ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কিশোর গ্যাং

কুমিল্লায় ভয়ংকর হয়ে উঠছে ১০ টি গ্রুপ

নিজস্ব প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কুমিল্লায় ভয়ংকর হয়ে উঠছে ১০ টি গ্রুপ

কুমিল্লায় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কিশোরদের অন্তত: ১০টি গ্যাং-গ্রুপ। এদের হামলায় চলতি বছরে দু’জনসহ প্রাণ গেল কুমিল্লার তিন শিক্ষার্থীর।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুমিল্লা শহরের নজরুল এভিনিউ রোডে ও ঈদগাহ রোডে এই কিশোররা গড়ে তুলেছে কয়েকটি গ্যাং গ্রুপ। যাদের কোনটির নাম ‘র‌্যাক্স’, ‘এক্স সিএমএইচএস’, ‘এলআরএন’, ‘মডার্ণ স্কুল ওয়ান’, ‘মডার্ণ স্কুল টু’, ‘ঈগল’ইত্যাদি।

এই গ্রুপ গুলোর কাজ মূলত বখাটেপনা, হর্ণ বাজিয়ে মোটর সাইকেল চালানো, মেয়েদের উত্যক্ত করা। স্কুল শুরুর সময় থেকে দুপুর পর্যন্ত এবং বিকাল থেকে রাত ৮/৯ টা পর্যন্ত এরা আড্ডা মারে। প্রতি গ্রুপে ২০ থেকে ৩০ জন সদস্য রয়েছে। এই গ্রুপগুলোর সদস্যরা বেশির ভাগই স্কুলের ছাত্র।

স্থানীয়রা জানান, এ সব গ্রুপের সদস্যরা প্রায়ই হর্ণ বাজিয়ে মোটর সাইকেল চালায়। নানা অজুহাতে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, মেয়েদের ইভটিজিং করে।

গত ২১ এপ্রিল রাতে (শবে বরাতের রাতে) ‘তুই’ সম্বোধন নিয়ে সংঘর্ষের জের ধরে নগরীর কান্দিরপাড় এলাকায় সহপাঠীদের ছুরিকাঘাতে মোন্তাহিন ইসলাম মিরন নামে এক স্কুলছাত্র নিহত হয়। মিরন কুমিল্লা মডার্ণ হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। মহানগরীর দক্ষিণ দুর্গাপুরের বিষ্ণুপুর এলাকার সিঙ্গাপুর প্রবাসী আবুল কালাম আজাদের ছেলে।

পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে আটক করে হত্যায় অংশ নেওয়া তিন কিশোরকে। তাদের দেওয়া জবানবন্দি থেকে বের হয়ে আসে ভয়ঙ্কর সব তথ্য। উঠে আসে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠা অন্তত ১০টি গ্যাং গ্রুপের নাম।

এরপর থেকেই নগরজুড়ে আলোচনায় আসে ‘ঈগল’-‘র‌্যাক্স’সহ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠা কিশোর গ্যাং গ্রুপগুলোর নাম।

প্রায়ই এরা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। যার সর্বশেষ শিকার হয়েছে কুমিল্লা মডার্ন হাই স্কুল থেকে সদ্য এসএসসি পাশ করা শিক্ষার্থী আজনাইন আদিল (১৭) । নগরীর মোগলটুলী এলাকার কর্ণফুলী পেপার হাউজের সামনে ছুরিকাঘাতে মারা যায় এই আদিল।

বেপরোয়া হয়ে উঠা কিশোর গ্যাং গ্রুপ ‘ঈগল’ গ্রুপের কিশোররা ১৩ মে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন।

গ্যাং কালচার মডার্ণ গ্রুপের অন্তর্ভূক্ত সহপাঠীদের হাতে কুমিল্লা মডার্ণ হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মিরণ খুনের রেশ না কাটতেই একই গ্রুপের সদ্য এসএসসি পাশ আদিল খুন হলো কুমিল্লা নগরীর পূর্বাঞ্চলের মোগলটুলির ঈগল গ্রুপের হাতে।

নগরীর গাংচর এলাকায় কোতয়ালী থানা পুকুরের সামনের রাস্তা দিয়ে মোটরবাইক চালিয়ে যাচ্ছিল নগরীর পশ্চিমাঞ্চলের ঝাউতলা এলাকার মডার্ণ গ্রুপের আদিল। এসময় মোগলটুলির ঈগল গ্রুপের এক সদস্যের গায়ে আদিলের বাইকের ধাক্কা লাগে। এনিয়ে কথাকাটি হয়। একপর্যায়ে আদিল মোটর বাইক নিয়ে মোগলটুলি কর্ণফুলী পেপার হাউজ এর সামনে পৌঁছলে তার মোটর বাইকের গতিরোধ করে ঈগল গ্রুপের সদস্যরা। তারা আদিলের শরীরে উপর্যপুরি ছুরিকাঘাত করে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নগরীর ঝাউতলার আক্তার হোসেনের ছেলে সাইদুল রক্তাক্ত অবস্থায় আহত আদিলকে প্রথমে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে ও পরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত আদিল কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মহিচাইল এলাকার আব্দুস সাত্তারের একমাত্র ছেলে। এবছর এসএসসি পাশ করা নিহত আদিল তার এলাকায় মডার্ণ গ্রুপ নামে গ্যাং কালচারের সাথে জড়িত বলে জানা যায়।

ওই হত্যাকাণ্ডের পরপরই কুমিল্লায় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠা ‘গ্যাং গ্রুপ’ গুলোর বিরুদ্ধে সাড়াশী অভিযান শুরু করে কুমিল্লা পুলিশ ও প্রশাসন। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে কুমিল্লা কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন গ্যাং গ্রুপের অন্তত ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করে এবং শহরের এসবি প্লাজার তিনটি দোকান থেকে অন্তত সাত'শত আধুনিক ছোরা ও চাপাতি উদ্ধার করে।

এসব ছোড়া আর কখনো বিক্রি করবে না বলে মুচলেকা নেন কোতয়ালী মডেল থানার তৎকালীণ অফিসার ইনচার্জ আবু ছালাম মিয়া।

আর আটককৃত ৩০ জন কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র। তাদের বেশির ভাগই ৭ম ও ৮ম শ্রেণির ছাত্র। পরে অভিভাবকদের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে আটককৃতদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

এদিকে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অনুসন্ধানে কুমিল্লা নগরজুড়ে বেশকিছু কিশোর অপরাধী গ্রুপের তথ্য উঠে এসেছে। বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র গ্রুপ গঠন করে অপরাধ করছে। র‌্যাক্স, এক্স, এলআর এন, সিএমএইচ, মডার্ণ, ঈগল, রকস্টার, ডিস্কো বয়েজ, বস ইত্যাদি নামের বেশ কটি কিশোর গ্রুপ দিনে দিনে বিপদগামী, উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছে। কুমিল্লা মডার্ণ হাই স্কুল, জিলা স্কুল, কালেক্টরেট স্কুল, কুমিল্লা হাইস্কুলসহ নগরীর আরও কিছু স্কুলের অধিকাংশ ছাত্র গ্যাং কালচারে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।

কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) আজিম-উল-আহসান বলেন, ‘এধরনের কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে উঠা একটি সমাজের জন্যে যথেষ্ট উদ্বেগজনক। এদের প্রতিরোধে পুলিশ তৎপর রয়েছে। তবে, প্রতিটি অভিভাবক যদি তার সন্তানের দৈনন্দিন চলাফেরার খোঁজ-খবর রাখেন, তাহলে একটি যুবক কিছুতেই এধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়াতে পারেনা। সুতরাং আমি মনে করি এটি রোধে আগে পরিবার থেকেও দায়িত্ব নিতে হবে। ’

সামাজিক সংগঠন ঐতিহ্য কুমিল্লা’র উপদেষ্টা অধ্যাপক এহেতেশাম হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর সকল দায় দায়িত্ব চাপিয়ে বসে থাকলেই চলবে না। কেননা সবকিছু তাদের একার পক্ষে রোধ করা কঠিন। এর জন্যে অবশ্যই পরিবার থেকেই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা গুলোকে সহযোগিতা করতে হবে এবং নিজেদের সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।

এদিকে গেলো ১০ জুন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মাসিক আইন-শৃংখলা মিটিংয়েও গ্যাং কালচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এসময় জেলা প্রশাসক মোঃ আবুল ফজল মীর, পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলাম গ্যাং গ্রুপ দমনে অঙ্গীকার করেন।

 

কুমিল্লা/জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়