ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

তিনি জাগিয়ে তুলেছেন

ড. তানভীর আহমেদ সিডনী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫৭, ৮ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তিনি জাগিয়ে তুলেছেন

ড. তানভীর আহমেদ সিডনী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপন সৃষ্টিশীলতায় রাজনীতি এনেছেন। তবে শ্লোগান ও মিছিলে আক্রান্ত রাজনীতি নয়। বরং মনের গভীরে টান দেয়, আমাদের চিন্তনকে বিচিত্রমুখীন করে নতুন এক সত্যের পথগামী করে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আগ থেকেই এ বিষয়ক প্রচারণা ছিল-ইংরেজরা বঙ্গভঙ্গ বিষয়ে জনমত যাচাই করতে চেয়েছে। তাদের ষড়যন্ত্রে বাংলার মানুষ কিছু সময়ের জন্য থমকে গিয়েছিল। তারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে। এ সময়ের কর্মসূচি ছিল মৌখিক প্রতিবাদ করা, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এর বিরুদ্ধে আলোচনা করা।

রবীন্দ্রনাথ এর আগেই ১৯০৪ সালের ২২ শে জুলাই এক বক্তব্যে বলেন, গ্রামের দিকে ফিরে তাকাও, জাগিয়ে তুলতে হবে গ্রামকে। মাটির কাছেই ফিরে যাওয়া। কবি তাঁর কাব্যকে বাস্তবের পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করলেন। তাঁর বিশ্বাস এমত ছিল: ‘মানুষের প্রকৃতির মধ্যে সবই যদি চিরন্তন হয়, কিছুই যদি তাহার নিজে গড়িয়া লইবার না থাকে, আপনার মধ্যে কোথাও যদি সে আপনার ইচ্ছা খাটাইবার জায়গা না পায় তবে তো সে মাটির ঢেলা। আবার যদি তাহার অতীতকালের কোনো একটা চিরন্তন ধারা না থাকে তাহার সমস্তই আকস্মিক হয় কিংবা নিজের ইচ্ছা অনুসারেই আগাগোড়া আপনাকে যদি তাহার রচনা করিতে হয় তবে সে একটা পাগলামি, একটা আকাশকুসুম।’  ‘আত্মপরিচয়’ নামক প্রবন্ধ থেকে পাঠ করতে করতে নিজেকে উপলব্ধি করি রবীন্দ্রনাথের ভূমি মানুষের মন। সেখানে তিনি চাষ করতে চান। তাইতো তিনি গ্রামকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে তাই তো স্বাভাবিক। গ্রামের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার দিকেই তাঁর নজর। কেননা তিনি তো জানতেন, ‘মাতৃভূমির যথার্থ স্বরূপ গ্রামের মধ্যেই, এইখানেই প্রাণের নিকেতন; লক্ষ্মী এইখানেই তাঁহায় আসন সন্ধান করেন।’  [সমবায়নীতি]

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভূমিসংলগ্ন লেখক, জন্মগত শ্রেণি অবস্থান উত্তরণ ঘটিয়ে জনমানুষের তথা সাধারণের সঙ্গেই যোগ ঘটিয়েছেন। কলকাতার টাউন হলে এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘চাষীকে আমরাই রক্ষা করিব, তাহার সন্তানদিগকে আমরাই শিক্ষা দিব, কৃষির উন্নতি আমরাই সাধন করিব, গ্রামের স্বাস্থ্য আমরাই বিধান করিব এবং সর্বপ্রকার মামলার হাত হইতে আমাদের জমিদার ও প্রজাদিগকে আমরাই বাঁচাইব। এ সম্বন্ধে রাজারা সাহায্য লইবার কল্পনাও যেন আমাদের মাথায় না আসে।’ ক্ষমতাকে অস্বীকার করার এমন সাহস আমরা রবীন্দ্রনাথে লক্ষ্য করি। তিনি রাজার বিরুদ্ধে দ্রোহ করছেন। ক্ষমতাসীনকে অস্বীকার করে নিজের অর্থাৎ প্রজার শক্তিকেই বড়ো করে তুলেছেন।

বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গানকে শক্তি করে লিখলেন, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল...’ বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করার অভূতপূর্ব আহবান। তিনি নিজে রাখীবন্ধনের প্রস্তাব করলেন। এখানেই থেমে থাকলো না, তিনি সবার সঙ্গে ‘রাখীবন্ধন’ অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য রাস্তায় নামলেন। সবার হাতেই পড়িয়ে ছিলেন রাখী, তিনি কোনো জাত-ধর্ম বিবেচনা করেন নি। নিন্মবর্গের হিন্দু আবার মুসলমানের হাতেও পড়িয়ে দিলেন রাখী। এখানেই তাঁর উদারতা। ১৯০৬ সালে বরিশালে কবি এলেন প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগ দিতে। শুধু প্রাদেশিক সম্মেলনই নয় এখানে সাহিত্য-সম্মেলনেরও আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ শাসকদের বাধায় প্রাদেশিক সম্মেলন পণ্ড হলে কবি কলকাতায় ফিরে গেলেন।

স্বদেশি আন্দোলনের চেতনায় তিনি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। এখানে তাঁর তাৎক্ষণিক কোনো উত্তেজনা ছিল না। বরং গভীর ভাবনাজাত হয়ে সংগ্রামে নেমেছিলেন। একই সময়ে উগ্রবাদী চিন্তা বিকশিত হচ্ছিল, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ স্থির। সুরাট অধিবেশন নিয়ে বিরক্ত কবি বন্ধু ও বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে লিখে পাঠালেন: ‘এবারকার কংগ্রেসের বঙ্গভঙ্গের কথা তো শুনিয়াছই- তাহার পর হইতে দুই পক্ষ পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করিতে দিনরাত নিযুক্ত রহিয়াছে। কিছুদিন হইতে গবর্মেন্টের হাড়ে বাতাস লাগিয়াছে- এখন আর সিডিশনের সময় নাই- যেটুকু উত্তাপ এতদিন আমাদের মধ্যে জমিয়েছিল- তাহা নিজেদের ঘরে আগুন দিতেই নিযুক্ত রহিয়াছে।’

এর দুই মাস পরে কবি পাবনায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্য দিতে আমন্ত্রণ পেলেন। ১৯০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সভাপতি হিসেবে তিনি বাংলায় বক্তব্য রাখলেন। কংগ্রেসের কোনো প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনিই প্রথম বাংলায় বক্তব্য রাখলেন। ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভাষাও তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র।  তিনি পাবনায় বললেন, ‘এদিকে দুঃখ যতই পাইতেছি সত্যের পরিচয়ও ততই নিবিড়তর সত্য হইয়া উঠিতেছে। যতই দুঃখ পাইতেছি আমাদের শক্তি গভীরতায় ও ব্যাপ্তিতে ততই বাড়িয়া চলিতেছে।’ এমনি করেই মুক্তি ও স্বাধীনতার চেতনায় তিনি জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন শ্রোতাদের। ভারতবর্ষের নানা জাতিকে এক সূত্রে বন্ধন করার তাগিদ অনুভব করেছেন। স্বতন্ত্রকে এক করে তোলাই রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ করে তুলেছে।

লেখক : চেয়ারম্যান, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়