ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

অমানবিকতার শিকার ক্যান্সার আক্রান্ত এক মা

রেজাউল করিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ৯ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অমানবিকতার শিকার ক্যান্সার আক্রান্ত এক মা

সুস্থ অবস্থায় সন্তানদের সঙ্গে হালিমা (বাঁয়ে), অসুস্থ অবস্থায় সন্তানদের সঙ্গে হালিমা

রেজাউল করিক, চট্টগ্রাম : চার বছর আগেও তার সাজানো একটি সংসার ছিলো। স্বামীর ভিটেতে নিজের টাকায় গড়া একটি দোতলা বাড়ি ছিল। স্বামী-সন্তান নিয়ে আনন্দমুখর পরিবেশে ভালোবাসায় দিন কাটতো তারও। কিন্তু হঠাৎ করেই তার জীবনে নেমে এলো অমানিশার অন্ধকার।

হালিমা কায়সার। বয়স ৪২ পেরিয়েছে। দুই সন্তানের জননী তিনি। ব্যবসায় বড় অংকের লোকসান দিয়ে তার স্বামী নিরুদ্দেশ হয়েছেন চার বছর আগে। এরপর জীবনযুদ্ধে একাই লড়তে গিয়ে মুখোমুখি হন নানা অমানবিকতার।

এরই মধ্যে শরীরে বাসা বেধেছে জীবননাশী ক্যান্সার। স্বামী নিরুদ্দেশ হওয়ায় শ্বশুর বাড়িতে নিজের তৈরি করা বাড়ি থেকেও বিতারিত হয়েছেন। স্বামীর ভাই বোনরা বাড়ি দখলে নিতে রীতিমত দুই পুত্রকন্যাসহ এই নারীকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছেন। এখন এই অসহায় মা একদিকে যুদ্ধ করছেন ক্যান্সারের সঙ্গে। অন্যদিকে যুদ্ধ করছেন দুই শিশু সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য। যুদ্ধ করছেন সামাজিক নিষ্ঠুর অমানিবকতার সঙ্গেও। ঘটনাটি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের মীর বাড়ি গ্রামের। হালিমা রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের মৃত আবু মোহাম্মদ কায়সারের মেয়ে।

বুধবার দুপুরে ঢাকায় চিকিৎসাধীন হালিমার সঙ্গে মুঠোফোনে  কথা হয়। রাইজিংবিডির সঙ্গে আলাপকালে হালিমা কায়সার বলেন, ভালো পরিবার আর স্বামীর সামাজিক অবস্থা সব কিছু দেখেই আমাকে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই রাউজান উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের মীরবাড়ির এসএম খায়ের আহমেদের ছেলে এসএম কায়ছারুল আলমের সঙ্গে বিয়ে হয় আমার। স্বামী একজন প্রতিষ্ঠিত আবাসন ব্যবসায়ী ছিলেন। ভালোয় কাটছিলো দাম্পত্য জীবন।

 


বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর গোয়াল ঘরে আশ্রিত হালিমা ও তার মেয়ে

 

তিনি জানান, এর মধ্যে তার একটি মেয়ে ও একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। তাদের মধ্যে ১৩ বছর বয়সী বড় মেয়ে সোহানা কায়সার অষ্টম শ্রেণিতে ও ১১ বছর বয়সী ছেলে এস এম কাফায়েতুল আলম ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। এমন সুখের সংসারে ২০১২ সালে হঠাৎ করেই আঁধার নামে। ব্যবসায় বড়ধরনের লোকসান দিয়ে হালিমার স্বামী ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে আকস্মিকভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এরপর থেকে স্বামীর আর কোনো খোঁজ পান না হালিমা। দুটি সন্তানকে নিয়ে নিজেই জীবনযুদ্ধ শুরু করেন ২০১২ সালের জুলাই থেকে।

হালিমা কায়সার বলেন, স্বামী নিরুদ্দেশ হলেও শ্বশুর বাড়িতে ভালো থাকার প্রয়োজনে সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমার বাবার কাছ থেকে টাকা এনে আমার শ্বশুরের ভিটাতেই স্বামীর জায়গায় একটি দ্বিতল বাড়ি নির্মাণ করি। এই বাড়িতেই এতোদিন সন্তানদের নিয়ে বসবাস করে আসছিলাম। এরই মধ্যে আমার জীবনে নেমে আসে নতুন দুর্যোগ। ২০১৬ সালের মে মাসে আমার শরীরে ধরা পড়ে দূরারোগ্য ক্যান্সার। ওভারী থেকে ক্যান্সারের শুরু হলেও এখন তা লিভারেও ছড়িয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, ক্যান্সারের সঙ্গে আমার নতুন যুদ্ধ শুরু হয়। বাবার বাড়ি এবং নিকট আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধারকর্য করে শুরু হয় আমার ক্যান্সারের চিকিৎসা। বর্তমানে আমি ঢাকা ডেল্টা ক্যান্সার হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. নাহিদা ও ডা. পারভিনের অধীনে চিকিৎসাধীন রয়েছি।

হালিমা বলেন, ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হতে না হতেই আমার ওপর শুরু হয় শ্বশুর পক্ষের নিষ্ঠুর অমানবিকতা। আমার ক্যান্সারের চিকিৎসায় শ্বশুর পরিবার, দেবর ভাসুর কেউ কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করাতো দূরের কথা তারা আমার টাকায় গড়া বাড়ি দখলে নিতে ওঠে পড়ে লেগে যায়। সর্বশেষ গত বছরের ৭ ডিসেম্বর আমার দেবর জাহেদ, জাবেদসহ স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী মিলে দুই সন্তানসহ আমাকে মারধর করে বাড়ি থেকে জোরপূর্বক বের করে দেয়। পরে পুরো বাড়িটি দখল করে নেয় তারা। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর প্রথমে একটি গোয়ালঘরে আশ্রয় নিই। এরপর শ্বশুর বাড়ির পাশেই একজন আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করছি। এখানে থেকেই ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসা-যাওয়া করছি।

 


হালিমার দুই সন্তানের সঙ্গে কথা বলছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামিম রেজা

 

হালিমা আরো বলেন, আমি এখন পুরোপুরি একজন অসহায় মা, অসহায় নারী। আমি চরম সামাজিক নিষ্ঠুরতার শিকার। আমাকে বাড়ি থেকে সন্তানসহ বের করে দেওয়ার পর আমি প্রতিকার চেয়ে রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছিলাম। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামিম রেজা গত কয়েকদিন পূর্বে আমার ওপর এমন আচরণের কথা জেনে সশরীরে আমাদের আশ্রয়দাতার বাড়িতে যান। আমার দুই সন্তানের সঙ্গে কথা বলেন। দুই সন্তানকে সান্ত্বনা দিয়ে সুবিচারের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এ ব্যাপারে আগামী ১১ মার্চ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

এই ব্যাপারে হালিমার দেবরের দুটি মুঠোফোন নম্বরে অনেকবার চেষ্টা করেও বন্ধ থাকায় কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

এ প্রসঙ্গে রাউজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামিম রেজা বলেন, ঘটনাটি জানার পর আমি নিজেই ওই দুই ছেলে-মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। এই সময় দুই সন্তানের মা ঢাকায় চিকিৎসাধীন থাকায় ওনার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। আমি দুই সন্তানের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তাদের আশ্বস্ত করেছি।

এ ব্যাপারে ১১ মার্চ হালিমার শ্বশুর পক্ষের লোকজনকে বৈঠকে ডেকেছি। উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান।



রাইজিংবিডি/চট্টগ্রাম/৯ মার্চ ২০১৭/রেজাউল/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়