সৌন্দর্যের লীলাভূমি কিশোরগঞ্জের হাওর
কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি : কিশোরগঞ্জের হাওর বেষ্টিত অঞ্চলে পর্যটনের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। শীতে বা বর্ষায় হাওরে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়।
বর্ষাকালে হাওরে সাগরের মতো সূর্যাস্ত দেখা যায়। ছবির মতো হাওরে ভেসে বেড়ায় মাছ ধরার নৌকা। উথাল-পাতাল ঢেউ ওঠে। আছে হিজল, তমাল বনের মোহনীয় হাতছানি। কিশোরগঞ্জের হাওর যেন অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি।
এখন বর্ষাকাল। হাওরে যেন কূলহীন সাগর। দ্বীপের মতো ভেসে আছে গ্রামগুলো। থৈ থৈ পানির মধ্যে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হিজল গাছগুলো যেন দাড়ি-কমার মতো একেকটি বিরাম চিহ্ন। পানির নিচ থেকে জেগে উঠা করচের বন, বরুন গাছ, নদীতে শুশুকের লাফ-ঝাঁপ অভিভূত করবে দর্শনার্থীদের। সাগরে যেভাবে সূর্য ডুবে, হাওরেও তাই। ভোরে পানির নিচ থেকে উঠে আসা সূর্যকে দেখলে পবিত্র এক অনুভূতি জাগে মনে। রাতের হাওরে ঢেউ আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, অনেকের ঘুম কেড়ে নেয়। যারা বৈচিত্র্যময় জনপদ দেখেনি, তাদের কাছে এক বিস্ময়ের নাম হাওর।
জলে-ভাসা এক জনপদের নাম শিমুলবাগ। এর কিছু দূরেই চোখে পড়ে এক জনমানবহীন ভাসমান বনভূমি। রাংচাবন নামেই ডাকা হয় তাকে। এটি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলায়। সারি সারি হিজল-তমাল-করচ গাছ যেন প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। বর্ষায় কাঠবিড়ালিসহ বিভিন্ন প্রাণীর আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে উঠে গাছগুলো। আর শীতে মুখরিত হয় পরিযায়ী পাখির কলরবে। স্থানীয় লোকজন এ বনকে দেখে রাখেন। তারা বলছেন, প্রকৃতির খেয়ালেই সৃষ্টি হয়েছে রাংচাবন। অনেকে এ বনকে সিলেটের রাতারগুলের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। শীত-বর্ষা দুই ঋতুতে বাইরের লোকজন সেখানে বেড়াতে আসে।
পর্যটন সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে জেলার নিকলীতে হাওরকে সামনে রেখে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল বেড়িবাঁধ। ঈদ-পূজার মতো বিভিন্ন উৎসবে সেখানে দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা যায়। প্রায় আড়াই কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে ছোট ছোট বেঞ্চ। সেখানে পানিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আছে ছোট ছোট নৌকা, স্পিডবোট। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের এই বেড়িবাঁধে গিয়ে সেখানে থাকার ব্যবস্থা নেই। খাওয়া-দাওয়া ও আবসন সমস্যার কারণে লোকজন সেখানে অবস্থান করতে পারে না। দিনে গিয়ে দিনে চলে আসতে হয়। আছে নিরাপত্তাসহ কিছু সমস্যা। তবে এত সব সমস্যার পরও এ বেড়িবাঁধ জনপ্রিয় পর্যটন স্পট হয়ে উঠেছে।
হাওরের পানি, মাছ, হিজলবন, পাখপাখালি, সবুজমাঠ ছাড়াও দেখার মতো বেশ কিছু জায়গা রয়েছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের ‘দিল্লির আখড়া’ ভালো লাগবে সবার। এখানে রয়েছে শত শত হিজল গাছ। চারশো বছরের পুরনো এই আখড়া সম্পর্কে গল্প আছে। এক সাধক নাকি এখানে এসেছিলেন ধ্যান করতে। তার ধ্যান ভাঙার জন্য কিছু দৈত্য তাকে নানাভাবে বিরক্ত করত। এক দিন এই সাধক মহাবিরক্ত হয়ে তার দিক্ষাগুরুর মন্ত্রবলে এই দৈত্যগুলোকে হিজল গাছ বানিয়ে রাখেন। জায়গাটির নাম দিল্লির আখড়া কীভাবে হলো? সেই গল্প ওইখানে গেলে জানা যাবে।
অষ্টগ্রামের প্রায় সাড়ে চারশো বছরের পুরনো পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট কুতুব শাহ মসজিদ, আওরঙ্গজেব মসজিদ, ঈশাখাঁ’র সময়ে নির্মিত ইটনার শাহী মসজিদ, মোঘল আমলে নির্মিত নিকলীর গুরুই মসজিদ হাওর পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে।
বর্ষা শেষে হাওরে যখন পানি কমতে শুরু করে, তখন আকাশে সাদা মেঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়াউড়ি করে ধবল বক। মেহমান হয়ে আসে পরিযায়ী পাখি। হাওরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হিজল বনগুলো এ সময় চলে যায় এদের দখলে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিলগুলোও যেন শাপলা ফুলের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে। পানি যখন পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে তখন সবুজ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। যেখানে চোখ যাবে সবুজ আজ সবুজ। এগুলো কৃষকের বোনা বোরো ধান। দেখা মিলবে হোগলা বন ও কলমিলতার।
হাওরের ডুবোসড়ক ভালো লাগবে সবার। কংক্রিটের তৈরি এ ধরনের সড়ক বর্ষায় তলিয়ে যায়। শুকনো মৌসুমে ভেসে ওঠে। ছয়মাস এ সড়ক দিয়ে চলাচল করা যায়। কিশোরগঞ্জের পুরো হাওরজুড়ে অসংখ্য ডুবোসড়ক দেখা যায়। যা হাওরবাসীর যোগযোগ ব্যবস্থাকে অনেক সহজ করেছে। তাছাড়া কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম উপজেলায় বেশ কয়েকটা বেড়িবাঁধ রয়েছে। এসব বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালে ৩০-৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো গ্রাম চোখে পড়ে না। বাঁধে দাঁড়িয়ে হাওর দেখা সাগর দেখার মতোই উপভোগ্য।
কিশোরগঞ্জের হাওরের পর্যটন সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস জানান, বেসরকারিভাবে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান হাওরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, তাহলে সরকার এবং জেলা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা থাকবে।
রাইজিংবিডি/কিশোরগঞ্জ/৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭/রুমন চক্রবর্তী/বকুল
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন