ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মসলিন: বিলুপ্ত ঐশ্বর্যের উৎস সন্ধানে

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ১৭ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মসলিন: বিলুপ্ত ঐশ্বর্যের উৎস সন্ধানে

মসলিন প্রদর্শনী, আলোকচিত্র: সংগৃহীত

 

|| শিহাব শাহরিয়ার ||

এই অঞ্চল, ব-দ্বীপ ভৌগলিক বাংলাদেশ। নদীঘেরা বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার প্রাচীন ইতিহাস যেমন গৌরবময়, তেমনি এর লোকশিল্প ঐশ্বর্যমণ্ডিত। এক সময়ের বৃহত্তর ঢাকার বর্তমান নরসিংদী জেলার উয়ারী, বটেশ্বর গ্রাম দুটিতে মাটি খননের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের প্রায় আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সভ্যতার নিদর্শন-সংবলিত প্রমাণ মিলেছে। যুগে যুগে এই অঞ্চল শাসন করেছে নানা অঞ্চল বা দেশ থেকে আগত বিভিন্ন বর্ণ, ধর্ম ও গোত্রের শাসক। শোষিত এই ঐতিহ্যবাহী জাতি যেমন কখনো মাথা নত করে নি, তেমনি স্বকীয়তায় অর্থাৎ নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ, পেশা ও কৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে গেছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র সাহসী নারী চরিত্র প্রমীলা উচ্চারণ করেছেন: ‘আমি কি ডরাই সখী ভিখারী রাঘবে?’ বাঙালি শোষিত জাতি কিন্তু সাহসী। তাদের এই সাহসের স্বাক্ষর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, যা ১৯৫২ সালের রক্তসিঁড়ি পেরিয়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে স্বাধীন পতাকা ছিনিয়ে আনে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হয়। এর আগে মুসলিম মোগল শাসকরা ১৬১০ সালে ‘জাহাঙ্গীরনগর’ নাম দিয়ে এই ঢাকাকে রাজধানী করেছিলেন। তারা শুধু রাজধানীই করেন নি, ঢাকাকে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা অঞ্চলের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকেও গুরুত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। আমরা যদি নির্দিষ্ট করে বলতে চাই তা হলো- এই অঞ্চলের তাঁত-উৎপন্ন বস্ত্রশিল্পকে দারুণভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। বিশেষ করে শিল্পবিপ্লব-পূর্ব অন্ধকার ইউরোপের বণিকরা যখন দক্ষিণ এশিয়ার আলোকিত এই অঞ্চলে বাণিজ্যের তরী নোঙর করেন, তখন দারুণ গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে ওঠে বঙ্গোপসাগরবেষ্টিত সুজলা-সুফলা এই শ্যামল বাংলা। তারা মসলা-মিষ্টি থেকে শুরু করে সূক্ষ্ম তাঁতবস্ত্র এখান থেকে তাদের দেশে রপ্তানি করতে শুরু করেন। ইউরোপ ও এশিয়ার কোনো কোনো অঞ্চলের মতো বাংলাদেশে তৈরি হওয়া জামদানি ও ঢাকাই মসলিন ইউরোপ ও আরব বণিকরা ব্যাপকভাবে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি বাণিজ্য করেন। এই ঢাকাই জামদানি ও মসলিনের চাহিদা ও ব্যবহারের মূল কারণ ছিলো কারিগরদের নিখুঁত কারুকাজ ও মেধার মুন্সীয়ানা। সাধারণ কারিগরদের নিপুণ হাতে তৈরি হওয়া এই সূক্ষ্ম বস্ত্রশিল্প নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ থাকত। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘A Descriptive and Historical Account of the Cotton Manufacture of Dacca, in Bengal’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থে ঢাকাই মসলিন নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে বলে পণ্ডিত ও গবেষকরা অভিমত দিয়েছেন। বিশেষ করে এই গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, ১৮৫১ সালে বিলেতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বখ্যাত একটি প্রদর্শনী। বিশেষ এই প্রদর্শনীতে স্থান পায় ঢাকাই মসলিন এবং তা বিলেতের বিভিন্ন পত্রিকায় ব্যাপক প্রশংসা পায়।
দুঃখের বিষয়, যে শিল্পটি তার নান্দনিকতা দিয়ে দুনিয়ায় আলোড়ন তুললো, খ্যাতি এনে দিলো, বাংলার সেই ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন নিয়ে তথ্যপূর্ণ কোনো পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ এখনও রচিত হয় নি। খণ্ড খণ্ড গবেষণা, রচনা ও রিপোর্টের মাধ্যমে মসলিন ও জামদানির ভাসা ভাসা তথ্য পাওয়া যায়। বাঙালির ঐতিহ্য ও ইতিহাস সংরক্ষণের প্রয়োজনে গৌরবময় শিল্প মসলিনের উৎস সন্ধান করা দরকার। দরকার হারিয়ে যাওয়া মসলিনকে পুনরুদ্ধার করা, পুনরুজ্জীবিত করা এবং এর খ্যাতি পৃথিবীময় পুনরায় ছড়িয়ে দেয়া। নয় কি?

গবেষক মুনতাসীর মামুন গর্বের সঙ্গে বলেছেন, ‘যদি বলি তাজমহল, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তোমার মনে হবে আগ্রার কথা। যদি বলি হোয়াইট হাউস, তাহলে ওয়াশিংটনের কথা। প্যারিসকে মনে করিয়ে দেয় আইফেল টাওয়ার। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি শহরে এ ধরনের কিছু না কিছু আছে বা ছিল যা ঐ শহরের প্রতীক। যেমন, যদি বলি মসলিন তাহলে মনে হয় ঢাকার কথা। অথচ সেই মসলিন বিলুপ্ত হয়েছে আজ থেকে দু’তিনশ বছর আগে। কিন্তু মসলিন এতটাই বিখ্যাত ছিল যে পৃথিবীজুড়ে এখনও শব্দটি উচ্চারণ করলে মনে হয় ঢাকার কথা।’
মসলিনের মূল উৎপাদন স্থলগুলো ছিল বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চল। ঢাকার পূর্বে হিন্দু শাসকদের সুবর্ণগ্রাম এবং মুসলমান শাসকদের সোনারগাঁয় মসলিন তৈরির কারিগররা বাস করতেন এবং তাঁতের মাধ্যমে জামদানি ও মসলিনসহ সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরি করতেন। ঢাকার পশ্চিমে বংশী নদীর তীরাঞ্চল ধামরাই, তৎকালীন কাপাসিয়া তিতাবাদি এবং বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র নদ উপত্যকাঞ্চল বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার জঙ্গলবাড়ি ও বাজিতপুর এলাকায় মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল। এসব এলাকার সমভূমিতে মসলিন তৈরির উৎকৃষ্ট তুলা অর্থাৎ বিশেষ শ্রেণির কার্পাস তুলার চাষ হতো এবং প্রায় সাতশ ঘর তাঁতি ছিলো বলে বিদেশি বিভিন্ন পর্যটক, বণিক-ব্যবসায়ী এবং দেশি-বিদেশি গবেষক ও পণ্ডিতদের গবেষণা, তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়। তবে ঢাকার প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই কম-বেশি তাঁত ছিল।

‘মসলিন’ শব্দের উৎপত্তি কীভাবে হলো? ড. আবদুল করিম বলেছেন, মসলিন শব্দের মূল নির্ণয় করা কঠিন। মসলিন ফার্সী শব্দ নয়, সংস্কৃত বা বাংলা তো নয়-ই। তিনি হেনরী ইউল এবং এ. সি. বার্নেলের উদ্ধৃতি দিয়ে আরো বলেছেন, মসলিন ‘মসুল’ থেকে উদ্ভূত। তাদের মতে ইরাকের মসুলে প্রাচীন যুগে উৎকৃষ্ট সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরি হতো, যাকে ইউরোপিয় বণিক বা ব্যবসায়ীরা মসুলি বা মসুলিন বা মসলিন বলতেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় তৈরি সূক্ষ্ম সুতির বস্ত্র বা মসৃণ বস্ত্রকেও তারা ‘মসলিন’ নামে অভিহিত করেন। পাশাপাশি ভারতের গোলকুণ্ডা ও গুজরাট অঞ্চলে যে সূক্ষ্ম বস্ত্র উৎপন্ন হতো সেগুলোকেও ‘মসলিন’ বলেছেন ইংরেজরা। বাংলাদেশের গবেষকগণ  ইউরোপিয়দের দেয়া ‘মসুল’ থেকে মসলিন এসেছে, অর্থাৎ ইউল ও বার্নেলের অভিমতকেই মেনে নিয়েছেন।
তাহলে প্রশ্ন জাগে ‘মসুল’ কোন ভাষার শব্দ? আমরা কি একটু ভাবতে পারি যে, বাংলা ‘মসৃণ’ থেকে মসলিন আসতে পারে? কারণ, সূক্ষ্ম মানেই মসৃণ।
ঢাকাই মসলিন কত পুরোনো? ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দিতে বাংলাদেশ থেকে যে প্রচুর পরিমাণ ‘সূক্ষ্ম বস্ত্র’ বিদেশে রপ্তানি হয়েছে তারও অনেক সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, এ সূক্ষ্ম বস্ত্রই যে মসলিন ও জামদানি তাতে সন্দেহ নেই।

‘Periplus of the Erythrean Sea’ গ্রন্থেও ঢাকাই মসলিন বস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্লিনির এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এক সময় প্রাচীন রোমের মেয়েরা ঢাকার তৈরি মসলিনের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। রোম থেকে মিশর, মিশর থেকে পারস্য, ব্যাবিলনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। জামদানি ও মসলিনের পরবর্তী সাক্ষ্য বহন করে আমাদের প্রাচীন সাহিত্য ‘চর্যাগীতি’র বিভিন্ন পঙ্‌ক্তি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে প্রায় দুই হাজার বছর আগে বঙ্গের বা পূর্ব বঙ্গের সূক্ষ্ম সুতি বস্ত্রের উল্লেখ দেখা যায়। গবেষকরা জানিয়েছেন, ত্রয়োদশ শতকে মার্কো পোলো বাংলার ‘কার্পাস’ বস্ত্রের প্রশংসা করেছেন। চতুর্দশ শতকে মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা ও ষোড়শ শতকে চীনা পরিব্রাজকরাও ঢাকার সোনারগাঁয়ে উৎপাদিত ছয় প্রকার সূক্ষ্ম বস্ত্রের উল্লেখ করেছেন এবং সপ্তদশ শতকে ফরাসি রাষ্ট্রদূত ব্রুসি পরাসি সম্রাট পঞ্চদশ লুইয়ের প্রেয়সী মাদাম দ্য পম্পোদর-এর জন্য উপহার হিসেবে বাংলা থেকে এক ডজন মসলিনের কামিজ ফরাসিদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। কামিজগুলোর প্রত্যেকটি এক একটি নস্যি কৌটার মধ্যে ভরা ছিলো।

মোটামুটিভাবে মোগল আমলেই মসলিন শিল্প পূর্ণ বিকাশ লাভ করে এবং এর মূলে ছিলেন সম্রাজ্ঞী নূরজাহান। তিনি বাংলার এ সূক্ষ্ম বস্ত্রটিকে মোগল হেরেমের জন্য নির্ধারিত করেছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ ও সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় দিন দিন উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে যায়।
জেমস্ টেলরকে উদ্ধৃতি করে বলা যায় যে, যিনি সে সময় ঢাকায় অবস্থান করেছেন এবং ঢাকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে লিখেছিলেন ‘A Sketch of the Topography and Statistics of Dacca.’  গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৪০ সালে। এই গ্রন্থের ‘Weaving in Dacca’ প্র্রবন্ধে তিনি বলেছেন, খ্রিষ্টাব্দের শুরু থেকেই ইউরোপের মানুষ এই কাপড় সম্পর্কে জানত।
ড. আবদুল করিম বলেছেন, ‘প্রাক-মুসলমান আমলে ঢাকার সূক্ষ্ম বস্ত্রের নাম কি ছিল সঠিক বলা যায় না। মুসলমান আমলে রং, আকার এবং বুনন প্রণালীর ভিন্নতা হেতু ঢাকায় প্রস্তুত সুতি কাপড় বিভিন্ন নামে অভিহিত ছিল। যেমন আব-ই-রওয়ান, শবনম, জামদানি ইত্যাদি। এদের মধ্যে সূক্ষ্মতম বস্ত্র, যা মোগল সম্রাটের জন্য নির্দিষ্ট করা ছিল তার নাম ‘মলবুস খাস’ (পরে একে ‘মলমল খাস’ নাম দেয়া হয়েছিল)। কিন্তু ঢাকার সুতি বস্ত্র এক নামে পরিচিত ছিল কিনা আমাদের জানা নেই।’

লেডি ইন মসলিন, ঢাকা, ১৭৮৯। ফ্রান্সিস রেনাল্ডি। সূত্র: উইকিপিডিয়া


গবেষক যতীন্দ্রমোহন রায় বলেছেন, ‘ঢাকার বস্ত্রশিল্প অতি প্রাচীনকাল হইতেই জগতের সর্বত্র প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছিল। চীনের মৃন্ময় বাসন এবং দামেস্কের ফলক ব্যতীত প্রাচ্য জগতের অন্য কোনও শিল্পই ঢাকার বস্ত্রশিল্প অপেক্ষা অধিকতর প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারে নাই। প্রাচীন যুগে বাবেলোনিয়া এবং এসেরিয়া প্রদেশ যে সময়ে সভ্যতার চরম সীমায় পদার্পণ করিয়াছিল, সেই সময়েও ঢাকার মসলিন জগতের নিকটে সমাদরের পুষ্পাঞ্জলি লাভে সমর্থ হইয়াছিল; একথা মি বার্ডউড প্রমুখ মনস্বীগণ একবাক্যে স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। অধুনা বাইবেলের যে সমুদয় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা টীকা-টিপ্পনী সংযোগে প্রকাশিত হইয়াছে তৎপাঠে অবগত হওয়া যায় যে, বাইবেলের কোনও কোনও স্থানে অতি সূক্ষ্ম মসলিনের ন্যায় একপ্রকার বস্ত্রের উল্লেখ আছে। উহা যে ভারতীয় মসলিন হইতে অভিন্ন তদ্বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই।’

বিশিষ্ট পণ্ডিত কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘এ দেশের যে সকল শিল্প লোপ পাইয়াছে তাহার মধ্যে ঢাকার মসলিনের স্মৃতি সর্বাপেক্ষা আধুনিক। অতি অল্পদিন- পঞ্চাশ বৎসর- পূর্বেও এই বয়ন শিল্পের প্রকৃষ্ট উদাহরণ এদেশের শিল্পীকে গৌরবান্বিত ও বিদেশীয়কে হতাশ করিত। অতি আধুনিক যুগে কলনির্মিত স্বল্পমূল্য অনুকরণের ফলে ইহার ধ্বংসপ্রাপ্তি ঘটিয়াছে। ইহার ইতিহাস অতি প্রাচীন। সুদূর রোমে ইহা Ventus textilis ev Nebula নামে আদৃত ও বহুমূল্যে বিক্রীত হইত। তাহারও বহু পূর্বে এদেশের প্রাচীন পুস্তকে উহার উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন কার্পাস বস্ত্রসকল মধ্যে ইহা সর্বশ্রেষ্ঠ ও অতুলনীয় বলিয়া পরিগণিত হইত।’

রাজেন্দ্রলাল মিত্র বলেছেন, ‘‘ঢাকাই বস্ত্র সকলেরই প্রিয়; হিন্দুদিগের শিল্পকর্ম নৈপুণ্য বিষয়ে এই অনুপম বস্ত্র এক মহতী ধ্বজা। পৃথিবীর সর্বত্র সকল পারদর্শী তন্তুবায়েরা ইহার তুল্য বস্ত্রবয়নে বহুকালাবধি যত্নশীল আছে; কিন্তু অস্মদ্দেশীয় এই জয় পতাকার গর্ব খর্ব করিতে অদ্যাপি কেহই সক্ষম হয় নাই। ঢাকাই বস্ত্র যৎপরোনাস্তি সামান্য যন্ত্রে প্রস্তুত হয়, কিন্তু এই সামান্য যন্ত্র ও তদ্ব্যবহারকৃতদের কি আশ্চর্য ক্ষমতা, যে বিলাতের অদ্বিতীয় শিল্পকুশল ব্যক্তিরা বহুমূল্য বাষ্পীয় যন্ত্রসহকারেও তাদৃশ্য সূক্ষ্মবস্ত্র প্রস্তুতকরণে পরাস্ত হইয়াছে। দুই সহস্র বৎসর পূর্বে এই অনুপম বস্ত্র প্রাচীন রোমরাজ্যে প্রসিদ্ধ হইয়া হিন্দুদিগের শিল্প-সাফল্যের অনির্বচনীয় প্রমাণস্বরূপ গণ্য ছিল; এবং অধুনা ইংল্যান্ডদেশের তন্তুবায়দিগের তিরস্কারস্বরূপ জনসমাজে বিখ্যাত আছে। জনৈক য়ুরোপীয় শিল্পকর ইহার প্রশংসায় কহিয়াছিলেন যে, ‘বোধ হয় ইহা বিদ্যাধরী ও অপ্সরারা বপন করিয়াছে; এতাদৃশ সূক্ষ্মবস্ত্র মনুষ্যের স্থূল হস্তে সম্ভব নহে।’ ফলত এই প্রশংসা অপ্রযোজ্য নহে।’’

মসলিন যে, সূক্ষ্ম বস্ত্র ছিল তার কিছু মন্তব্য এখানে তুলে ধরতে চাই, যেগুলো বিদেশি পর্যটক, দূত এবং বিভিন্ন সূত্রে আমরা জানতে পারি। যেমন: নবম শতাব্দিতে আরব পরিব্রাজক সুলাইমান ভারত ভ্রমণকালে পূর্ববঙ্গের সূক্ষ্ম বুননের মসলিনের উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘এখানকার সুতিবস্ত্র এতো মিহি যে একখণ্ড পোষাক ক্ষুদ্র একটি আংটির মধ্যে দিয়ে অনায়াসে পার করানো যায়।
পারস্য রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আলী বেগ ভারত থেকে ফিরে গিয়ে পারস্য সম্রাটকে একটি নারকেলের খোল উপহার দেন। খোলের আকার ছিল উট পাখির ডিমের মতো, তার মুখ ছিল হীরা-পান্না ও মণিমুক্তাখচিত। পারস্য সম্রাট সেটি খুলে দেখলেন, এর মধ্যে রয়েছে ৬০ ফুট লম্বা একটি ঢাকাই মসলিনের পাগড়ী।
একদিন সম্রাট আওরঙ্গজেবের সামনে জেবুন্নিসা উপস্থিত হলে সম্রাট বে-আব্রু পোষাকে তার সামনে আসায় কন্যাকে ভর্ৎসনা করেছিলেন। এর উত্তরে জেবুন্নিসা বলেছিলেন, জাঁহাপনা তাও তো আমি সাত ফের্তা বাংলার মসলিন পরে আছি।
মসলিনের সুতা এতো সূক্ষ্ম হতো যে, এক পাউন্ড মসলিন সুতার দৈর্ঘ্য ছিল ২৫০ মাইল।
নবাব আলীবর্দী খাঁর সময়ে একজন তাঁতি বিশেষ শাস্তি পেয়েছিল এবং ঢাকা থেকে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তার অপরাধ ছিলো ‘আব্রুয়ান’ নামক একখণ্ড মসলিন সে ঘাসের উপর বিছিয়ে রেখেছিল। এবং গরু তা খেয়ে ফেলে।
মসলিন নিয়ে এমন অসংখ্য গল্প, প্রবাদ ও মন্তব্য আছে যা আসলে এই সূক্ষ্ম শিল্পের গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এছাড়াও বিভিন্ন দেশের পর্যটক, গবেষক, পণ্ডিত, বণিক, ব্যবসায়ী বাংলা অঞ্চলের মসলিনের কাপড়, সুতা তৈরি, কারিগর কিংবা ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী ফুটি কার্পাস নিয়েও নানা মন্তব্য, তথ্য ও গল্প বুনেছেন।

ঢাকা জেলার তাঁত শিল্প উনিশ শতকের প্রথমার্ধে জেমস্ টেলর দেখেছেন। যদিও মসলিন তখন বিলুপ্তির পথে। তার মতে ঢাকা জেলার প্রত্যেক গ্রামেই কম-বেশি তাঁতের কাজ চলত, কিন্তু উৎকৃষ্ট ধরনের মসলিন তৈরির জন্য কয়েকটি স্থান বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিলো। এগুলি হচ্ছে ঢাকা, সোনারগাঁও, ধামরাই, তিতাবাদি, জঙ্গলবাড়ি, বাজিতপুর। এদের মধ্যে প্রথম চারটি স্থান বর্তমান ঢাকা জেলাতেই অবস্থিত, বাকি দুটি বর্তমান ময়মনসিংহ জেলায়।
উপরোক্ত স্থানগুলির মসলিন তৈরিতে প্রসিদ্ধি লাভ করার দুটি কারণ দেয়া যায়। প্রথমত, এই স্থানগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান। দ্বিতীয়ত, ঢাকা এলাকায় উৎপন্ন এক বিশেষ শ্রেণির কার্পাস বা তুলা। তৃতীয় কারণটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ। উপরোক্ত স্থানগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি বহুদিন ধরে দেশের শাসন কেন্দ্র বা রাজধানী ছিলো। ঢাকার কথা বলাবাহুল্য; সোনারগাঁও সম্বন্ধেও আগে বলা হয়েছে। ধামরাইও কোনো এক সময় কোনো হিন্দু রাজার রাজধানী ছিলো বলে জানা যায়। জঙ্গলবাড়ি ঈশা খান মসনদ-ই-আলা ও তার পরিবারের নামের সাথে জড়িত। এবং এটা ঠিক যে, মসলিন শিল্প রাজা বাদশাহ ও আমীর ওমরাহদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এতো উন্নতি অর্জন করতে পারত না এবং প্রকৃতপক্ষে প্রধানত মোগল বাদশাহদের পৃষ্ঠপোষণ লাভে বঞ্চিত হওয়াতেই, মসলিন শিল্প বিলুপ্ত হয়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়