ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পঞ্চম পঙ্‌ক্তিমালা

মুহম্মদ নূরুল হুদা, মাসুদুজ্জামান, মিনার মনসুর, মারুফ রায়হান, আলফ্রেড খোকন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪১, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পঞ্চম পঙ্‌ক্তিমালা

 



বুকের ভিতর মুখ রেখেছি মুখের ভিতর বুক,

আমরা যখন উতল হাওয়া উনুনে উন্মুখ।

লক্ষজনম উড়ছি ঘুরছি কোন হাবিয়ার ওমে?

জানেন দেবী আফ্রোদিতি কাতুল্লুসের রোমে।

হাজারদুয়ার হাওয়াখানা রাজপ্রাসাদে বাস,

মোগল হেরেম পাহারা দেয় খোজা ক্রীতদাস।

সোনার খাঁচার শুকপাখিটির উড়ে যেতে মানা

সুখ চিরদিন উড়াল ডানা রাতকানা দিনকানা।

ঘরের ভিতর ঘর বন্দি মনের ভিতর মন

ভুবনজোড়া খাজাবাবার ময়ূর সিংহাসন।

শিকারি চোখ মেলছে ডানা জলপদ্মার চরে

মাণিকজোড়ের কেউ ফেরে না হঠাৎ একা ঘরে।

আমার বাড়ি তোমার বাড়ি এককাচারি বাড়ি

জন্মে জন্মে দখলস্বত্ব নিয়ে কাড়াকাড়ি।

তরুমানুষ দাঁড়িয়ে উড়ি বিশ্ব-তপোবন

অঙ্গে অঙ্গে জলতরঙ্গে সৃষ্টি-শীর্ষাসন।

মুখের ভিতর বুক রেখেছি বুকের ভিতর মুখ

আমরা যখন বুকে মুখে দোহনদুখী সুখ।

সাতসমুদ্র তের নদী গহন গতিবিধি

আমি তোমার তুমি আমার গোপন প্রতিনিধি।

তুমি গহন তুমি দহন তুমি আপন-পর

আমি তোমার জলসংসার হঠাৎ ডুবো-চর।

১৮.০৭.২০১৮

 



রাজবাড়ি যাচ্ছি। কোন স্টেশন থেকে উঠবো

তাহলে, স্বপ্নে যদি নাও হয়, সূর্যাস্তে, যখন

বৃষ্টি ও শিশির কাঁধব্যাগের স্ট্র্যাপ ছুঁয়ে ঝলমল

করবে, যখন দ্রুতগামী বাস আর মন্থর ট্রেন

ঘুম থেকে মেঘের দিকে মুখ ঘুরিয়ে জেগে উঠবে।

যেতে হলে দ্রুতই তো যেতে চাই, দিনে অথবা

রাতে, হয়তো জুলাইতে অথবা আগস্টে। তোমার

সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে আছে রাজবাড়ি,

সীমান্তের কাছাকাছি এসে যদি শহরটাকে দেখতে পাও

সে তো আমার পাসপোর্টটাও দেখতে চাইতে পারে

উঠোনের সেই জামরুলগুচ্ছের বুকে অভিমানের ক্ষত

গাছগুলি সেরকমই তো ঝুকে পড়ে দেখবে

কার হাফপ্যান্টে কাদার ছোপ ছোপ চিহ্ন

সুপারি আর নারকোলের ডাল-পোড়ানো ভস্ম

ঝোঁপের মধ্যে পাতার ফাঁকে হিলহিলে সবুজ সাপ

লুকিয়ে গেল। প্যাক করতে হবে, এই বাঁধাছাদা

চলে যাওয়া, দিকচিহ্নহীন, দুপুরে মিলিয়ে যাওয়া

আরিচার ঘাটে বাঁধা বিমর্ষ নৌকোগুলোর মতো

একা। দূরে দিগন্তের দিকে শূন্য আকাশে মেঘকাফে

চুমুকের মুখে ঢেলে দেবে কি বৃষ্টিকফি?

অনন্ত জীবন। কিন্তু নদীপাড়ের বাড়িগুলি

তুমি জানো স্থির, বাড়ির উঠোনে কার ডুরে শাড়ি

উড়ছে, মনে পড়ছে, একটা লাল গামছা, কাঁৎ

হয়ে থাকা মাটির কলসি, খেজুরের পাটিতে

রোদে শুকাতে দেয়া সুপারি ও আমসত্ব,

বাসনাজিভ, কতদিন তুমি শুধু নগরীর মানুষের

কলজে চিবিয়ে অপরিপুষ্ট করেছো এ শরীর।

রাজবাড়ির জন্যে সবসময় একটু বেশিই ভেবেছো

কখনও কেউ যদিও শোনেনি প্রতিটি পাথর থেকে

কী রকমভাবে সূর্যের দিকে রোদ্দুরের গান উপচে পড়ে,

রাত হলে মহুয়া গাছের উপর থেকে

উঁকি দেয় চাঁদ। গাছগুলো পৌরাণিক চরিত্র

হয়ে দাঁড়ায়, নিষ্কম্প পাতার উপরে পাতা

ভালোবেসে ঝুকে পড়ে, বৃষ্টির ফোঁটা ভিজিয়ে

দেয়, তুমি ফুলার রোড ধরে হাঁটতে থাকো

হলুদ হয়ে আসে নীলক্ষেতের বাড়িগুলির জানালা

ব্রিটিশ কাউন্সিলের পাশের ফুটপাতে একদিন

একসন্ধ্যায় তোমাদের মতো দুটো পাখি চুপচাপ

বসে ছিল, মনে পড়ে তোমার সেই বেঁচে ওঠা

কার্জন হলের পেছনের শাদা গথিক ভবনে তোমার

ছবি তুলতে তুলতে দেখি পুকুরের জলে লাফ দিয়ে

তুমি হাঁস হয়ে দলে বেঁধে ভেসে বেড়াচ্ছ, টংঘর,

ধোঁয়া, আগুনের ফুলকি, উষ্ণ চাওমিন আর চা,

ঘরে ফেরো তুমি, তোমার লিকলিকে বুকসেলফে

ঘুমিয়ে থাকা বই, বর্ণবিভা আর কার যেন ঈষৎ স্পর্শ

অনেক কিছুই রেখে গেছো কিন্তু এখন কিছুই নেই

উবু হয়ে জড়ো করা কাপড়চোপড়ের পাশ দিয়ে

ফরফর করে উড়ে যাচ্ছে তেলাপোকা, ডোরার

পাশেই কাফকা চিৎ হয়ে কার্ণিশ দেখছে

ওয়াশ রুম অব্দি যেতে পারলে শরীরটাই চিরে দেবে

জ্বলন্ত রেজর, দাড়ি কাটার আগেই লাফিয়ে উঠে

কর্কষ চিবুক ছুঁয়ে ভেন্টিলেটর গলে উড়ে যাবে

পাশের লিচুবৃক্ষে, মসজিদ আর কলাভবন কাঁপছে,

তোমাকে আমি লাইব্রেরি আর নাটমণ্ডলের সামনে

দেখতে পাচ্ছি না, তুমি হারিয়ে ফেলেছো সেই

ভুবনডাঙা, শাদা রুমাল, কোনো অশ্রু অব্দি নেই

তোমার পাথুরে চোখে, শুকনো মুখ, তোমাকে আমি

দেখতে পাচ্ছি না, কত যে মৃত্যু তোমার অপেক্ষায়

প্রতিটি মানুষের মুখ তোমারই মুখ, প্রতিটি মৃতদেহ

আমারই দেহ, দ্রুত করো, সবকিছু প্যাক করো,

প্রতিটি দিন তুমি নিঃশ্বাসহীন কাটিয়ে দাও, যাও

রাজবাড়িতে, সবুজ চারণভ‚মিতে, আর কিছু নয়

এরই অস্তিত্ব তোমার শরীরজুড়ে, শান্ত কিন্তু

বিশুদ্ধ বিধুর, জামরুলের মতো কিছুটা শুভ্র

সর্বত্রই তুমি একে পাবে, নিঝুম এক রাজবাড়ি।

 



নিষ্কর্মা পুরুষটার মতো আশ্বিনের রোদও তাকে বিদ্ধ করছিল তপ্ত লৌহ শলাকায়। অনন্যোপায় অবলা মা তার সদ্যোজাত সন্তানটিকে আতঙ্কে ছুড়ে দিয়েছিল ফণিমনসার একমুঠো মায়াবী ছায়াতলে। বাচ্চাটা খুব ক্ষুধার্ত ছিল। কাকতালীয়ভাবে রোদ ও ছায়ার ইঁদুর-বিড়াল খেলা তার ক্ষুধা ভুলিয়ে দিচ্ছিল দেখে মা খুব স্বস্তি বোধ করছিল।

আসলে ওটা ছিল বিশাল এক কালকেউটের ফণা- যা ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছিল সূর্যকে। কে না জানে যে সূর্যের সঙ্গে তার আদি বিরোধ! আত্মমগ্ন সূর্য তখন হোলি খেলছিল তার ব্যক্তিগত রংমহলে আর স্বগৌরবে বিলিয়ে যাচ্ছিল রঙের ফোয়ারা। তার ছিটেফোঁটা এসে রাঙিয়ে দিচ্ছিল পরশ্রীকাতরতার বিচিত্র মোজাইকে তৈরি কেউটের তেল চকচকে ফণা। স্বভাবতই সূর্যের উচ্ছ্বাস তার বংশানুক্রমিক হিংসা ও ক্রোধের আগুনে ঘৃতাহুতি করে। সগর্জনে উদ্গীরিত ঘৃণার লাভায় সে ঢেকে দিতে চায় ধরিত্রীর মাতৃগন্ধী মুখ।

কালকেউটের ফণার নিচে ত্রস্ত ইঁদুরের মতো কম্পমান আমাদের দিনরাত্রি!




‘কবিতা লেখো না কেন বহুকাল?’- জিজ্ঞাসাটি যার

চাপা জোড়া নক্ষত্রের পানে তার আড়চোখে দেখি

সতত কবিতা সেইখানে প্রস্ফুটিত ও ঘুমন্ত

ক’ঘণ্টা ঘামছি ইশ! স্নানঘরে আছে কি গিজার?

নিভাঁজ শয্যায় হায় কে পাঠালো বেহেশতের ঢেঁকি

বাইরে হেমন্ত পাঠ করে চলে বোধগম্য মন্ত্র

প্রতিটি চরণ তার ভাঙা হাড়ে যদি দিতো সেবা

এ কথা ভেবেই তুষ্ট, ভাবদেবী ছাড়া আছে কে বা!

 

সপ্তাহচারেক থাকো যদি রোগশয্যায় সটান

বেড়ালের মতো পায়ে পাবে সময়ের ঘোরাফেরা

মুহুর্মুহু ছোবলে ছোবলে ক্লান্ত অদৃশ্য সাপেরা

অন্তিম শ্বাসের মতো তবু অনুভবে সেই টান

যার নাম তারুণ্যে দিয়েছি প্রেম- শুদ্ধ ভালোবাসা

আজ মুছে মুছে যাওয়া, আজ শুধু ভুলে যাওয়া ভাষা

 



দূর সমুদ্রের ওপাড় থেকে সে আসে

নীল জলের উপর দিয়ে

পায়ে হেঁটে হেঁটে

সেই আগন্তুকের ভাষা আমি অনুবাদ করি

নিজ প্রয়োজনে

তোমরা তা পাঠ করো কবিতার নামে;

দূরে বাজে সমুদ্রের স্বর

বেদনার নীল জলে তার কথা লিখি আমি

ঢেউমগ্ন পৃষ্ঠার উপর

রক্তে তরঙ্গ তোলে, গোধূলির নোনা স্বাদ

টান দেয় দেহের ভিতর;

যদি সে তরঙ্গময়ী আমি তবে তার




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়