ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

প্রকৃতি, প্রিয় শিরোনাম || হামিম কামাল

হামিম কামাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫০, ২৬ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রকৃতি, প্রিয় শিরোনাম || হামিম কামাল

টানা প্রায় চার বছর কাজ করেছি তিনটি অনলাইন পত্রিকায়। প্রথম যখন যোগ দিয়েছি, গণমাধ্যম হিসেবে অনলাইন সংবাদপত্র তেমন পরিচিত নয়। কোথায় কাজ করি- লোককে একবারের জায়গায় দু’বার বলতে হয়, তবু বোঝে না। এ নিয়ে মনের ভেতরে এক ধরনের হীনমন্যতা কাজ করে। কোথায় এসেছি, কী করছি, ভবিষ্যৎ কী- এসব মাথার ভেতর নৃত্য করে। তবে সারাক্ষণ তো কেউ নেচে যেতে পারে না। প্রত্যাশারও একটা ক্লান্তি থাকে, এবং সে যখন থামে, মানুষ প্রথমবারের মতো হয়ত নিজের দিকে ফেরে, বলে, আসলে আমি কিডা/এইখানে মুই কী চাইতে আছি/আমার কাছ থেকেইবা এরা খিতা চায়...।

আমার প্রথম হাউজটা ছিল অপরিচ্ছন্ন, রহস্যময় আলো-আঁধারে ভরা। সেখানকার নীতিমালাও ছিল ধোঁয়াটে। দৃষ্টি সেখানে আচ্ছন্ন হয়ে থাকত। কী যে দেখছি, আর কী যে দেখাচ্ছি তা নিয়ে নিজেরাও বিভ্রান্ত। আপনি যখন অন্য কারো মুখে কিছু শোনেন, তারপর আবার নিজের মতো করে তা আরেকজনের কাছে বর্ণনা করেন, তখন কিছু আদিম জটিলতা তৈরি হয়। তেমন কিছু জটে আমরা প্রায়ই জড়িয়ে পড়তাম, এবং জড়িয়ে পড়া অনাথদের সে জট থেকে বের করে আনতেন সেদিনের নাথতুল্য স্বকৃত নোমান। রক্ষা এই- দেশের মানুষ আমাদের অনলাইন সংবাদপত্রটির ওপর নির্ভরশীল ছিল না। তবু আমরা খুব তাড়া দিতাম পরস্পরকে। প্রায়ই মনে হতো, কেমন সংবাদ-সংবাদ খেলছি। যেন দেশ-কাল একটা মামুলি ধারণা, আর সবই কেমন চড়ুইভাতি-চড়ুইভাতি। শিব বলেন, ‘চরৈবেতি বলার সুযোগ কই?’ নাই। সবাই যেন কোনোক্রমে কেবল ক’রে খাবে-এই করেছে পণ!

তবু ভালো, সেখানে বড়কর্তা ছিলেন একজন সাংবাদিক। খেলার নিয়মকানুন তার ছাঁচটা পায় বাস্তবতার নিয়মকানুন থেকে। সাংবাদিকতার বাস্তবতা সেই সাংবাদিক-বড়কর্তার জানা ছিল।

এরপর যে হাউজে গিয়েছিলাম, বড়কর্তা সেখানে সাংবাদিক নন, একজন ব্যবসায়ী। সেখানে ঝলমলে আলোর বান, আগের হাউজের আলো-আঁধারির মতো না, তবু অন্যরকম অন্ধকারের চর্চা ছিল। বেতন ছিল অনিয়মিত, তার ওপর কথায় কথায় কাঁচি চলত ওটার ওপর। বোধহয় ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের কারখানা-পণ্যের অবচয়টা কাটিয়ে ওঠার উপায়ে পরিণত হয়েছিলাম আমরা।  

তবে যে আগুনে নরক তৈরি, সে আগুনই দেবতার মুখ। সেই হাউজে এমন একজনকে পেয়েছিলাম, কল্লোল কর্মকার, যিনি আমাকে শব্দের গভীরে যাওয়া শিখিয়েছিলেন। গুরু জ্ঞানে শ্রদ্ধাভক্তি করতাম তাঁকে। তার কাছ থেকে আরো শিখেছি কী করে শিখতে আর শেখাতে হয়। দ্বিতীয় হাউজের করাল দিনগুলোয় তিনি একমাত্র মেঘছায়া। আরো কিছু মেঘ শুরুতে থাকলেও সূর্য ক্রমশ তেতে উঠতেই মিলিয়ে গিয়েছিল।

প্রথম হাউজ থেকে আমার বিদায় নেওয়াটা সুখকর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। রোদটা যেন তেতে উঠেছিল, ছায়া সরে এসেছিলাম। দ্বিতীয় হাউজ ছাড়ার অভিজ্ঞতা ভয়ঙ্কর। ছায়াটা মেঘগমগমে কালো মেঘ, যখন তখন বজ্রপাত-পাল্টা বজ্রপাত। আর সর্বশেষ অনলাইন হাউজটি যখন ছাড়ি, তখন বৃষ্টি ঝরছে। তাই অপমানিত আমার চোখের জল আর দেখা গেল না।

তবে ওরা আমাকে শেষ প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেনি, বাইরের লেখকদেরও, যারা পত্রিকার কর্মী নয়, ওরা বঞ্চিত করে না। প্রথম হাউজ আমার শেষ প্রাপ্য থেকে খানিকটা বঞ্চিত করেছিল, বাইরের লেখকদের বঞ্চিত করতে না-পারলে তার জের আমার ওপর দিয়ে গেছে, এমন নজির আছে। আর দ্বিতীয় সেই হাউজ আমাকে আমার শেষ প্রাপ্য থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত করেছিল, এবং বাইরের লেখকরা তাদের প্রাপ্য বুঝে পায়নি কখনো।  

যাহোক, প্রথম আর দ্বিতীয় হাউজের কথা বলেছি, এবার তৃতীয় হাউজের কথা বলি। সেখানে আলো ছিল, হাওয়া ছিল, মাটিও ছিল। সেখানে পরিশ্রমের উপযুক্ত মূল্য ছিল, সাংবাদিকের সম্মান ছিল। কারণ সেখানে বড়কর্তা পুঁজিপতি হলেও সাংবাদিক। তবে সেখানেও ছিল ফাঁদ, পুঁজিপতির সেই আদি ও অকৃত্রিম ফাঁদ। ফাঁদের দাঁতটা লাফিয়ে খটাং করে পেটের নরম চামড়াটা কামড়ে দেয়।

আগেকার দিনে একটা উপমা ছিল- পেটে লাথি মারা। তার একরকম মানে বোঝানো সহজ ছিল। কিন্তু যদি বলি পেট কেটে মূর্ধা ষ বানিয়ে দেওয়া- তাতে কী বোঝায়? তৃতীয় হাউজে আমরা পেট কাটা মূর্ধা ষ হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। তাতে মান যেত কিনা আর জানি না, অনেক জেনেছি এসব, তবে আমাদের মানে বদলে যেত। মানি (money) তো যেতই।

কিছু বোঝা গেল না, তাই না? থাক, সবকিছু এক বসায় বুঝে কাজ নেই। 

এখানেও সুখ-দুখের সাথী একজন অগ্রজকে শিক্ষক-বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলাম, মোহাম্মদ নূরুল হক, কখনো না-ভোলার তালিকায় তিনি আরেকটি নাম।

তো এভাবে সমস্ত হাউজে ‘বিটার এন্ডিং’ ঘটিয়ে অবশেষে একদিন অনলাইন সংবাদকর্মী-জীবনকে আমি যে বিদায় দিয়েছিলাম সেটিও যেন কবেকার কথা; এসিরিয়া ধুলা আজ, ব্যবিলন ছাই হয়ে গেছে।  


‘গরমে’ মৃত্যু অনিবার্য

গুরুগম্ভীর মুখে ছড়ি নাচাতে আসিনি। কিছু বিষয়ে বিব্রত হয়েছিলাম, সেটাই বলতে এসেছি। সংবাদপত্র-তা হোক কাগজের কি বৈদ্যুতিক-কাগজের, তার আরেকটা নাম আছে। মুখপত্র। মুখপত্রের একটা ব্যক্তিত্ব আছে, কারণ সে ব্যক্ত। সে কার হয়ে ব্যক্ত? জনতার, নাকি বিরাট পুঁজির কোনো প্রতিষ্ঠানের-সে কথা থাক। তর্কের সুবিধা দেওয়া যাক তাকে। মেনেই নিলাম, সে জনতার ‘মুখপাত্র’।

আচ্ছা, নামটা তো বেশ গালভরা। গাল যখন ভরা তখন হয় গিলে নাও, নয় উগড়ে দাও। মুখের ভেতর কতক্ষণ আর রাখা যায়? উগড়ে দিলে সেটা হয় বমন। যদি হয় পাকস্থলিতে গমন তো আসছে হজম বা বদহজমের প্রসঙ্গ। হজম হয়ে গেলে তো ভালো। পত্রিকার শরীর সেভাবেই তৈরি, বুঝে নিতে হবে। আর হজম না হলে?

গেলা বস্তু বিষাক্ত হলে বদহজম হয়, আবার পাকস্থলিটা তার অনুপযুক্ত হলেও বদহজম হয়। আর দুটোই একসঙ্গে হলে-হয় অক্কা।

কোনো সংবাদপত্র যখন অক্কা পায়, তখন ময়নাতদন্তে অন্তত দুটো বিষয় উঠে আসতে পারে। সে যাহা খাইয়াছে তাহা বিষ, এবং তাহার পরিপাকযন্ত্রটি দুর্বল  ।  

অমৃত নষ্ট হলে বিষে রূপান্তনিত হয়। অমৃতের পুত্রকন্যারা যখন নষ্ট-ভ্রষ্ট তখন তারা বিষাক্ত হয়ে উঠলে মুখপাত্রকেও তাই হতে হয়। উগড়ে দেওয়াটা কেমন দেখায়, সুতরাং সংবাদপত্র ওই মুখপাত্র অভিধাটিকে গিলে নিয়েছে ধরা যাক। এবার তার পাকস্থলির দিকে যদি নাক চেপে তাকাই, তো দেখি প্রকৃতি পাকস্থলিটিকে তার অধিকারীর শরীরী কাঠামো, ধরন আর তার চারপাশের পরিবেশ বুঝে গড়েছিল, খুব বড় কিছুর জন্যে যেন তার জন্ম হয়নি। তার পরিপাকের সীমা ছিল স্বল্পে বাঁধা। সীমাকে হয়ত বাড়ানো যেত, কিন্তু চেষ্টার অভাব ছিল।

সেই দ্বিতীয় হাউজটিতে একদিন, ইতোমধ্যে হাউজটির মৃত্যু হয়েছে, একজন সাংবাদিক কাণ্ডারিকে আমি বলতে শুনেছিলাম, ‘এবার গরম কিছু দ্যান, গরম!’

গরম কিছু যেটা তাতানো এবং টাটানো। সূক্ষ্ম যেখানে চোখ এড়িয়ে যায়, স্থূল সেখানে গোটা চোখজুড়ে থাকে। সুতরাং গরমটাকে সূক্ষ্ম হলে হবে না, হতে হবে স্থূল, অশ্লীল। অমৃতের পচে যাওয়া পুত্রকন্যাদের বিরাট একটি অংশ তার অপেক্ষায় বসে আছে, ঠিক যেমন রূপকথার নিকৃষ্ট প্রাণিটির খাবার হচ্ছে পচাগলা মড়া। কাণ্ডারির আহ্বান, তাদের পাতে কিছু বেড়ে দিন, তারা হাপুসহুপুস খাক, গাপুসগুপুস আওয়াজ উঠুক। কারো রুচিতে বাধলে নাক সিঁটকে সরে আসার আগে একবার অন্তত তাকাবে, আর ওটাই চাই!

অনলাইন-মায়াজগতের মোক্ষ এটাই। 


সুনীতি যেন কেমন, হেডমাস্টারের মতো। তাকে দেখে যতখানিক অস্বস্তি হয়, ততখানি যেন প্রেম জাগে না।

মুখপাত্রের কিন্তু অনেক দায়িত্ব ছিল। মুখপাত্র যে, সে মুখটা নিয়ে চলে বিধায় মুখরক্ষার দায়টাও তার। আয়না কিন্তু আমি কেমন তা-ই শুধু দেখায় না, কেমন হতে বিবেক আমাকে বলছে তা-ও দেখায়। আয়না যদি জীবন্ত হতো, তার যদি মূল্যবোধ থাকত, হয়ত সে প্রতিনিয়ত আমাদের নসিহত করত, সুনীতিকুমার হেডমাস্টার যেমন করেন।

এই হেডমাস্টারের ভূমিকাতে কাউকে না কাউকে যেতেই হয়। মুখপাত্রকে সে ভূমিকা নিতে হয়, কারণ সে মুখরক্ষা করে, আর সুনীতি ছাড়া মুখরক্ষার উপায় কই।

নেই দেখেই বোধয় অমৃতের নষ্ট পুত্রকন্যারা রটিয়ে দিলো ‘হেডমাস্টার জুতাচোর’।

পৃথিবী কিন্তু বহুদিন ধরে, একটা সত্য বা বাস্তবতাকে দেখিয়ে আসছে, তা হলো, প্রকৃতি সুনীতিকে নিজ অস্তিত্বের স্বার্থেই রক্ষা করে।

সুনীতি যে মানে, তাকে নতি স্বীকার করতে হয় না। আবার মাথা যার উঁচু, ঝড়ের আপ্টা তার ওপর দিয়েই যায়।

যাক না। এভাবে তো সে তার আশ্রিতদের রক্ষা করে, তার নাম হয়, আর নাম হলে মানুষও নমে, সালাম জানায়।

অনলাইনের মায়াজগতের দাবি দবদবিয়ে চলে। দাবি কোন পথে চলবে তা তো প্রকৃতির কাছ থেকে শেখার ব্যাপার, জানার ব্যাপার। মানবপ্রকৃতির সঙ্গে সে বোঝাপড়াটা, জানানোর কাজটা করবে ‘মুখপত্র’, ‘মুখপাত্র’। সবার হাতে হাতে আজ বুদ্ধিমান মুঠোফোন, কোলজুড়ে কম্পিউটার। ‍সুতরাং বড় দায়টা নিতে হবে অনলাইন গণমাধ্যমকে। খেলা করার সুযোগ কোথায়? তবু মুক্তইচ্ছের জগত, দায় চাইলে এড়ানোই যায়। কিন্তু দায় এড়ানোর পুলকটা কতক্ষণেরই বা। কাপুরুষ তার আনন্দের মূল্য অপমৃত্যু দিয়ে পরিশোধ করে।

 

লেখক: কথাসাহিত্যিক


 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়