আমার মা আমার বেহেশত্
আসাদ আল মাহমুদ : মা মানে অস্তিত্ব, মা মানে এক বুক ভালোবাসা- আমার মা আমার বেহেশত্। মা জীবন বাজি রেখে সন্তানকে ভালোবাসেন। তেমনি মা তাঁর সন্তানকে নিজের জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করেন। মা হলো পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক যেখানে সব দুঃখ, কষ্ট জমা রাখা যায়। তাই মাকে শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানানোর নির্দিষ্ট কোনো ক্ষণ নেই। মায়ের জন্য ভালোবাসা সব সময়ের। পৃথিবীতে একটি নাম ডাকলে মনে হয় যেন পৃথিবীর সব সুখ পেয়েছি, তা হলো ‘মা’। তাই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন:
‘যেখানে তে দেখি যাহা
মা-এর মতন আহা
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের মতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!
হেরিলে মায়ের মুখ
দূরে যায় সব দুখ,
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরাণ,
মায়ের শীতল কোলে
সকল যাতনা ভোলে
কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।
...
আয় তবে ভাই বোন,
আয় সবে আয় শোন
গাই গান, পদধূলি শিরে লয়ে মা’র;
মা’র বড় কেহ নাই-
কেউ নাই কেউ নাই!
নত করি বল সবে ‘মা আমার! মা আমার!’’
কবির এই পঙ্ক্তি থেকে বুঝা যায় সবচেয়ে প্রিয় শব্দ হলো ‘মা’। মা মানেই ভালোবাসা জড়ানো।
মায়ের স্নেহ মমতার তুলনা হয় না। মায়ের গর্ভে থাকাকালে মায়ের শরীর থেকেই সন্তান খাবার গ্রহণ করে এবং সে যখন আলো হাওয়ার এই পৃথিবীতে আসে সে সময় মাকে অসহ্য যন্ত্রণা সইতে হয়। মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসার পর মায়ের দুধ পান করে। মায়ের এক ফোঁটা দুধের ঋণ শোধ করতে পারে না কোনো সন্তান। তাই তো আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ ( সা.) মাকে সৃষ্টি জগতে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। তিনি বলেছেন, আল্ জান্নাতু তাহতা আক্দামিল্ উম্মাহাত। অর্থাৎ মায়ের পায়ের তলায় জান্নাত(বেহেশত্)। প্রিয়নবী মায়ের শুধু খিদমত করতে বলেননি, তিনি বলেছেন মায়ের পায়ের তলায় সন্তানের জান্নাত।
একবার এক তরুণ প্রিয় নবীর কাছে এসে জিহাদে অংশগ্রহণ করার জন্য আবেদন করল। প্রিয়নবী সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন বাড়িতে তোমার মা আছেন কি? তরুণ বলল, জি হ্যাঁ, আমার মা আছেন। তখন প্রিয় নবী বললেন, যাও, বাড়িতে গিয়ে তোমার মার খিদমত করো। নিশ্চয়ই তোমার মায়ের পায়ের তলাতেই তোমার জান্নাত। (আবু দাউদ, বায়হাকী)
মাকে নিয়ে অনেক কবি কবিতা লিখেছেন। এর মধ্যে কবি কাজী কাদের নেওয়াজ অন্যতম। তার ভাষায়-
‘মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেনো ভাই,
ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই।’
মায়ের জন্য ভালোবাসা একদিনের নয়, অনন্তকালের। মা ও বাবা দুজনেরই সমান অবদানের কথা বলা হলেও বাবা খানিকটা আড়ালেই থাকেন মায়ের ভূমিকার কারণে। মা হলো একাধারে অভিভাবক, প্রিয় বন্ধু। মায়ের সঙ্গে অভিমান করাসহ সুখ, দুঃখ ভাগ করা যায়। পৃথিবীতে মা শুধু স্বার্থহীনভাবে ভালোবাসেন। দূর গ্রামে ফেলে আসা মায়ের মুখ, মায়ের স্নেহ ছায়ায় বেড়ে ওঠা, মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকার বেদনা কিংবা সাতসমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে দূর অজানায় পাড়ি জমানোর পর মায়ের স্মৃতি ভেসে ওঠে। যখনই মায়ের কথা মনে পড়ে, মনের অজান্তেই চোখের জলে ভিজে যায়। মন ছুটে যেতে চায় মায়ের কাছে।
এ বিষয়ে পল্লীকবি জসীমউদ্দীন লিখেছেন-
‘হিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বহিয়া নয়ন নীর।
বাঁশবনে বসি ডাকে কানা কুয়ো, রাতের আঁধার ঠেলি,
বাদুড় পাখার বাতাসেতে পড়ে সুপারীর বন হেলি।
চলে বুনোপথে জোনাকী মেয়েরা কুয়াশা কাফন ধরি,
দূর ছাই! কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি।
যে কথা ভাবিতে পরাণ শিহরে তাই ভাসে হিয়া কোণে,
বালাই, বালাই, ভালো হবে যাদু মনে মনে জাল বোনে।
ছেলে কয়, “মাগো! পায়ে পড়ি বলো ভাল যদি হই কাল,
করিমের সাথে খেলিবারে গেলে দিবে না ত তুমি গাল?
আচ্ছা মা বলো, এমন হয় না রহিম চাচার ঝাড়া
এখনি আমারে এত রোগ হোতে করিতে পারি ত খাড়া ?”
মা কেবল বসি রুগ্ন ছেলের মুখ পানে আঁখি মেলে,
ভাসা ভাসা তার যত কথা যেন সারা প্রাণ দিয়ে গেলে।
...
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা।
সম্মুখে তার ঘোর কুজঝটিকা মহা-কাল-রাত পাতা।
পার্শ্বে জ্বলিয়া মাটির প্রদীপ বাতাসে জমায় খেলা,
আঁধারের সাথে বুঝিবা তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল।’
সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসা আর মায়ের জন্য সন্তানের আত্মার টান চিরায়ত। সন্তানের কাছে সবচেয়ে আপন হচ্ছেন মা। সন্তানের শৈশব ও কৈশোর কাটে মায়ের কাছে বিভিন্ন আবদারে। বর্তমান সমাজে মাকে যে তাঁর সন্তান কোনো কষ্ট দিচ্ছে না, এমন নয়। যে মা ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে ধারণ করে সুন্দর পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন তাকে কেউ কেউ বোঝা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছেন। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মায়েদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। শুধু প্রিয় মায়ের জন্যই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভরা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। আবার সমাজের অনেকেই আছেন মায়ের সেবা করার জন্য বিয়ে করেননি।
মায়ের ভালোবাসা নিয়ে বিশ্ব মা দিবসের ইতিহাস শত বর্ষের পুরোনো। যুক্তরাষ্ট্রে আনা জারভিস নামের এক নারী মায়েদের অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসচেতন করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে আনা জারভিস মারা গেলে তাঁর মেয়ে আনা মারিয়া রিভস জারভিস মায়ের কাজকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সচেষ্ট হন। ওই বছর তিনি তাঁর সানডে স্কুলে প্রথম এ দিনটি মাতৃদিবস হিসেবে পালন করেন।
১৯০৭ সালের এক রোববার আনা মারিয়া স্কুলের বক্তব্যে মায়ের জন্য একটি দিবসের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এভাবেই শুরু হয় বিশ্বব্যাপী মা দিবসের যাত্রা। আজ রোববার (১৩ মে) বিশ্ব মা দিবসে মায়ের প্রতি রইলো নিরন্তর ভালোবাসা।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মে ২০১৮/আসাদ/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন