভীর ছায়া দেখে সে। নাইমের হাত ধরে ফেলে বেডে শুয়ে থাকা টিভি মেকানিক। ‘ভাই রে,’ মৃদুস্বরে সে বলে, ‘কুত্তার বাচ্চারা কামড়ায় কি করছে দেহো!’ 

পাড়াশুদ্ধ লোকজন সবাই যেন ঢুকে গেছে হাসপাতালের কালো গহ্বরে। মৃত্যু গাছের একেকটি পাতা ঝরে আর একেকটি মানুষের প্রাণ নিভে যায়। ইয়া নাফসি চিৎকারের ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে এ যেন হাশরের ময়দান। কেউ কারো দিকে তাকানোর অবস্থায় নেই। পরিত্রাণের আশায় মানুষের আর্তনাদ শুষে হাসপাতালের সাদা দেয়ালগুলো ঘোলাটে হয়ে যায়। ঘোলাটে রং ক্রমে কালচে হয়ে গেলে দেখা যায় দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে থাকা, হাজার হাজার আহত মানুষ ওয়ার্ড, কেবিন, করিডোর উপচে হাসপাতালের গেট পেরিয়ে  চলে গেছে। তখনও বেশ অনেকটা আলো আছে আকাশে। সে আলোয় দেয়াল চৌহদ্দি পেরিয়ে, উত্তর কমলাপুর ছাড়িয়ে দক্ষিণ কমলাপুর, শাহজাহানপুর, ফকিরাপুলের দিকে চলে গেছে ব্যথায় যন্ত্রণায় কাতর মানুষের মিছিল। তারপর কতদূর গেছে কেউ জানে না। বুড়ো-জোয়ান নারী-নরের সাথে ধাক্কা খেয়ে কখনও হাতে ঠেলে সরিয়ে নাইম এগিয়ে যায় হাসপাতাল থেকে কমলাপুর রেল স্টেশানের দিকে। স্টেশান থেকে কাবাবের দোকান হয়ে বালুর মাঠ, মাঠ ছাড়িয়ে মসজিদ। যেন তাকে শেষ বিন্দুটির কাছে যেতে হবে অথচ সে চক্রাকারে ঘুরছে তো ঘুরছেই। মসজিদ থেকে বালুর মাঠ, মাঠের পরে কাবাবের দোকান, কমলাপুর স্টেশান থেকে ফের হাসপাতাল। ফের কাবাবের দোকান...

গাঢ় অন্ধকারে রাস্তাগুলো অচেনা হয়ে যায়। গোলকধাঁধার ভেতর ঘুরপাক খায় নাইম। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছু শুনতে পায় না। বাকি শব্দরা এক সময় চাপা পড়ে। মস্ত এক বাটি কালি কেউ যেন উলটে দিয়েছে আকাশে। সেই কালি হাওয়া চুইয়ে নেমে আসে গলিতে। বিরান সেই ঘুটঘুটে গলিও ফুরায় না। যেতে যেতে হয়তো আকাশে উঠে গেছে আর ছায়াপথে গিয়ে মিশেছে হ্যারিসন স্টুডিও। নক্ষত্রকণা জ্বলছে নাইমের সামনে। এক সময় শুনশানপনা কাটিয়ে শব্দরা জেগে ওঠে। চাপা গরগর শব্দে অবাক হয় নাইম। অগনিত চোখ জ্বলজ্বল করছে। যেন ভয়ানক ক্রুব্ধ ওরা। না দেখেও টের পায় সে। লালা ঝরছে নিষ্ঠুর চোয়াল থেকে।

 টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে নাইমের মাথায়, কাঁধে আর কুকুরগুলোর খাড়া কানে, রোমশ চামড়ায়। বৃষ্টির এক ফোঁটা রাস্তায় পড়া মাত্রই পানির সে চিহ্ন মুছে দিচ্ছে তাতানো পীচ। মুখোমুখি জ্বলন্ত চোখ। আত্মরক্ষা নাকি আক্রমণ? অশুভ অন্ধকারে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নাইম। যেন পলক পড়লেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে অজস্র সহস্র কুকুর। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেলে একবারের জন্যও চোখ না সরিয়ে ডান কাঁধ থেকে গিটার হাতে তুলে নেয় সে।     

পেছনে অদ্ভুত উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে স্টুডিও’র সাইনবোর্ডে লেখা ‘হ্যারিসন’ শব্দটি। দূরে তখন কোথাও হ্যারিসন গাইছে-

‘দো ইট মে সীম সো ফার

 ফ্রম হয়ার উই অল আর

ইট’স সামথিং উই কান্ট রিজেক্ট

দ্যাট সাফারিং আই কান্ট নেগলেক্ট...’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়