ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বৈশাখী বাণিজ্যে পান্তা-ইলিশ সংস্কৃতি

আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ১৪ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বৈশাখী বাণিজ্যে পান্তা-ইলিশ সংস্কৃতি

আরিফ সাওন : বৈশাখ আসলেই বেড়ে যায় ইলিশের দাম। তা অন্যান্য সময়ের চেয়ে দুই থেকে তিন, এমন কি চার গুণ। কেননা পয়লা বৈশাখে অনেকেই সকালে পান্তা-ইলিশ রাখেন খাবারের মেনুতে। বিশেষ করে উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারে এটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে গেছে। যদিও এর সঙ্গে বাংলা সংস্কৃতির আদৌ কোনো যোগসূত্র আছে বলে জানা নেই। পয়লা বৈশাখে সকালের নাস্তায় মেনু পান্তা-ইলিশ খাওয়ার এই রেওয়াজ চোখে পড়ে শহরে। গ্রামের মানুষ তেমন একটা সকালের খাবারে পান্তা-ইলিশ রাখেন না।

পয়লা বৈশাখে পান্তা ইলিশের প্রচলন সম্পর্কে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সেলিম খান বলেন, এর প্রচলন শুরু হয়েছে ১৯৮৩ সালের দিকে। উদ্যোগটা নেন জনকন্ঠের প্রয়াত সাংবাদিক বোরহান আহমেদ। তিনি বলেন, বৈশাখে আরেকটি আনন্দ অনুষঙ্গ যোগের উদ্দেশ্যে বোরহান ভাই পান্তা ইলিশের উদ্যোগ নেন। বোরহান ভাইয়ের উদ্দেশ্য খুবই সৎ ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে বোরহান ভাইয়ের সেই আনন্দ অনুষঙ্গকে অন্যরা ব্যবসায় রূপান্তরিত করে। সেই ব্যবসাটা আর রোধ করা যায় নি। এখন চলেছে রমরমা ব্যবসা।

তখনকার সময়ে ইলিশের এতো চড়া দাম ছিলো না। এখন বৈশাখকে ঘিরে ইলিশের ইলিশের দাম বেড়ে যায়। ফলে মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতায় বাইরে চলে যায়। তিন মন ধান বিক্রি করে যদি এক কেজি ইলিশ কেনা লাগে তাহলে মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষ কিভাবে কিনে খাবেন, বলেন এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

সেলিম খান বলেন, শুধুই কি ইলিশের দাম বাড়ে? না। পোশাকেরও দাম বাড়ে। আগে নতুন পোশাক পরার জন্য গুরুত্ব পেতো ঈদ। আর এখন বৈশাখও পোশাকের ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব পাচ্ছে। এসবের পেছনে কাজ করছে কর্পোরেট কালচার। বৈশাখ উপলেক্ষ্য তারা অনেক বিনিয়োগ করে থাকেন। মূলত এসব এখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এর ফলে সবার স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ কিংবা সবার আনন্দের জায়গা কমে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, সম্রাট আকবর তার খাজনা আদায়ের জন্য বৈশাখের প্রচলন করেছিলেন। একটা সময়ে বৈশাখ হয়ে যায় আমাদের এই বঙ্গের বাঙালির কালচার। বাঙালির কালচার বলতে বাঙালি মুসলমান আছে, হিন্দু আছে, বৌদ্ধ আছে- সবারই কালচার এটা। আগে দেখেছি এখানে সবাই আমরা অংশগ্রহণ করতাম। সিরাজগঞ্জ আমাদের তো হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। স্বাভাবিকভাবে হিন্দুরা ঢাক, ঢোল, চরকপুজা, চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখের সাথে জড়িয়ে যায়। আর আমাদের ছিল হালখাতা। 

পয়লা বৈশাখে দেখা যায়, রাজধানী বিভিন্ন হোটেলে পান্তা ইলিশের আয়োজন করা হয়। এক প্লেট পান্তা আর এক পিস ইলিশ মাছ পাঁচ হাজার টাকায়ও বিক্রি হয়। এটাই ধীরে ধীরে ধনাঢ্যদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।

আরটিভির ডেপুটি সিএনই রাজীব খান বলেন, এখন যেমন ইলিশের একটা প্রচলন দেখছি। আগে এমন প্রচলন ছিলো না। আমাদের ছোট বেলায় পর্যাপ্ত ইলিশ ছিল। আমাদের খাবাবের তালিকায় প্রতিদিন ইলিশ থাকতো। এখন যেমন রকমারি, সরষে ইলিশ, ভাজা ইলিশ- এটা ছিলো না।

তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়ি ফরিদুপুরে। আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। সন্ধ্যায় ফেরার পথে বাবা বাজার করে নিয়ে আসতেন। বাজার মানে আমরা যেহেতু পদ্মা পাড়ের মানুষ, ইলিশ থাকতোই। রাতে মা কেটে কুটে জাল দিয়ে রাখতেন। সকালে আমরা সেই ইলিশ পান্তা ভাতে খেতাম। বলতে গেলে এমন প্রায়দিনই হতো। বৈশাখ উপলক্ষে কিন্তু না বা লোক দেখানো ইলিশ খাওয়া না। এখনকার পয়লা বৈশাখে এই লোক দেখানো ইলিশ খাওয়ায় সেই জাল দেওয়া ইলিশের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না।

ষাটের দশকে পয়লা বৈশাখে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যুক্ত করে ছায়ানট। পরে এর পরিসর বাড়তে থাকে। অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। 

রাজীব খান বলেন, ‘ঢাকায় অনেক বড় পরিসরে বৈশাখ উদযাপন হয়। কিন্তু গ্রামগঞ্জে আগে যে আন্তরিকতা দেখেছি ঢাকায় তেমন নেই। এখানে বৈশাখ উদযাপনের পরিসর যত বড়, আন্তরিকতার পরিসর ততো ছোট। এখন যা হয়, তা হলো লোক দেখানো। কে কতোটা সাজতে পারে।

বর্তমানে বৈশাখের সঙ্গে ইলিশের সংযোগ এমনভাবে ঘটানো হয়েছে যে, মনে হয় পান্তা-ইলিশ ছাড়া বৈশাখ পালন হবে না। আর এর প্রভাব পড়ে আর্থ-সামজিক পরিমণ্ডলে। বৈশাখকে কেন্দ্র করে এ সময় ডিমসহ একটি মা ইলিশের নিধনে নষ্ট হচ্ছে অনাগত লাখ লাখ ইলিশ। তাই নববর্ষে ইলিশ মাছ খাওয়া কতটা জরুরি? এ প্রশ্ন তুলছেন এখন অনেকে।

এখন ইলিশের প্রজনন মৌসুম হওয়ায় পয়লা বৈশাখে ইলিশ বর্জন করে মাছ বাঁচানোর আহ্বান জানাচ্ছেন সচেতন মহল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেশবাসীকে পয়লা বৈশাখে ইলিশ না খাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আপনারা ইলিশ খাবেন না, ইলিশ ধরবেন না। পয়লা বৈশাখের খাদ্য তালিকায় খিচুড়ি, সবজি, মরিচ ভাজা, ডিম ভাজা ও বেগুন ভাজা রাখার কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।

বস্তুত: এখন যে দামে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে তা মূলতঃ উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত ছাড়া কেউ কিনতে পারছেন না। ইলিশ মাছকে সারাবছর সব শ্রেণির মানুষের কাছে সহজলভ্য করতে চাইলে বৈশাখে ইলিশ খাওয়া বন্ধ করতে হবে আমাদের।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ১৪ এপ্রিল ২০১৯/সাওন/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়