ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ছোটগল্প || শর্ত

মেহেদী ধ্রুব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১২ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প || শর্ত

|| মেহেদী ধ্রুব ||

পুবপাড়ার দাদুর বুকের ভেতর ফাত্ফাত্ করে। সব খালিখালি লাগে। কী যেন নাই! একটু শান্তির জন্য কতো কী আসে মনে, কিন্তু মনের মতো কিছু আসে না। তবে হঠাৎ করে একটা চিন্তা আসে মনে- জোছনা রাতে এলাকার মানুষকে দাওয়াত করে খাওয়ালে শান্তি সে পেতেও পারে। কিন্তু খাওন-দাওনের আগে একটা শর্ত তিনি দিতে চান। শর্তটা হলো, মানুষকে মনোযোগী শ্রোতা হতে হবে। দাদু একনাগাড়ে বলে যাবেন; যে কোনো ঢঙে, যে কোনো রঙে, যে কোনো বিষয় নিয়ে হতে পারে। আবার শুধু আলাপ-সালাপ বা খোশগল্প কিংবা কিস্‌সাও হতে পারে।

এমন আবদার বা আমন্ত্রণ পেয়ে মানুষের অনেক দিন পর মনে হলো এ পাওয়ার মতোই ব্যাপার। জোছনা রাতে কিস্‌সা শোনার বিনিময়ে পোলাও-মাংস, কোরমা খাওয়ার ঘটনাকে তাদের নতুন কিছু মনে হলো।

দাদুর কথামতো প্রতি মাসের জোছনা রাতে তার বাড়িতে উৎসবভাব বিরাজ করে। উঠানে একটা মঞ্চ বসানো হয়। সেখানে সিংহাসনের মতো চেয়ার থাকে। আশপাশে ঢোল, তবলা, খঞ্জরি, মন্দিরা, বাঁশি বাজানোর লোক থাকে। আলাপ বা গল্প বা কিস্‌সা পরিবেশনের সাথে মিল রেখে বাদ্যযন্ত্রগুলো বেজে ওঠে। যেমন দুঃখের কিছু থাকলে বাঁশির করুণ সুর বেজে ওঠে। যুদ্ধ হলে খঞ্জরি বেজে ওঠে। চমকপ্রদ কিছু হলে ধুমধাম ঢোলে বারি পড়ে। এসব দেখে মানুষ টগবগ করে। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। হাজারো কাম-কাজ, রোগ-শোক, ঝামেলা ফেলে হাজির হয়ে যায়। এক জোছনা রাতে দাদু গল্প বলতে শুরু করেন:

আজ তোমাগোরে একটা গোপন গল্প শোনাবো। এই গোপন গল্পটার মাজেজা বোঝার জন্য আরেকটা ছোটগল্প শোনা দরকার। মনোযোগ দিয়া শোনবা তোমরা। এই যে দুনিয়া দেখতাছো না, যে দুনিয়ার আলো বাতাস খায়া বাইচা আছো, সে দুনিয়াতে তখন অল্প কিছু মানুষ বাস করতো। কোথাও খাওন-দাওনের অভাব নাই। যে যার মতো খায় ঘুমায়, হাঁটে দৌড়ায়, ঘুরে ফিরে। দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি মানুষ যেখানে বাস করতো সেইখানে আরেকটা মানুষ ছিলো। মানুষটা রাজ্যের আইলস্যা। সে খালি শুয়েবসে থাকে। নানান বাহানায় কাজে যায় না- পানি আনতে যায় না, ফলমূল আনতে যায় না, শিকার করতে যায় না। ওই সময় কিন্তু পশুপাখি, মাছ শিকার শেষে পুড়িয়ে খাওয়া হইতো। মানুষটা খালি ফন্দি করে- কেমনে কী করা যায়। হঠাৎ এক ফন্দি আসে তার মাথায়। সে এক কাজ করলো- গুহার ভেতরে, গাছের খোরলে, পাতার নিচে বা ছাল বাকলের নিচে মাছ, মাংস, ফলমূল লুকায়া রাখতে শুরু করলো। এতে দেখা গেলো কারো কাছে কোনো কিছু খাওনের না থাকলেও সে কেমনে জানি খাওন বের করে ফেলতো। তার সমাজের লোকেরা এই চালাকি বুঝতো না। কারণ, তখন মানুষ ছিলো বেকুব, মিছা কথা বলতে পারতো না, চিটারি-বাটপারি জানতো না। তাই অন্যরা ভাবতো ওর মনে হয় দেবতার মতো শক্তি আছে। নইলে ও চাইলেই কেমনে খাওন বের করে ফেলে?

আস্তে আস্তে তার খাওন-দাওন লুকিয়ে রাখার বা চুরি করার নেশায় পেয়ে বসলো। ফলে সে এতো বেশি চুরি করা শুরু করলো যে,  এতো খাওন সে একা খেতে পারতো না। নষ্ট হয়ে যাইতো। তখন তার মাথায় আরেকটা ফন্দি আসে। যারা ক্ষুধার্ত থাকতো বা যারা খাবার সংগ্রহ করতে পারতো না বা যাদের খাবারের দরকার পড়তো, তাদের সে খাবার দিতো শুরু করলো। কিন্তু সে বিনা কারণে খাওন দেবে কেন? তাই যারা খাওন নিতে আসে তারা ওর এটা-ওটা করে দেয়। পানি এনে দেয়। মাথার উকুন মেরে দেয়। গা টিপে দেয়। তারপর শুরু হলো বিরাট বিরাট কাণ্ড!

এই কাণ্ড বলার আগে, গোপন গল্প শুরু করার আগে পশ্চিম থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসে। কী জাদুকরী সুর! সেই সুরে গাছের লতাপাতা, আসমান জমিন গলে যাবে যেন! জোছনা স্থবির হয়ে যাবে যেন! তখন দেবদূতের মতো আস্তে আস্তে হেঁটে আসে একজন সাদা চামড়ার লোক। হাতে রঙধনুর মতো বিচিত্র রঙের লাঠি। এই লাঠি থেকেই বাতাসে মিশে যাচ্ছে সুরের বন্যা। সেই বন্যায় হাবুডুবু খেতে থাকে কতোগুলো প্রাণ। এক সময় লোকটার মুখ খোলে- ‘আপনাদের সমস্যার সমাধান করতে আমার আগমন, আপনাদের সভ্য করে তোলার জন্য আমার আগমন।’ তখন মানুষ গভীর এক মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। লোকটা বলে খাবার নিয়ে চিন্তার কিছু নাই। তার কাছে এমন এক বড়ি আছে যেটা খেলে এক মাস কিছুই খেতে হবে না। শরীরে জোর থাকবে সিংহের মতো; তাগড়া ঘোড়ার মতো ছুটে বেড়ালেও কলিজা সতেজ থাকবে।

মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। নমুনা হিসেবে সাথে সাথে পুব পাড়ার এরশাদ ও দক্ষিণ পাড়ার আফজালকে দেয়া হয় সেই বড়ি। ওরা টপাটপ গিলে ফেলে; নগদে বল অনুভব করে। কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে, কিন্তু তাদের সন্দেহ দূর হতে সাত দিনের বেশি সময় লাগে না। তারপর তারাও বড়ি পাবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।

আবারো একদিন সেই বাঁশির সুর শোনা যায়। তারা আবারো জড়ো হয়। সাদা চামড়ার লোক বড়ি দিতে রাজি হয়, কিন্তু একটা শর্তে। শর্তটা হলো, তাদের ফসলের সব জমি দিয়ে দিতে হবে।

মানুষগুলো অনেক চিন্তা করে দেখে, খাওন-দাওনের দরকার না পড়লে ফসলের জমি দিয়ে কী করবে? তারা দ্বিধার মধ্যে পড়ে, আবার দ্বিধা থেকে বের হয়ে আসে। এক সময় তারা রাজি হয় এবং ক্ষুধা মারার বড়ি নিয়ে বাড়ি যায়। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তারা অনেক হালকা বোধ করে। তাদের মনে ঘাপটি মেরে বসে থাকা সন্দেহের রেণু নিমিষেই উড়ে যায়। তারা একে অন্যের খোঁজখবর নেয়, আলাপ আলোচনা করে, আনাগোনা করে। না, কারো ক্ষুধা লাগে নাই, কারো শরীর একটুও ক্লান্ত হয় নাই, কেউ খাবারের প্রতি টান অনুভব করে নাই। সবার পেট বেশ ভরা ভরা লাগছে। এভাবে দিন শেষ হয়ে যায়। দেখতে দেখতে সাত দিন পার হয়ে যায়। একুশ দিন পার হয়ে যায়। এক মাস হয়ে যায়। কিন্তু এক মাস পার হবার সাথে সাথে সবার ক্ষুধা লাগা শুরু করে। তারা হন্যে হয়ে বড়ি খুঁজতে শুরু করে। লোকটাকে খুঁজতে থাকে। ক্ষুধা মারার বড়ি বা লোকটাকে না পেয়ে খাওন খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও কিচ্ছু নাই। সব জায়গায় কহর পড়ে গেছে, সব জায়গায় কারবালার প্রান্তরের মতো শুষ্কতা। কোনো উপায় না পেয়ে সবাই ছুটে আসে দাদুর দিকে। 

এই কয়দিন দাদু বেশ চিন্তার মধ্যে ছিলেন। যদিও হাজার চেষ্টা করেও তাকে ক্ষুধা মারা বড়ি খাওয়ানো যায় নাই। তার বান্দি দাসীরা পর্যন্ত ক্ষুধা মারা বড়ি খেয়ে বাক্কুম বাক্কুক করেছে, হেলেদুলে নেচে গেয়ে সকাল-বিকাল রান্নাবান্না করেছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তাকে কাত করা যায় নাই। এখন বেশ লাগছে তাকে। মহারাজের মতো ভাব। নিজের চেয়ারে আরাম করে বসে আছেন। ক্ষুধার্ত মানুষগুলো ক্যাচম্যাচ করছে। তবে তারা জানে যে ক্যাচম্যাচ করে লাভ হবে না। আলাপ না করে বুড়ো পাতে খাওন দিবে না। তাই কেউ কেউ বলে ‘দাদু, গপ শুরু করেন।’

দাদু জবাব দেয়, ‘আসল গপ শুরুর আগে একটা গোপন গপ শুনতে হবে, নইলে আসল গপের মাজেজা বুঝবা না তোমরা।’ তারা আর কথা না বাড়িয়ে গোপন গপ শুনতে থাকে : বুঝলা মিয়ারা, তোমগরে আজ একখান গোপন কাহিনি শোনাবো। মন দিয়া শোনবা। অনেক অনেক বছর আগের কথা। একটা জঙ্গলে বাস করতো কিছু মানুষ। তাদের মধ্যে যার বুদ্ধি বেশি ছিলো, যার শক্তি বেশি ছিলো, তাকে সবাই মান্য করতো। বলতে পারো মান্য করার চাইতে ভয় পাইতো বেশি। তার কাজ ছিলো সকাল বিকাল খাওয়া ও নারী সঙ্গম করা। খাওন-দাওন, গায়ে পরার ছাল বাকল, মূল্যবান পাথর, এটা-সেটার বিনিময়ে নারীদের বশ করার ক্ষমতা ছিলো তার। তার প্রতিও নারীদের কামনা বাসনা কম ছিলো না। ক্ষমতাবানের কাছে কে যাবার চায় না কও? তাছাড়া দেখতেও খারাপ ছিলো না লোকটা। পাহাড়ের মতো লম্বা, দুধের মতো সাদা চামড়া, খাড়া নাক! তার একবার মনে হলো, এগারো বছরের যে মেয়েটার সাথে তার ছেলের সম্পর্ক আছে তার সাথে এক রাত কাটানো দরকার। কিন্তু নিজের ছেলের সঙ্গী বলে কথা। কী করা যায়, কী করা যায়- ভেবে পায় না সে। কিন্তু ওই মেয়েটাকে তার চাই। দিশবিশ না পাইয়া লোকটা এক কাজ করে বসলো। একদিন গহীন জঙ্গলে শিকারের সন্ধানে গেলো। বিরাট উঁচু পাহাড়। নিচে কিছুই দেখা যায় না। খালি ইয়া বড়ো বড়ো গাছ! লোকটা সুযোগ বুঝে নিজের ছেলেকে ধাক্কা দিয়া ফেলে দিলো। পরে, লোকালয়ে ফিরে বললো- ছেলেটা পিছলা খায়া পড়ে গেছে। কেউ কিছুই বুঝতে পারলো না। আর বোঝার কথাও না। কও তোমরা কেমনে বুঝবে? আর বুঝলেই বা কী? তাকে কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে। কিন্তু সে তার মনোবাসনা পূরণ করতে পারছিলো না। মেয়েটা কেমন গম্ভীর হইয়া থাকে, আগের মতো তেজ আর নাই। খাওন-দাওন কিচ্ছু নাই। একদিন সুযোগ বুঝে মেয়েটাকে কাছে ডেকে নিলো। ভালো ভালো খাওন দিলো। তারপর গা টিপে দিতো বললো। তখন সময় ছিলো দুপুরের একটু পর। বুঝলা, দুপুরের পরে পুরুষের মাথা খারাপ থাকে। লোকটা মেয়েটাকে কাছে ডাকলো। আরো খাবার ও মূল্যবান পাথর দেবার লোভ দেখায়া জোর করে খায়েশ পূরণ করলো। এরপর থেকে লোকটা খাওন-দাওন ও মূল্যবান পাথরের বিনিময়ে অল্প বয়সের মেয়েদের সাথে কাম কাজে লিপ্ত হতো। কিন্তু মেয়েটাও কেমন হইয়া গেলো। সে খাওন ও মূল্যবান পাথরের বিনিময়ে জোয়ান পোলাদের সাথে মিলিত হইতে লাগলো। বুঝছো কিছু তোমরা? এটা কিন্তু গোপন কাহিনি। এবার তবে আসল কাহিনি শোনো।

আসল কাহিনি শুরু হবার আগে অচেনা বাতাস বয়ে যায়। সেই বাতাসের সাথে মিষ্টি গন্ধ আসে। সেই গন্ধের সাথে মিশে করুণ সুর। সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। বাঁশির সুর শোনা যাচ্ছে। সেই সাদা চামড়ার লোকটা! সাথে সাথে লোকটার কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তারা। স্তব্ধতা ভেঙে পড়ে, আসমান ভেঙে পড়ে জোছনার ফুল, তারা সেদিকে খেয়াল করে না। তারা লুটিয়ে পড়ে পায়ের কাছে। তাদের অবস্থা দেখে সাদা চামড়ার লোকটা মুচকি হাসে। তারা শুধু ক্ষুধা মারার বড়ি চায়। লোকটা বলে, ‘এখন থেকে বড়ি দেয়া যাবে না, তবে বড়ি পাওয়া যায় যে গাছ থেকে সে গাছের বীজ দেয়া যাবে, সে বীজ থেকে এক দিনের মধ্যে চারা হয় আর দুই দিনের মধ্যে সেই গাছের পাতা দিয়ে বড়ি বানানো যায়।’

এবার লোকগুলো খুব বেকায়দায় পড়ে। তাদের তো ফসলের জমি নাই, কোথায় বপন করবে বীজ? তখন সাদা চামড়ার লোক সহানুভূতির সঙ্গে বলে, ‘জমি ধার দেব, কিন্তু একটা শর্ত আছে। শর্ত হলো, তাদের পায়ের নিচে যে পাতাল আছে সেটা দিয়ে দিতে হবে।’

শর্ত শুনে লোকগুলোর খুব হাসি পায়- বলে কী লোকটা! পাগল নাকি! পাতাল কারো হয় নাকি? যান, নিয়ে যান, যা লাগে, যা দরকার, যতো পাতাল মাতাল, যা লাগে, সব। লোকটা একটু হেসে দ্বিতীয় চমকটা দেয়, ‘আপনাদের একটা পানি দিচ্ছি, যে পানি খেলে...।’এটুকু বলে আর কিছু বলে না। কিন্তু আবারো পুব পাড়ার এরশাদ ও দক্ষিণ পাড়ার আফজাল নমুনা হিসেবে পানি পান করে। তারা সাথে সাথে খলখল শুরু করে। তারা কঁচি বাছুরের মতো পাক্কুর পারতে পারতে বাড়ির দিকে ছুটে যায়। সাতদিনের মধ্যে সবাই এই পানির কার্যকারিতা সম্পর্কে সব কিছু জেনে যায়। তাই তারা লোকটাকে খুঁজতে থাকে। সাতদিনের মাথায় লোকটা পশ্চিমের দিক থেকে আসে। হাতে লাঠি, মিষ্টি ঘ্রাণ আর লাঠি থেকে আসে মাতাল করা সুর। তারা পানির জন্য পায়ের কাছে পড়ে থাকে। আবারো লোকটা সহানুভূতির কণ্ঠে বলে, ‘পানি দেয়া যাবে না, কিন্তু পানি বানানোর কৌশল বলে দিতে পারবো।’ লোকগুলো খুশিতে টগবগ করে। কিন্তু লোকটা বলে, ‘এই পানি পেতে পাতাল থেকে ভারী আনতে হবে।’ কিন্তু তারা পাতালে যাবে কীভাবে? পাতাল তো তাদের নাই আর। তখন লোকটা আবারো সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেয়- ‘সমস্যা নাই, আমি পাতাল ধার দিচ্ছি, কিন্তু শর্ত হলো আপনাদের মাথার উপরের আসমান দিয়ে দিতে হবে।’ তারা শর্তের কথা শুনে খিলখিল করে হাসে। এটা কোনো শর্ত হলো ! আসমান কী দিয়ে দেওয়ার জিনিস! লোকটা ঠোঁটের কোণায় হাসি নিয়ে নীরবে চলে যায়।

লোকটা চলে গেলে তারা খুশিতে তেলম তেলম করে। ক্ষুধা মারা বড়ি খেয়ে গায়ে গতরে টিলটিল করে। তারপর তারা পাতাল থেকে ভারী পানি তুলে পানি বানায়া খায় আর শরীর গরম করে। তারা শুধু ছোটে, পুরুষ ছোটে নারীর দিকে, নারী ছোটে পুরুষের দিকে। সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকে। যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ মিশে থাকে। এক একজন আগুনের গোলা হয়ে যায়।

ক্ষুধা মারার বড়ি ও পানি খেয়ে সুখের সীমা নাই। রান্না-বান্নার দরকার পড়ে না, বাজার-ঘাট করার দরকার পড়ে না, ক্ষেতে-খামারে কাম-কাজের দরকার পড়ে না। সারাদিন ঘুমে থাকে, সঙ্গী নিয়ে লুক্কি মেরে পড়ে থাকে। এই ভাবে সারা জীবন গেলে তো আর কোনো কথা ছিলো না। কিন্তু এক মাস পার হয়ে গেলে পুরুষের অঙ্গ নেতিয়ে পড়ে, নারীর শরীর অবশ হয়ে পড়ে। তারা আবারো ছোটাছুটি করে। আবারো দাদুর কাছে ছুটে আসে। দাদু খুশিতে নাচে। কিন্তু তারা বলে যে, ‘খাওন-দাওনের জন্য আসি নাই আমরা।’ ক্ষুধা মারা বড়ি তারা উৎপাদন করতে পারছে, কিন্তু লোকটার দেওয়া পানিতে কাজ হচ্ছে না। তাদের শরীর কাজ করছে না। তারা সঙ্গম করতে পারছে না। ওদিকে লোকটারও দেখা নাই। শরীরের বল পাবার কোনো পদ্ধতি দাদুর জানা আছে কি-না? তখন দাদু কপাল ভাঁজ করে বলে, তার আগে একটা ছোট্ট গল্প শুনতে হবে। লোকগুলো কোনো কূলকিনার না পেয়ে রাজি হয়। দাদু গল্প বলার জন্য প্রস্তুতি নেন:

বুঝলা মিয়ারা, তোমরা তো খালি নগদ লাভ খুঁজো। নগদ জিনিস কিন্তু বেশি দিন টেকে না, ধীরে সুস্থে ভাবো। বুঝছো? আইচ্ছা বাদ দেও। আসল কিস্‌সাতে ঢোকার আগে একখান ছোট্ট কিস্‌সা বলতে চাই। তা শোনবা নাকি তোমরা? তোমাদের তো আবার ধৈর্য নাই। কোত্থেকে এক সাদা চামড়ার লোক আইসা জাদুটোনা করে আর তোমরাও সব ঢলে পড়ো। বুঝবা একদিন মজা। সেই সময় এই বুড়ার কথা মনে পড়বো। কিস্‌সাখান শোনো তাইলে- অনেক অনেক আগের কথা। একটা দ্বীপে বাস করতো কিছু মানুষ। তাদের ছিলো একজন সর্দার। তার ছিলো একটা জাদুর আয়না। এই আয়নাতে কতো কিছু দেখা যাইতো। আসমান জমিন পাতাল কোনখানে কী হচ্ছে। কিন্তু সে সহজে আয়না বের করতো না। তার জন্য অনেক কিছু দিতে হইতো। তার যা মন চাইতো তা-ই দিতে হইতো। কারো বউ ঝি পছন্দ হইছে দিয়ে দাও, কারো পোলাপান পছন্দ হইছে দিয়ে দাও, কারো সুন্দর চোখ পছন্দ হইছে দিয়ে দাও, কারো মাথার চুল পছন্দ হইছে দিয়ে দাও। এই সবের বিনিময়ে দ্বীপের মানুষ আয়নাতে দেখতো নানান রঙ্গ তামাশা, এই ধরো আজকালের নাচ-গানের মতো আরকি। 

কিস্‌সার এটুকু বলার সাথে সাথে বাঁশির সুর শোনা যায়। সাথে সাথে তারা পাগলের মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কেউ কেউ সেই সাদা লোকটার পা চাটতে থাকে। লোকটা আবারো সহানুভূতির চোখ নিয়ে বলে, ‘আপনাদের চিন্তার কোনো কারণ নাই। আপনারা আবারো শরীরে শক্তি পাবেন- আমি পানি বানানোর স্থায়ী পদ্ধতি বলে দিচ্ছি।’ লোকগুলো এবার খুশিতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

সাদা লোকটা আবারো মুচকি হেসে আরো চমক দেয়-‘আপনাদের জন্য বিশেষ উপহার আছে। আপনারা চাইলে এখন থেকে উড়তে পারবেন।’ এই রকম আজব কথা কল্পনাও করে নাই কেউ। কী বলে লোকটা! তখন আবারো নমুনা হিসেবে পুব পাড়ার এরশাদ ও দক্ষিণ পাড়ার আফজাল আসে। হাতের সাথে ফড়িঙের পাখার মতো দুটি পাখা লাগিয়ে দেওয়া হয়। চোখের পলকে তারা উড়তে থাকে। এবার আর কারো মনে সন্দেহ কাজ করে না। কিন্তু তারা বলে, ‘আমাদের তো আসমান নাই, কোনখানে উড়বো?’ উৎকণ্ঠিত মানুষ লোকটার অনুগ্রহ পাবার জন্য পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

লোকটা আবারো সহানুভূতি নিয়ে কথা বলা শুরু করে, ‘আপনারা মনোযোগ দিয়ে শোনেন, আপনারা আপনাদের মাথার উপরের আসমানে উড়বেন। কিন্তু যখন আমি বা আমার প্রতিনিধি নিষেধ করব মানতে হবে।’

এই কথা শেষ হবার সাথে সাথে তারা হাঁ করে তাকায়া থাকে; তাদের বলার মতো কিছু থাকে না। তখন হঠাৎ এক বৃদ্ধ সেই সাদা লোকটার পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। লোকটা বৃদ্ধের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর মুচকি হেসে বলে, ‘আজ আমার ভীষণ আনন্দের দিন। আপনাদের আর কোনো ভয় নাই। আপনাদের আর কোনো শর্ত দেওয়া হবে না। শুধু মনে রাখবেন, যে শর্তগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো যেন বজায় থাকে। এখন থেকে আপনারা সব পাবেন।আপনারা আনন্দের সাথে, সম্মানের সাথে জীবন অতিবাহিত করতে পারবেন।’

লোকগুলো অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। তাদের মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। লোকটার চেহারায় রাজ্য জয় করার আনন্দ খেলা করে। অথচ তারা অজানা অস্বস্তি নিয়ে দেখে, অনেকক্ষণ ধরে যে বৃদ্ধ লোকটার পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে, তাকে পুব পাড়ার দাদুর মতো লাগছে।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়