ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মৎস্য শিকার থেকে বনদস্যু হওয়ার গল্প

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৫, ৯ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
 মৎস্য শিকার থেকে বনদস্যু হওয়ার গল্প

‘দাদা ভাই বাহিনী’র প্রধান রাজন (অস্ত্র কাঁধে)। সঙ্গে আত্মসমর্পণকৃত দস্যুদের একাংশ

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা : মো. জয়নাল আবেদীন ওরফে রাজন ওরফে দাদা ভাই। বয়স ৩৮ বছর। সাত ভাই-বোনের অভাব-অনটনের সংসারের বোঝা কিছুটা হালকা করতে তিনি এক সময় সুন্দরবনের বিভিন্ন নদ-নদীতে জাল ফেলে মাছ শিকার করতেন। সহজ-সরল খেটে খাওয়া এই মৎস্য শিকারি এক সময় হয়ে ওঠেন ভয়ংকর দস্যু। গড়ে তোলেন ‘দাদা ভাই বাহিনী’।

এটি সুন্দরবনের কুখ্যাত বন-জলদস্যু ‘দাদা ভাই বাহিনী’র প্রধান মো. জয়নাল আবেদীন ওরফে রাজনের দস্যু হয়ে ওঠার নেপথ্যের কথা।

এভাবে শুধু জয়নাল আবেদীন ওরফে রাজন নন, অন্য দস্যুদের অতীতও প্রায় একই। অধিকাংশ বনদস্যু মৎস্য শিকারের সূত্র ধরে সুন্দরবনে প্রবেশ করে। কিন্তু পরিস্থিতি তাদের দস্যু পরিচয়ে বন থেকে বের করে দেয়। এরপর জীবন চলে যায় অনিশ্চয়তার দিকে। হয় আত্মসমর্পণ, না হয় ক্রসফায়ারের মুখোমুখি- এই অবস্থার মধ্যে দিন কাটে তাদের। বনদস্যুদের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের জীবন-জীবিকা পর্যালোচনা করে এই তথ্য উঠে এসেছে।

সুন্দরবনের কুখ্যাত দস্যু ‘দাদা ভাই বাহিনী’র প্রধান মো. জয়নাল আবেদীন ওরফে রাজন এবং তার বাহিনীর ১৫ সদস্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে জমা দিয়ে গত ২৩ মে খুলনা র‌্যাব-৬’র সদর দপ্তরে আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের ঠিক আগ-মুহূর্তে এ প্রতিবেদকের মুখোমুখি হন তিনি। জানতে চাওয়া হয় দস্যুবৃত্তির অতীত-বর্তমান।

সংক্ষিপ্ত সময়ের কথোপকথনে জয়নাল আবেদীন ওরফে রাজন বলেন, তিনি নোয়াখালীর দক্ষিণ হাতিয়া উপজেলার উত্তর রেহানীয়া গ্রামের মৃত রবিউল হোসেনের ছেলে। বর্তমানে পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার দক্ষিণ মিঠাখালী গ্রামে বসবাস করেন। তিনি চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে চতুর্থ। সংসারে অভাব-অনটনের কারণে অষ্টম শ্রেণির বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি। যে কারণে অন্যান্য জেলেদের সঙ্গে সাগরে মাছ ধরতে যান। ২০১৩ সালের দিকে জলদস্যু ‘আল-আমিন বাহিনী’র সদস্যরা মুক্তিপণের দাবিতে অন্য জেলেদের সঙ্গে তাকেও অপহরণ করে। পরিবার এবং মৎস্য ব্যবসায়ী কেউ মুক্তিপণ দিয়ে তাকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেয়নি। যে কারণে আল-আমিন বাহিনীর সঙ্গে থাকতে হয় তাকে। এক পর্যায়ে কোস্টগার্ডের অভিযানে আল-আমিন বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে দস্যুতা এবং মাদক আইনে দুটি মামলা দেওয়া হয় তাদের বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও মামলা পরিচালনার খরচ এবং সংসারের ব্যয় যোগাতে তিনি যোগ দেন দস্যু বাহিনীতে। এক পর্যায়ে নিজেই বাহিনী তৈরি করে হন ‘দাদা ভাই বাহিনী’র প্রধান। কিন্তু র‌্যাবের মাধ্যমে সরকার আত্মসমর্পণের সুযোগ তৈরি করে দেওয়ায় তিনি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে আত্মসমর্পণের পথ বেছে নিয়েছেন।

জয়নাল আবেদীন ওরফে রাজন ওরফে দাদা ভাই বলেন, তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চান। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহার না হওয়ায় পুলিশ হয়রানি করে। এতে তারা সব সময় আতংকিত থাকেন। স্বাভাবিক জীবনযাপনের পরিবেশ তৈরিতে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আত্মসমর্পণ মঞ্চে বক্তৃতা করেন।

‘দাদা ভাই বাহিনী’র সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মো. জাকির হাওলাদার বলেন, তিনি বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার সোনাতুনিয়া গ্রামের তাজউদ্দিন হাওলাদারের ছেলে। তিনিও সাগরে মাছ ধরতেন। বিভিন্ন কারণে এলাকায় তার শত্রুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। যে কারণে এলাকায় টিকতে না পেরে ২০১৬ সালের শেষের দিকে তিনি দাদা ভাই বাহিনীতে যোগ দেন।

দস্যুদলে থাকার ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে জাকির বলেন, দস্যু জীবনে প্রতি মুহূর্তে বিপদের আতংকে থাকতে হয়। জীবন থাকে অনিশ্চিত। আত্মসমর্পণ করতে পেরে খুশি তিনি। অন্য দস্যুদেরও আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান তিনি।

এর আগে আত্মসমর্পণ করা মজিদ বাহিনীর প্রধান তাকবির ওরফে মজিদ বলেন, তারা র‌্যাবের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করলেও মামলা থাকায় পুলিশ তাদের হয়রানি করছে। মামলা প্রত্যাহার করা না হলে তাদের স্বাভাবিক জীবনে বেঁচে থাকা কঠিন। তারা আর কখনো অপরাধ জগতে ফিরে যেতে চান না। মুক্ত জীবনে থাকতে চান। কাজ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো থাকতে চান।

সর্বশেষ ২৩ মে সুন্দরবনের ছয়টি বনদস্যু বাহিনীর ৫৭ জন সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে ৫৮টি অস্ত্র এবং ১২৮৪ রাউন্ড গুলি হস্তান্তর করে আত্মসমর্পণ করে।

 

 

রাইজিংবিডি/খুলনা/০৯ জুন ২০১৮/মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়