ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

আইলার ৯ বছর

এখনো শত শত পরিবার টং ঘরে

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২০, ২৪ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এখনো শত শত পরিবার টং ঘরে

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা : শুক্রবার ২৫ মে, ভয়াল ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানার ৯ম বর্ষপূর্তি।

২০০৯ সালের এই দিনে উপকূলীয় জেলা খুলনার দুটি উপজেলায় প্রবল জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে প্লাবিত হয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আইলা আঘাত হানার পর দীর্ঘ নয় বছর অতিক্রান্ত হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্ত জনপদের মানুষ।

ভিটে-মাটি হারানো শত শত মানুষ এখনো বেড়িবাঁধের উপর মানবেতর জীবন যাপন করছে। বেড়িবাঁধের টং ঘর বসবাসের শেষ ভরসা হওয়ায় বদলে গেছে মানচিত্র। একটি এলাকার নাম হয়েছে ‘ঝুলন পাড়া’।  বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চলমান বাঁধ নির্মাণ কাজ চলছে ধীর গতিতে। এ কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

২০০৯ সালের ২৫ মে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যায় ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আইলা। মুহূর্তের মধ্যে পানির তোড়ে ভেসে যায় খুলনার দাকোপ এবং কয়রা উপজেলার ওয়াপদা বেড়িবাঁধ। দিনের আলোতে জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানায় প্রাণহানির সংখ্যা কম হলেও কেবল দাকোপ উপজেলায় ২৩ জনের মৃত্যু হয়। দাকোপ উপজেলার দুটি ইউনিয়নের ৫০ হাজার মানুষ আইলার তাণ্ডবে সব হারিয়ে বেড়িবাঁধের উপর আশ্রয় নেয়।

উপজেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যমতে, আইলায় দাকোপ উপজেলার ২৯ হাজার ১৩২টি পরিবারের ১ লাখ ৩ হাজার ৭০০ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৩ হাজার ২৮০ একর আবাদি জমি, ৩৩ হাজার ৪১৬টি বসতবাড়ি, ২৩৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৫৬৩ কিলোমিটার রাস্তা এবং ১১৮ কিলোমিটার ওয়াপদা বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গবাদিপশু ও অন্যান্য সহায় সম্পদ মিলে ক্ষতির পরিমাণ ছিল হাজার কোটি টাকার ঊর্ধ্বে। নয় বছর অতিক্রান্ত হলেও নানা কারণে আইলা আক্রান্ত মানুষের চোখে এখনো হতাশার ছাপ।

সরেজমিন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দাকোপ উপজেলার আইলা বিধ্বস্ত দুটি ইউনিয়ন সুতারখালী ও কামারখোলার কয়েকশত মানুষ এখনো ঘরে ফিরতে পারেনি। সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগী, বাইনপাড়া ও গুনারী গ্রাম এবং কামারখোলা ইউনিয়নের জালিয়াখালী ও ভিটেভাঙ্গা গ্রামের শত শত পরিবার ওয়াপদা বেড়িবাঁধের উপর মানবেতর জীবন যাপন করছে। এদের অধিকাংশের মাথা গোজার শেষ আশ্রয় নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আইলায় দুটি ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ বিধ্বস্ত হয়। যা নয় বছরেও পুনর্নিমাণ করা সম্ভব হয়নি। 

 



ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কালাবগীর ৮নং ও ৯নং ওয়ার্ডের কয়েক শত মানুষ বেড়িবাঁধের উপর টং ঘর করে অনেকটা নদীর চরে ঝুলে বসবাস করছে। ফলে ওই অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে ‘কালাবগী ঝুলন পাড়া’। যাদের একটি অংশ বাস করে কালাবগী ৯নং ওয়ার্ডের বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। চারিপাশে বেড়িবাঁধ নেই। কোনো রকমে টং ঘর করে আছে। নদীতে জোয়ার আসলে সাঁতার কেটে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের নৌকায় চড়ে অথবা বই খাতা হাতে নিয়ে সাঁতার কেটে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। নদীতে পানির চাপ একটু বেড়ে গেলে তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। বিষয়টি যেন জীবন নিয়ে খেলা করা।

এখানকার জনগোষ্ঠীর আয়ের উৎস কৃষি, চিংড়িপোনা ধরা আর বনের সম্পদ আহরণ। বালি এবং পলি পড়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আবাদি জমি চাষাবাদের অনুপযোগী, অপরদিকে ঋণের বোঝায় জর্জরিত কৃষকরা ইচ্ছে থাকলেও ঠিকমত চাষাবাদ করতে পারছে না। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে নদী থেকে চিংড়ি পোনা আহরণ বন্ধ রয়েছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষাসহ মৌলিক চাহিদা মিটাতে না পেরে বহু মানুষ এলাকা ত্যাগে বাধ্য হয়েছে।

নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত দুর্গত এলাকার মানুষের রয়েছে খাবার পানির সংকট। তীব্র তাপদাহে ২৫-৩০ কিলোমিটার দূর থেকে টপ প্রতি ২০-২৫ টাকা দামে পানি কিনে এনে পান করে পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনো রকমে জীবন ধারণ করছেন তারা।

কালাবগী ৯নং ওয়ার্ডের বিচ্ছিন্ন দ্বীপাঞ্চলের বাসিন্দা হারুন সানা ও রেজাউল সানাসহ অনেকে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এখানে বেঁচে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। একই এলাকার গৃহবধূ আনোয়ারা বেগমও হতাশার সুরে বলেন, ‘‘হয় সৃষ্টিকর্তা আমাগে তুলে নিয়ে যাক, না হয় আমরা এদেশ ছাইড়ে অন্য জাগায় চলি যাবো, আর সহ্য হয় না।’’

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ক্ষতিগ্রস্ত দুটি ইউনিয়নের ৫২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ কাজ ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করার কথা। চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখনো পর্যন্ত ২৫ ভাগ কাজ সমাপ্ত করেছে। সেই কাজের মান নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন।

দাকোপ উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ আবুল হোসেন বলেন, সাধারণ বাঁধ শিপসা নদীর ভাঙন থেকে ওই অঞ্চলকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে উপযুক্ত বাঁধ নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দুর্যোগ ঝুঁকি অনেকাংশে কেটে যাবে। পানি সংকট নিরসনে কিছু পুকুর খনন করা হয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। তারা চেষ্টা করছেন,  জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য পর্যাপ্ত ট্যাংকি বিতরণ এবং রিজার্ভ হাউজ নির্মাণের। ভূমিহীনদের মাঝে খাস জমি বরাদ্দের মাধ্যমে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।



রাইজিংবিডি/খুলনা/২৪ মে ২০১৮/মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়