ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অমর মিত্রের গল্প: ভ্রমরগড় কুসুমগড়

অমর মিত্র || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫২, ১৭ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অমর মিত্রের গল্প: ভ্রমরগড় কুসুমগড়

মানুষটির সঙ্গে আমার কোনোদিন দেখা হবে ভাবিনি। বলতে গেলে তাঁর সঙ্গে আমি কোনোদিন মুখোমুখি বসতে পারব, তা আমি ভাবিইনি। আমি সাধারণ কলমচি। সারাজীবন ধরে কলম পিষেছি কিন্তু তেমন কিছু করে উঠতে পারিনি। কবিতা লিখেছি, গল্প লিখেছি, তিনটি উপন্যাস লিখেছি, জেলার নানা পত্রিকায় লিখে লিখে চুল পাকিয়েছি। বহুদিন একটা কাজে লেগে থাকলে কিছু একটা হয়। এখন জেলার বাইরেও অল্প-বিস্তর আমার নাম কেউ কেউ জানে, যারা আমার বই ছাপে আমার টাকায় কিংবা কবিতা ছাপে দশ কপি পত্রিকা কিনে নেব এই বিশ্বাসে। কলকাতার পত্রিকাতে মাঝে মাঝে আমার লেখা ছাপা হয়। করতাম ইস্কুল মাস্টারি, অবসরে কয়েক লাখ টাকা পেয়েছি। সুদ ভালো পাই, পেনশন আছে। বাড়ি আছে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এখন আমি সর্বক্ষণ লিখি। লেখা ব্যতীত অন্য কাজ আর কী করব? বছরে একটি করে বই বের করি। সেই বই কলকাতার প্রকাশনী এখন ছাপে আমারই টাকায়। আমায় কে চেনে যে আমার বই তারা নিজের খরচে ছাপবে? এমন হয়, আমি দুই থেকে আড়াই শ কপি কিনে নিই। অসুবিধে কী? আমার ভিতরে লেখক হওয়ার তৃষ্ণা আছে। সেই তৃষ্ণা কম বয়স থেকে আমাকে পুড়িয়েই যাচ্ছে। এত লিখেও সেই সম্মান কই? এত বই, জেলার ভিতরেও তেমন কেউ চেনে কি?

আমি এই জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকি। তিনি থাকেন দক্ষিণ-পুবে, আমি উত্তর-পশ্চিমে। আমি লিখি, তিনি লেখেন না। তিনি পত্রিকার সম্পাদকও নন। কিন্তু তিনি এক সাহিত্যমেলা করছেন এবার। আসলে যে শহরে তিনি থাকেন সেই শহরের কবিরা তাঁর কাছে গিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সাহিত্যমেলার। বারবার ফিরিয়ে দিয়ে, এবার তিনি রাজি হয়েছেন। সেই মেলা হচ্ছে এবার। জেলার লেখকরাও আমন্ত্রিত। আমার সঙ্গে সুদেবের বহুদিনের আলাপ। সুদেব সেই কুসুমগড় সিটির কবি। ম্যাগাজিন করে। সুদেব এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা। এই জেলায় এমন সাহিত্যমেলা আগে কখনো হয়নি। কুসুমগড় সিটির জন্ম বছর চল্লিশ। ছোট একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতেই গ্রাম কুসুমগড় এবং তার আশপাশের অনেক গ্রাম মিলে এক শহর হয়ে গেছে। ইস্পাত কারখানা, সার কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, আর এক টাউনশিপ নিয়ে বৃহৎ কুসুমগড়। আমি বহুদিন আগে সেই কুসুমগড় গড়ে ওঠার সময়, আমারও আরম্ভের দিনে একবার গিয়েছিলাম ওই শহরে। মন খারাপ করে ফিরেছিলাম। শহর প্রায় তাচ্ছিল্য করে ফিরিয়েছিল গ্রামের মানুষটিকে। কুসুমগড়ে প্রায়ই কবিতাপাঠ, গল্পপাঠের আসর বসে, আমি আমন্ত্রিত হই কিংবা হই না, কিন্তু যাই না। বাসে সাড়ে তিনঘণ্টা। অনেক দূর যে! আর একটু ভয়ও করে। অবহেলা যে সয় না।

এক সকালে কুসুমগড় থেকে সুদেব আমাকে ফোন করল, কলকাতা থেকে বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখকরা আসবেন। পরপর নাম বলে যেতে থাকে। নামি এবং দামী লেখক সব। সারা জীবনের স্বীকৃতি দেওয়া হবে লেখক সীতাংশু রায়কে। সীতাংশু রায় এখন আশি পার হয়েছেন। দেশ বিদেশে তাঁর খ্যাতি। কত পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে। কত দেশ ভ্রমণ করেছেন। আমি কয়েকবার তাঁর বাড়ি গিয়েছি। তাঁকে আমার বই দিয়ে এসেছি। কিন্তু কোনোদিন তাঁর প্রতিক্রিয়া পাইনি। তাঁকে বই উৎসর্গ করেছি। আশা করেছি, কোনোদিন হয়তো একটা ফোন আসবে, তিনি বলবেন, বিজনকুমার তোমার বই পড়েছি, গল্পগুলো চমৎকার। তাঁর হাতে কত ক্ষমতা। তিনি সুপারিশ করলে আমি যেকোনো পুরস্কার পেতে পারি। কিন্তু তা হয়নি। সমস্ত জীবন অমন কোনো লেখকের ফোন আমি পাইনি। বরং আমিই কত ফোন করি। তরুণ থেকে প্রবীণ সকলকে। কেউ কেউ কথা বলেন, কেউ সময় দেন না। যাই হোক সুদেব আমাকে মাঘের সকালে ফোন করল, বিজনদা, আপনার সুখবর, কী খাওয়াবেন বলুন।

বুকটা ঝম করে উঠল, কী হয়েছে সুদেব?

সীতাংশু রায় এবং আপনাকে সংবর্ধনা দেবে সাহিত্যমেলা।

গা কেঁপে উঠল। সীতাংশু রায়ের সঙ্গে আমি! হ্যাঁ, আমি।

যেহেতু এই জেলায় হচ্ছে সাহিত্যমেলা, জেলার প্রবীণ লেখক হিসেবে আমাকে সংবর্ধিত করবে সাহিত্যমেলা কর্তৃপক্ষ। সংবর্ধনা দেবেন এই জেলার শিল্পপতি জীবেন্দ্র চট্টরাজ। জীবেন্দ্র চট্টরাজ! আমি আবার কেঁপে উঠলাম। কে না তাঁকে চেনে এই রাজ্যে? এক সময় কে না চিনতো? এখন আড়ালে চলে গেছেন। তিনি রাজনীতি করতেন। খুবই বিতর্কিত হয়েছিলেন। মানুষের সমর্থন পাননি এমন এক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। তবুও তিনি এখনো কুসুমগড়ের অনেক কিছু। কুসুমগড় ছিল এক সামান্য গ্রাম। গায়েই কুমারী নদী। নদীর তীরে সেই সাধারণ গ্রাম এখন শহর হয়ে গেছে। তিনিই প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন, শিল্পাঞ্চল কুসুমগড়কে গড়ে তোলায়। এরপর তাঁর মনে হয়েছিল, কুমারী নদীর অপর পারে কুসুমগড়কে প্রসারিত করবেন। অপর পারে হবে আর এক শিল্পাঞ্চল। ভ্রমরগড়। ভ্রমরগড় এক কল্পিত কাহিনির গড়। রাজকন্যা ভ্রমর তার আদিবাসী প্রেমিকের কাছে যেতে চেয়েছিল কুসুমগড় ছেড়ে। কুসুমগড়ের রাজা তাঁর কন্যাকে বন্দি করে রাখেন রাজপ্রাসাদে। কিন্তু রাজকন্যা এক রাতে এক দাসীর সাহায্যে পালায় প্রাসাদ ছেড়ে। কুমারী নদী পার হয়ে ভ্রমরগড়ে আশ্রয় নেয়। ভ্রমরগড়ের মানুষ নদীর অপর পারে রাতারাতি মাটির এক গড় নির্মাণ করে। রাজকন্যা সেই গড়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু তার আদিবাসী প্রেমিকের দেখা নেই। সে এল না কেন? কবে আসবে সে? কথিত আছে সে কুসুমগড়ে বন্দি হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল রাজার রোষে। রাজকন্যা বিরহে শীর্ণ হতে থাকেন। তাঁর রূপে কালি পড়ে। মানুষে জানে, কুসুমগড়ের বাহিনী গিয়েছিল রাজকন্যা উদ্ধারে। কিন্তু প্রবল প্রতিরোধে ঢুকতে পারেনি ভ্রমরগড়ে।

বসন্ত যায়, গ্রীষ্ম যায়- এল বর্ষা থেকে শরত, হেমন্ত। কুসুমগড়ের বাহিনী সেই হেমন্তকালেই কুমারী নদীর প্লাবনে ভেসে যায়। গ্রামবৃদ্ধরা বলে, রাজকন্যার বিরহাশ্রুতে কুমারী নদীর দুকূল ভেসেছিল। বান ডেকেছিল। তেমন বান আর কখনো হয়নি। ভেসে গিয়েছিল নদীর দুপাড়। বন্যার জল সরলে রাজকন্যার আর খোঁজ মেলে না। ভেসে গিয়েছিল কন্যা। কিংবা তার দয়িতের সঙ্গে দূরদেশে চলে গিয়েছিল। এই কাহিনি নদীর দুই পাড়েই প্রচলিত। গ্রামবৃদ্ধরা সন্ধ্যায় এক সময় বলত সন্তান-সন্তুতিদের। ভ্রমরগড় কৃষি এলাকা। অনেক রকম ফসল হয়। কুসুমগড় এবং ভ্রমরগড়, ছোট নদীর এপার ওপার। কুসুমগড় সিটি হয়ে গেছে অনেকদিন। ভ্রমরগড় তেমনিই গ্রাম। ভ্রমরগড়ের মানুষ ফসল নিয়ে এ-পাড়ে আসে। কাজকম্মেও আসে। ভ্রমরগড়ের অনেক মানুষ কুসুমগড়ে এসে বসবাস করছে। কুসুমগড় হলো রাজধানী। ভ্রমরগড় কিছুই না। সেই কিছুই না ভ্রমরগড়কে কুসুমগড়ের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে গিয়েছিলেন জীবেন্দ্র। ভেবেছিলেন ভ্রমরগড় হবে আরো উন্নত এক শহর। আরো পরিকল্পিত এক শহর। কুসুমগড়ে যা নেই, ভ্রমরগড়ে তা থাকবে। সেই মতো সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সরকার সম্মত হয়েছিল। বিশ্বজুড়ে এখন উন্নয়নের ঢেউ। তা থেকে বাদ যাবে কেন ভ্রমরগড়?

কিন্তু কুসুমগড়ের সঙ্গে ভ্রমরগড় মেলেনি সেই পুরাকালেও। রাজকন্যা ভ্রমর ভেসে গিয়েছিল কুমারী নদীর বন্যায়। কুসুমগড়ের রাজকন্যা ভ্রমরের আদিবাসী প্রেমিক হত হয়েছিল না বিবাগী হয়েছিল, না কি রাজকন্যাকে নিয়ে দূরদেশে চলে গিয়েছিল, কেউ জানে না। কেউ কেউ বলে, তাকে হত্যা করেছিল রাজা। আর সেই হত্যাকাণ্ডের পরই কুমারী নদী প্লাবিত করেছিল দুকূল তার অশ্রুধারায়, সেই কথা মানুষের মনে গুণগুণ করে। জীবেন্দ্র মেলাতে গিয়েছিলেন কুসুমগড় এবং ভ্রমরগড়কে। ইস্পাত এবং রাসায়নিক কারখানার জন্য জমি চেয়েছিলেন। সরকার এগিয়েছিল। জমি অধিগ্রহণের নোটিশ পড়েছিল। জীবেন্দ্র ভেবেছিলেন, যেভাবে কুসুমগড় নির্মাণ করেছেন, সেভাবেই ভ্রমরগড় হবে। কিন্তু তাঁর অনুমান ভুল ছিল। ভ্রমরগড়ের চাষিবাসী মানুষ ফুঁসে উঠেছিল। জমি দিয়ে নিঃস্ব হবে না। নগরায়ন তো নিঃস্ব করে প্রাকৃতজনকে। বিরহিনী রাজকন্যার আবাস ভ্রমরগড় কুসুমগড়ের মতো হতে চায় না। তারা জমি দেবে না। তাদের তিন ফসলি জমি। ভালো দামে ফসল বেচে নদীর ওপারে কুসুমগড়ে। কুসুমগড়ের মানুষের হাতে অঢেল টাকা। ভ্রমরগড়ের মানুষ প্রতিরোধে নেমেছিল। প্রায় ছমাস ধরে প্রতিরোধ হয়েছিল। হতাহত হয়েছিল অনেক। সেই হেমন্তের এক রাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কুসুমগড়ের বাহিনী, যেন আদিবাসী প্রেমিকের খোঁজ পেয়েছিল কুসুমগড়ের রাজা। যা ঘটেছিল তার চেয়ে রটেছিল কম নয়। বিরহিনী রাজকন্যাই নাকি ধর্ষিতা হয়েছিল। কত অভিযোগ হয়েছিল। মানুষের নিখোঁজ হওয়ার খবর রটেছিল। এই প্রতিরোধ এমন হয়েছিল যে সারা দেশের মিডিয়া চলে এসেছিল। শেষ অবধি সেই পরিকল্পনা ত্যাগ করা হয়েছিল। কিন্তু জীবেন্দ্র চট্টরাজ নিগৃহীত হয়েছিলেন। তাঁর উপরেই পরাজয়ের সমস্ত দায় চেপেছিল। আরক্ষাবাহিনীর অত্যাচারের দায়ও চেপেছিল। কুসুমগড়ের যে বাহিনী নদী পার হয়ে ভ্রমরগড় দখল করে প্রতিরোধ ভাঙতে গিয়েছিল, তা ছিল নাকি তাঁরই পরিকল্পনা। কিছুই স্পষ্ট নয়, শুধু ভ্রমরগড়ের মানুষ বলে, তারা রক্ষা করেছিল বিরহিনী রাজকন্যাকে। ভ্রমরগড় থাকবে। তা কুসুমগড় হবে না কখনোই। এ কথা সত্য, ভ্রমরগড়ের রক্তেই প্রতিরোধ। তা বোঝেননি জীবেন্দ্র। ভ্রমরগড়ের ইতিহাস বা কিংবদন্তি কি তিনি জানতেন না? সরকার আর প্রশাসন যখন দখল করতে গিয়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল ভ্রমরগড়, তিনি কুসুমগড় ভ্রমরগড়ের দ্বন্দ্বের কথা স্মরণে আনেননি কেন? সরকারই তো পুলিশ নামিয়ে দখল করতে গিয়েছিল ভ্রমরগড়। সরকারের মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন, ভ্রমরগড় যে করে হোক দখল করবেন। ভ্রমরগড় তিনি চিনতেন না। তিনি চেয়েছিলেন আর এক কুসুমগড় নির্মাণে তাঁর নাম জড়িয়ে থাকবে। স্বপ্ন ছিল জীবেন্দ্ররও। তিনি চেয়েছিলেন কুসুমগড় এবং ভ্রমরগড় যমজ নগরী হয়ে উঠুক। নদীর এ-পাড়, ও-পাড়। জীবেন্দ্র সেই স্বপ্ন যে করে হোক বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন। প্রবলভাবে চেয়েছিল সরকারও। কিন্তু সরকারের ব্যর্থতায় জীবেন্দ্র একা হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর সরকারের পতন হয়। নতুন সরকার এসে জীবেন্দ্রকেই দোষী সব্যস্ত করে নানাভাবে নিগ্রহ করে। শেষ অবধি অনেক রকম মূল্য দিয়ে জীবেন্দ্র নিঃসঙ্গ হয়েছেন। কিন্তু তিনি কুসুমগড়েই আছেন। শহরটিকে তিনি গড়েছেন। মায়ার শহর, কেন ছেড়ে যাবেন? যাবেনইবা কোথায়? কে নেবে তাঁকে?

আমি এসব জানি। জানি জীবেন্দ্র এক নিন্দিত ব্যক্তি। ভ্রমরগড় তাঁকেই অপরাধী করে সাজানো বিচার করেছিল কয়েকবার। তাতে তাঁর যাবজ্জীবন হয়েছিল প্রত্যেকবারই। একবার ফাঁসি। সাজানো ফাঁসির অভিনয় হয়েছিল। সেই জীবেন্দ্র বেশ কয়েক বছর নিজেকে আড়ালে রেখে আবার প্রকাশ্য সভায় আসছেন। অকৃতদার জীবেন্দ্র কুসুমগড় সাহিত্যমেলার প্রধান উদ্যোক্তা। আমি সেই মেলায় আমন্ত্রিত। একবার ভাবলাম যাব কি না, আবার ভাবলাম সীতাংশু রায় আসছেন, আমার এসব ভাবা ঠিক নয়। আমি কে? অতি সাধারণ। আমাকে জেলার বাইরে তেমন কেউ চেনে না। আবার জেলার সকলে যে চেনে তাও নয়। আমাকে ডেকেছে। সম্মানিত করছে, এই ঘটনাই বড়। ভ্রমরগড় এখনো আগের মতোই আছে। আমার মাসির বাড়ি ছিল ভ্রমরগড়ে। সে বছর পঁচিশ আগের কথা। তারা এখন কুসুমগড়ের বাসিন্দা।  সেই কুড়ি পঁচিশ বছর আগে আমি ভ্রমরগড়ে গিয়েছিলাম। তখন সেখানে ইলেক্ট্রিসিটি এসেছিল সবে। কিন্তু ভোল্টেজ খুব কম। সন্ধ্যায় প্রায় অন্ধকারেই থাকতে হতো। মনে আছে, আমরা বাড়ির বারান্দায় বসে কুমারী নদীর ও-পাড়ে কুসুমগড়ের আলো দেখেছিলাম। নদীর ও-পাড়ে যেন দেওয়ালির আলোকমালা। আমার মাসির মেজ ছেলে বলেছিল, কুসুমগড়ে সে জমি কিনে চলে যাবে। তার মা-বাবা ভ্রমরগড় ছাড়তে চায় না বলে সে কেন পড়ে থাকবে অজগ্রামে? তাই-ই হয়েছিল, সে ভ্রমরগড়ে মা-বাবাকে রেখে কুসুমগড়ে চলে গিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল। সফল হয়েছে, না অসফল, তা আমার জানা নেই। মাসি-মেসো নেই তা আমি জানি। শ্রাদ্ধের দুটি কার্ড পেয়েছিলাম অনেক দিন আগে, দু বছর অন্তর অন্তর। তাদের ভিটে আছে কি না, আমি জানি না। বেচেই দিয়েছে হয়তো। সেই টাকা কুসুমগড়ে কাজে লাগিয়েছে হয়তো। খোঁজই নেই মাসির সেই ছেলে সুবীরের। কুসুমগড় তাকে আত্মস্যাৎ করেছে ঠিক। না হলে সব কিছু খুইয়ে আবার ফিরেছে ভ্রমরগড়ে।

শীতের ভোরে বাসে চেপে কুসুমগড় যাত্রা করেছি। বেলা দশটা নাগাদ আমি পৌঁছেছি কুসুমগড়। কতকাল বাদে এই শহরে এসেছি। প্রথম যখন এসেছিলাম এক সাহিত্য সম্মেলনে, আমি ছিলাম শুধুই শ্রোতা। মঞ্চে ডাক পাইনি। আমার তখন বছর চল্লিশ। ভাবছি, এই আমাকে ডাকবে কবিতা পড়তে, এই ডাকবে, করতে করতে বেলা গড়িয়ে গেল। লাস্ট বাস না ধরতে পারলে বাড়ি ফিরতে পারব না। আমার জন্য কোনো থাকার জায়গা ছিল না বিশিষ্টদের ভিতরে। ভাঙা মন নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। সব মনে পড়ে যাচ্ছিল। এবার আমার সংবর্ধনা। আমার জন্য থাকার ব্যবস্থাও করেছে কমিটি। সুদেব তাই জানিয়েছে। আসলে জীবেন্দ্র চট্টরাজ এবার বলেছেন, জেলার সাহিত্যসেবীদের সম্মানিত করতে হবে সুখ্যাতদের সঙ্গে। যেমন সীতাংশু রায়ের সঙ্গে আমি। বাস ঘণ্টা তিন যাওয়ার পর কুসুমগড় মহাসড়ক ধরল। অবাক হয়ে দেখছিলাম মহাসড়কের দুই ধার বদলে গেছে। দুই ধারের গ্রাম শহর হয়ে উঠেছে-প্রায়। সেই তিরিশ বছর আগে এমন ছিল না। এই হাইরোডও তখন তৈরি হচ্ছিল। গাড়ি চলাচল শুরু হয়নি। আমার বাস গিয়েছিল পুরোনো সংকীর্ণ সড়ক দিয়ে। সেই পথ ছিল ভাঙাচোরা। টাল খেতে খেতে বাস চলত। এই মহাসড়ক মসৃণ। ফোর লেন সড়ক অতি দ্রুত গতিসম্পন্ন। আমি পৌঁছেছি সময়ের আগেই। আজ আমি থাকব। কাল মধ্যাহ্নের আহার শেষে ফিরব।

আমি তাঁকে প্রথম চাক্ষুষ করলাম। ছবিতে দেখেছি। সংবাদপত্রে এক সময় খুব ছবি উঠত, কার্টুন আঁকা হতো, টেলিভিশনে টক শো হতো তাঁকে নিয়ে। সে প্রায় বছর পনের আগের কথা। এখন তিনি অজ্ঞাতবাসে আছেন বলতে গেলে। অবাক হয়ে আমি দেখলাম অতিসাধারণ চেহারার এক ব্যক্তি। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির মতো হবেন। আধময়লা রং। শান্ত প্রকৃতির মানুষ। কথা বলেন নিম্ন স্বরে। জনতার ভিড়ে তাঁকে আলাদা করে চেনা যাবে না। এই মানুষ এত কিছু করেছেন?

সীতাংশু রায় অসুস্থ। বয়স পঁচাশির মতো হবে। তাঁর সংবর্ধনার উপচারসামগ্রী এবং দুলক্ষ টাকা তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দেবেন বললেন তিনি। আমাকে পঁচিশ হাজার টাকা, শীতবস্ত্র, মানপত্র, ফুলের মালা, কলম দিয়ে সম্মানিত করা হলো। আবেগে আমার চোখে জল এসে গেল। এতকাল লিখে, নিজের টাকায় বই প্রকাশ করে এই প্রথম আমি স্বীকৃত হলাম। ধন্য হলাম।

বিকেলে কবি সম্মেলন হচ্ছিল। তিনি ঘুরছিলেন সামনের প্রাঙ্গণে। আমার মনে হলো, তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলি। আমি গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, কেউ সারা জীবন ধরে একটা কাজ করে যাচ্ছে, নিজ ধর্মচ্যুত হয়নি, তার একটা স্বীকৃতি হবেই, আপনি নিজ গুণেই পেয়েছেন, আমার কোনো কৃতিত্ব নেই, এইটা আপনার প্রাপ্য ছিল, তাই পেয়েছেন।

আমরা হাঁটছিলাম। বেলা পড়ে এসেছে। সামনে সেই কুমারী নদী। নদীর ওপারে ভ্রমরগড়। গাছ-গাছালিতে ভরা নদীর ওপারের সেই দিগন্তরেখা। ভুটভুটি নৌকো ছাড়ছে ভ্রমরগড়ের উদ্দেশে। আমি কী বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বললাম, এই কুসুমগড় সিটি আপনারই গড়া।
না না, মানুষই গড়েছে। তিনি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, সকলে হাত লাগিয়েছে তাই হয়েছে।
এখানে ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ডিগ্রি কলেজ, আইন কলেজ,  মেরিন কলেজ... সব আপনার করা, আপনিই করেছেন।

তিনি বললেন, মানুষের স্বপ্ন দেখার একটা সীমারেখা থাকে, তা জানতে হয়।

স্বপ্ন কি সীমারেখা মানে?

তিনি হাসলেন, বললেন, মানে না, কিন্তু মানুষকে জানতে হয় তা, না হলে স্বপ্নকে বাস্তব ভেবে বিভ্রমের পিছনে ছুটতে হয়, বিভ্রম আপনাকে ধ্বংস করে দিতে পারে, আপনি নিজের সীমারেখা জানেন বলে এইটুকু আসতে পারলেন, লেখক হতে কতজন কলকাতায় গিয়ে  সব খুইয়ে ফিরেছে তা আপনি না জেনেও যাননি।

আমি বললাম, আমার সাহস হয়নি, দেখুন একজন মানুষ সারা জীবনে একটা বসতবাটি বানায়, আর সংসার প্রতিপালন করে, বয়স হয়, মারা যায়, একজীবনে এইটুকু, আপনি যা করেছেন, তা কেউ পারে না, একটা বাড়ি করতেই হিমসিম খেয়ে যায় মানুষ, না শেষ করে মরে যায়, তো এতগুলো প্রতিষ্ঠান!
তিনি বললেন, আমি সীমা বুঝিনি, স্বপ্নটা আকাঙ্ক্ষা হয়ে গিয়েছিল। লোভ। প্রতিষ্ঠান গড়া তো দখলের সাধও। তাই ভ্রমরগড়ে হাত বাড়িয়েছিলাম...।

তিনি কথা অর্ধসমাপ্ত রেখে চুপ করে গেলেন। নদী আর সেই ভ্রমরগড় পিছনে পড়ে থাকল। আমি তাঁকে অনুসরণ করছি। কুসুমগড়ে আলো জ্বলে উঠছে। সেই দীপাবলীর আলো। ভ্রমরগড় আর নদীর উপরে নেমে এসেছে নিবিড় অন্ধকার। বিরহে শীর্ণ হয়ে আসা, মৃতপ্রায় রাজকুমারী ভ্রমর, একা অন্ধকারে পড়ে আছে। আবার যদি নদী প্রমত্ত হয়, তবে বিরহিনী রাজকুমারী কি তার বিরহমুক্ত হবে? প্রমত্তা নদী কী করবে কেউ জানে না। জানেন শুধু তিনি। ক’বছর আগে দেখেছেন নদীর রোষ। ভ্রমরগড়ের নদী আছড়ে পড়েছিল কুসুমগড়ের উপর। আতঙ্ক ছেয়ে গিয়েছিল দুই পাড়েই। তারপরই তো নিজেকে আড়াল করে নিয়েছেন কুসুমগড়ের স্থপতি। হাঁটতে হাঁটতে আড়াল থেকেই একবার ঘুরে তাকালেন কুমারী নদীর দিকে। ব্যপ্ত অন্ধকারে।    


 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ জুলাই ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়