ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

লোকজ ছড়া: টুকরো জগতের ছবি

আনজীর লিটন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ২৭ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লোকজ ছড়া: টুকরো জগতের ছবি

অলঙ্করণ : শতাব্দী জাহিদ

 

|| আনজীর লিটন ||
পৃথিবীর সব মা সন্তানের কপালে চাঁদের টিপ এঁকে দিতে চাঁদমামাকে ডাকেন। বাংলা ভাষায় যেমন আছে তেমনি ইংরেজি সাহিত্যেও আছে এই আমন্ত্রণ। যেমন আমরা বাংলায় বলি-

‘আয় আয় চাঁদমামা
টিপ দিয়ে যা
চাঁদের কপালে চাঁদ
টিপ দিয়ে যা।’

আবার ইংরেজি সাহিত্যে বলা হয়-

‘O mother, Mom Come up quickly
Bring Milk and rice in a golden cup
And put it in darlings mouth.’

অনুভূতির প্রকাশভঙ্গি যেমনই হোক না কেনো, যে ভাষাতেই হোক না কেনো সৃষ্টির উৎস এক; সেটা হচ্ছে অনুভূতি। ছড়া পাঠকের অনুভূতিতে নাড়া দেয়। ছড়ার একটা আলাদা শক্তি আছে। এই শক্তি দিয়ে ছড়া শুধু শিশুকে ভোলায় না, বড়দেরকেও ভাবায়। শুধু ঘুম পাড়ায় না, ছড়া ঘুম থেকে জাগায়। ছড়া সময়ের ছবি আঁকে। ছন্দোবদ্ধো শব্দবিন্যাসে ছড়া কাটুস-কুটুস খেলা করে ছন্দের সঙ্গে, অন্ত্যমিলের সঙ্গে, অনুপ্রাসের সঙ্গে। খেলা করতে করতে ছড়া মন জয় করে পাঠকের। এসব ছড়ার সৃষ্টি কথন রীতিতেই হোক কিংবা লিখিত রীতিতেই হোক, সাহিত্যের আদিরূপ হচ্ছে ছড়া। লোকজ ধারার মধ্য দিয়ে ছড়া তার পথ খুঁজে নিয়েছে। স্পর্শ করেছে আধুনিকতা। ভাষার বদল ঘটেছে। চিন্তার বদল ঘটেছে। আঙ্গিকের বদল ঘটেছে। কিন্তু বদলে যায়নি ছড়ার বার্তা। লোকজ ছড়া মানে টুকরো টুকরো জগতের ছবি। যেমন-

‘ও পারে তে কালো রঙ-
বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম।
এপারেতে লঙ্কা গাছটি
রাঙা টুকটুক করে,
গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করে।’

কিংবা ছড়ার কল্পনা জগতে কখনো কখনো রচিত হয়েছে এমনই দৃশ্য-


মাকে দিলাম আমন দোলা
বাপকে দিলাম নীল ঘোড়া


হলুদ বনের কলুদ ফুল
মামার নামে টগর ফুল


নেবুর পাতায় করমচা
হেই বৃষ্টি ধরে যা।


এক হাত বোলতা বারো হাত শিং
উড়ে যায় বোলতা ধা তিং তিং
                                    [সংগৃহীত]

গ্রামবাংলার কথন রীতিতে ছড়ার যে আদি রূপ তৈরি হয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করে বাংলা ছড়া প্রবহমান। বাংলা লৌকিক ছড়াগুলো লোকসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বলা হয়ে থাকে, এসব ছড়া সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবন-যাপন, আচার-রীতি এবং জীবন দর্শনের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছে মানুষের অন্তরে-অন্তরে। এক্ষেত্রে খনাকে বলা হয় কিংবদন্তি। কৃষি ও কৃষকের জীবন দর্শনের ছন্দোময় বাণী আজও বাংলার কৃষক লালন করে আসছে। কারণ খনা যখন বলে-

‘ধন্য রাজার পূণ্যি দেশ
যদি বর্ষে মাঘের শেষ।’

কিংবা যদি বলে-
‘ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন,
শীঘ্র হবে বৃষ্টি যেন।’

এসব বাণী আজও আমাদের প্রেরণা দেয়। সংস্কৃতির আলো বিকশিত হয়ে আসছে মানব জীবনের ঐতিহ্যপূর্ণ ধারাসমূহের মধ্য দিয়ে। বাংলা নববর্ষ সেই ঐতিহ্যপূর্ণ ধারাসমূহের উজ্জ্বল নিবেদন। যার সূচনাকাল বৈশাখ। বৈশাখ আমাদের লোকজধারার সংস্কৃতির শুধু পরিচয় বহন করে না, বৈশাখ বাঙালির সাহিত্যসৃষ্টির এক অপরূপ প্রেরণাদাতা। তাই তো আধুনিক ছড়াকাররা লেখেন-


ভোর থেকে শুরু হলো বৈশাখী মেলা
হাসি-গানে কেটে যাবে আজ সারাবেলা।
                                 [লুৎফর রহমান রিটন]

২.
বোশেখ মানে বাংলা বছর
নতুন দিনের আশা
বোশেখ মানে মেলায় যাওয়া
দেশকে ভালোবাসা।
                                [আমীরুল ইসলাম]

 

লৌকিক ছড়াপাঠকে রবীন্দ্রনাথ শৈশবের মেঘদূত হিসেবেই চিত্রিত করেছেন। আর এই বোধটাকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন শিশুদের মাঝে। ‘মেয়েলি ছড়া’ এবং ‘ছেলেভুলানো ছড়া’ নামে ছড়াকে দুই ভাগে চিহ্নিত করে রবীন্দ্রনাথ ছড়ার বিষয় হিসেবে তুলে এনেছেন জগত সংসারের নানা বিষয়। ১২৯২ বঙ্গাব্দে ‘বালক’ পত্রিকায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ ছড়াটি রবীন্দ্রনাথের হাতে আধুনিক চেহারা পেয়েছে। এই ছড়াটি রবীন্দ্রনাথ নিজে সংগ্রহ করেন এবং সে বিষয়ে অনবদ্য ভাষ্য রচনা করেন। ছড়াটি হলো-

‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।
শিবঠাকুরের বিয়ে হ’ল তিন কন্যা দান ॥
এক কন্যে রাঁধেন বাড়েন, এক কন্যে খান।
এক কন্যে না খেয়ে বাপের বাড়ি যান ॥’

উল্লেখিত ছড়াটির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথ বলেন : ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান। এই ছড়াটি বাল্যকালে আমার নিকট মোহমন্ত্রের মতো ছিল এবং সেই মোহ এখনো আমি ভুলিতে পারি নাই। আমি আমার সেই মনের মুগ্ধ অবস্থা স্মরণ করিয়া না দেখিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারিব না ছড়ার মাধুর্য এবং উপযোগিতা কী। বুঝিতে পারিব না, কেন এত মহাকাব্য এবং খণ্ডকাব্য, এত তত্ত্বকণা এবং নীতিপ্রচার মানবের এত প্রাণপণ প্রযত্ন, এত গলদধর্ম ব্যায়াম প্রতিদিন ব্যর্থ এবং বিস্মৃত হইতেছে, অথচ এই-সকল অসংগত অর্থহীন যদৃচ্ছাকৃত শ্লোকগুলি লোকস্মৃতিতে চিরকাল প্রবাহিত হইয়া আসিতেছে।’

একজন কবি যেমন ফিরে যান তার নিজস্ব শেকড়ে, মাটির বন্ধনে, যেখান থেকে তুলে নেন ঐতিহ্যের গল্প, ঠিক একজন ছড়াকারও তার সময়ের কাছে, সমাজের মানুষের কাছে, ঋণী হয়ে বারবার ফিরে যান তার নিজস্ব শেকড়ে, সেই মাটির বন্ধনে। রবীন্দ্রনাথ সেই সূচনাটি করে দিয়েছেন লোকজচিত্রকল্পের মাধ্যমে। যার প্রকাশ ঘটিয়েছেন ছড়ায়।

১.       
নেই বা হলেম যেমন তোমার
                  অম্বিকে গোসাঁই।
আমি তো, মা, চাই নে হতে
                  পণ্ডিত মশাই।

২.       
খেলা-ভোলার দিন, মা, আমার
                  আসে মাঝে মাঝে।
সেদিন আমার মনের ভিতর
                  কেমনতরো বাজে।
শীতের বেলায় দুই প্রহরে
                    দূরে কাদের ছাদের ’পরে
ছোট্ট মেয়ে রোদ্দুরে দেয়
                   বেগুনি রঙের শাড়ি।
চেয়ে চেয়ে চুপ করে রই,
                   তেপান্তরের পার বুঝি ঐ
মনে ভাবি ঐখানেতেই
                    আছে রাজার বাড়ি।

৩.       
কয় না কিছুই, চুপটি করে
                কেবল মাথা নাড়ে।
                সিঙ্গিমামা কোথা থেকে
 হঠাৎ কখন এসে ডেকে
               কে জানে, মা, হালুম করে
               পড়ল যে কার ঘাড়ে।
বল্ দেখি তুই কেমন করে
               ফিরে পেলেম মাকে?
 কানে কানে বলব তোরে?-
               যেমনি স্বপন ভেঙে গেল
                সিঙ্গিমামার ডাকে।

৪.
যখন যেমন মনে করি
তাই হতে পাই যদি
আমি তবে একখনি হই
ইচ্ছামতী নদী।
                       [শিশু ভোলানাথ]

৫.
বর এসেছে বীরের ছাঁদে,
বিয়ের লগ্ন আটপা।
পিতল-আঁটা লাঠি কাঁধে,
গালেতে গালপাট্টা
শ্যালীর সঙ্গে ক্রমে ক্রমে
আলাপ যখন উঠল জমে,
রায়বেঁশে নাচ নাচের ঝোঁকে
মাথায় মারলে গাঁট্টা।
শ্বশুর কাঁদে মেয়ের শোকে,
বর হেসে কয়- ‘ঠাট্টা।’
                        [খাপছাড়া]

৬.
আতর বিচি নিজে পুঁতে পাব তাহার ফল,
দেখব বলে ছিল মনে বিষম কৌতূহল।
তখন আমার বয়স ছিল নয়,
অবাক লাগত কিছুর থেকে কেন কিছুই হয়।
                          [ছড়ার ছবি]

 

উদ্ধৃত উদাহরণ থেকে রবীন্দ্রনাথের ছড়া সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা গড়ে তোলা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শৈশবের বা ছেলেবেলার টুকরো টুকরো স্মৃতি থেকেই ছড়া লিখেছেন, যা লৌকিক ছড়ার মতোই এক একটি ‘টুকরো জগতের ছবি’। শৈশবের বা ছেলেবেলার স্মৃতিই রবীন্দ্রনাথের ছড়ার মৌল উৎস ও প্রেরণা। বলা চলে, লৌকিক ছড়া থেকেই নিজের ছড়া লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গবেষকরা লোকজ ছড়াকে বিশেষ মর্যাদায় সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাঁরা বলেন, লোকজ ছড়ার মধ্যে সামাজিক ইতিহাস আছে, আছে অতীতের দৃশ্যপট এবং ভৌগলিক অবস্থান নির্ণয় করে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়