ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

নিজভূমির বাইরে ঈদে আনন্দ নেই রোহিঙ্গাদের

সুজাউদ্দিন রুবেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৬, ১৬ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিজভূমির বাইরে ঈদে আনন্দ নেই রোহিঙ্গাদের

সুজাউদ্দিন রুবেল, কুতুপালং ক্যাম্প থেকে : সারা দেশের মানুষ যে সময় ঈদ উদযাপনে আনন্দে মাতোয়ারা; সেই সময় নিজভূমি থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের মানবেতর ও দুর্বিসহ জীবনে ঈদ উদযাপনে খুশি নেই।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে সহায়-সম্পদ ছেড়ে আসা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া সিংহভাগ রোহিঙ্গার এবারই প্রথম ঈদ কাটছে নিজভূমির বাইরে ভিনদেশে ভিন্ন পরিবেশে।

যেখানে সাহায্যের পাশাপাশি মানবিকতা আর সহানুভূতি পেলেও জন্মভূমির ঈদ উদযাপনের অতীত দিনে সঙ্গে মিল নেই এবারের ঈদের।

নিজ দেশে জাতিগত স্বীকৃতি আর নাগরিক অধিকারহীন এসব রোহিঙ্গারা বিতাড়িত হয়ে এ দেশে আশ্রয় পেলেও তাদের মানবেতর ও দুর্বিসহ জীবন কাটছে। যেখানে এবারকার ঈদ রোহিঙ্গাদের জীবনে খুশির বার্তা বইয়ে আনতে পারেনি।


প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আশ্রিত জীবনে ঈদ উদযাপনে অধিকাংশ রোহিঙ্গার স্বদেশের স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের দেওয়া ত্রাণের উপর নির্ভরশীল এ সব রোহিঙ্গার অনেকে নগদ টাকার অভাবে বাচ্চাদের ঈদের নতুন জামা-কাপড় কিনে দিতে পারেনি বলে আক্ষেপ করেন।

স্বল্প পরিসরের যে ঘরে থাকছেন তারা, গত কয়েক দিনের টানা ভারি বর্ষণ আর জলকাদায় তাও দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। শনিবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প ঘুরে এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে ঈদ উদযাপনের এমন চিত্র দেখা গেছে।

গত বছর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে থেকে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আসে তারা। সব মিলে  ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে।

ভোরের আলো ফুটতেই সারা দেশের মানুষের মতো ঈদ উদযাপনের সর্বশেষ প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা। রঙ-বেঙয়ের পোশাক পরিহিত শিশু-কিশোররা বেরিয়ে ছুটাছুটি করতে থাকে রাস্তা ও ক্যাম্পের অলিগলিতে।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ঈদ জামাতে নামাজ আদায়ের প্রস্তুতি। সকাল ৮টার পর থেকে ক্যাম্পের বিভিন্ন মসজিদে ঈদের জামাতে শুরু হতে থাকে। ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা ঈদগাহের ব্যবস্থা না থাকায় স্বল্প পরিসরে মসজিদই একমাত্র ভরসা হয়ে উঠে।

তবে সকালে ভারি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় স্বল্প পরিসরের মসজিদের আঙ্গিনায়ও নামাজ আদায় করা গেছে। এতে ঠাসাঠাসি হলেও বেগ পেতে হয়নি।

রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, ঈদ উপলক্ষে প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে ঈদ সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। তা চাহিদার চেয়ে যথেষ্ট নয়।

প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ঈদ উদযাপনে প্রত্যেক রোহিঙ্গা পরিবারের কাছে চাহিদা মতো ঈদ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

কুতুপালং ডি-৫ ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. সালাম (৫০) বলেন, প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে দেওয়া ঈদ সামগ্রী রোহিঙ্গাদের মধ্যে কেউ কেউ পেলেও অনেকে পাননি। যা পেয়েছে, তাও চাহিদার চেয়ে অপ্রতুল।

তবে ঈদ সামগ্রী দিলেও নগদ টাকা না দেওয়ায় ঈদে ছেলে-মেয়েদের জন্য নতুন কাপড়-চোপড়সহ অন্যান্য দরকারি জিনিসপত্র কিনতে পারেননি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

একই ক্যাম্পের আরেক বাসিন্দা গোলবাহার বেগম (৬০) বলেন, ঈদ সামগ্রী হিসেবে চিনি, সেমাই, নারিকেল ও কিসমিস পেয়েছেন। পরিবারের আট ছেলে-মেয়ের মধ্যে ছোট ছয় জনকে কিনে দিতে পারলেও বড় দুই সন্তানসহ অন্যদের জন্য নতুন জামা-কাপড় কিনে দেওয়া সম্ভব হয়নি।

কুতুপালং মধুরছড়া ক্যাম্পের বাসিন্দা রশিদা বেগম (৩০) বলেন, প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে দেওয়া ঈদ সামগ্রী পাননি। তারপরও ঈদ উদযাপনে ছেলে-মেয়েদের জন্য নতুন জামা-কাপড় ও ঈদ সামগ্রী কিনতে প্রতিমাসের ত্রাণ হিসেবে পাওয়া পণ্যের কিছু অংশ বিক্রি করতে হয়েছে।

কুতুপালং মধুরছড়া ক্যাম্পের মো. খলিল উল্লাহ (৫৫) বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে ঝড়ো হাওয়া ও ভারি  বর্ষণের পাশাপাশি ভূমিধসের ফলে বিধ্বস্ত হয়েছে রোহিঙ্গাদের তিন শতাধিক বসতঘর। ক্যাম্পের অনেক বস্তিঘর জলমগ্ন রয়েছে। ঝুঁপড়ি ঘরে ঢুকে পড়ছে বৃষ্টির পানি। ক্যাম্পের হাঁটাচলার পথে কাদায় হওয়ায় দুর্ভোগের অন্ত নেই। 
 

লম্বাশিয়া ক্যাম্পের মাঝি নুরুল আমিন বলেন, স্বদেশে ঈদ উদযাপনের সঙ্গে ভিনদেশের ভিন্ন পরিবেশে ঈদের আমেজ উপভোগ কখনো এক হওয়ার নয়। রোহিঙ্গারা দীর্ঘ দিন ধরে মিয়ানমারে জাতিগত নির্যাতন-নিপীড়নের পাশাপাশি নাগরিক অধিকার বঞ্চিত। এ নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, “চাহিদা মতো সব রোহিঙ্গা পরিবারের কাছে ঈদ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। তারপরও কোথাও গলদ হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”

ভিনদেশের ভিন্ন পরিবেশে এতো বিপুল সংখ্যক আশ্রিত মানুষের কাছে সঠিক মতো সব সহযোগিতা অনেক ক্ষেত্রে যথাসময়ে পৌঁছানো সম্ভব হয় না বলে মন্তব্য করেন জেলা প্রশাসক। 
 

রাইজিংবিডি/কক্সবাজার/১৬ জুন ২০১৮/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ