ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু

আবুল কাসেম ফজলুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩০, ১৪ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু

|| আবুল কাসেম ফজলুল হক ||
ঘটনা-পরম্পরায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় স্বাভাবিক গতিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা বিকশিত হতে থাকে। সেটি ছিল পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ছাত্র-তরুণ, প্রগতিশীল লেখক-শিল্পী এবং প্রগতিশীল রাজনীতিকরা এ চিন্তাধারাকে এবং রাজনৈতিক আন্দোলনকে বিকশিত করে। শেখ মুজিবুর রহমান তখন আওয়ামী মুসলিম লীগে ছিলেন। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের অনেক বিষয় জানা যায়। তা ছাড়া আবুল মনসুর আহমদ, বদরুদ্দীন উমর এবং আরও অনেকের লেখা থেকে এ বিষয়ে অনেক কিছু জানা যায়। আইউব খানের সামরিক শাসন ও পরবর্তী ঘটনাবলির কারণে রাজনীতির স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য স্পষ্ট হয়। পাশাপাশি পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির কৃত্রিম চেষ্টাও অব্যাহত রাখা হয়। তখন অল্প দিনের মধ্যেই পাঞ্জাবি কর্তৃত্বের প্রশ্ন সামনে চলে আসে।

এর আগে ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পরিবর্তন করে ‘আওয়ামী লীগ’ নাম গ্রহণ করে। ১৯৫৫ সালে সোহরাওয়ার্দি আওয়ামী লীগের সদস্য হয়ে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাগমারি সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে মওলানা ভাসানীর মতবিরোধ হয়। সোহরাওয়ার্দি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের বিরোধী এবং পাকিস্তানের জন্য শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে। আর ভাসানী ছিলেন ক্রমাগত প্রবলভাবে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপনকারী ও পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। ভাসানী ছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রবল সমর্থক।

অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দি ছিলেন মার্কিন নীতির সমর্থক এবং মস্কো ও পিকিংয়ের নীতিবিরোধী। কাগমারি সম্মেলনে এ বিরোধ প্রকাশ পায়। সম্মেলনের কিছু পরে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে যায় এবং মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের একাংশ নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখন সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে আওয়ামী লীগে থেকে যান এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। সোহরাওয়ার্দির ভূমিকার কারণে তখন আওয়ামী লীগ থেকে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হতো না।

১৯৬২ সালের শেষে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের অনুকূলে বক্তব্য প্রদান করতে থাকেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয় দফা কর্মসূচি প্রচার করেন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা ছয় দফা মেনে নেননি। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ ও ছাত্রলীগের নেতাদের দৃঢ় সমর্থনের ফলে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচিকে দলীয় কর্মসূচি রূপে গ্রহণ করে। ছয় দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান অসাধারণ জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। মওলানা ভাসানী এবং বামপন্থীরা তখন উপযুক্ত রাজনৈতিক ভূমিকার অভাবে পেছনে পড়ে যান।

১৯৬৮ সালে ছয় দফা আন্দোলনকালে আইউব সরকার ‘State versus Sheikh Mujibur Rahman and others’ নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে এক পর্যায়ে মামলার আসামীদের বিরুদ্ধে বিশেষ আদালতে মামলা শুরু করে। মামলার নাম প্রথমে ছিল `State versus Lieutenant Commander Monayem Hossain and others'. এ মামলার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনোভাব অত্যন্ত প্রবল হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি এবং ক্রমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রতি জনসমর্থন প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে। বামপন্থী কোনো কোনো গ্রুপ তখন স্বাধীন পূর্ববাংলা নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করতে থাকে। ছাত্রলীগের একটি গ্রুপও তখন স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করতে থাকে। ১৯৬৮ সালের শেষে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান শুরু হলে ৬৯-এর ফেব্রুয়ারিতে আইউব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা উঠিয়ে নিতে এবং আসামিদের নিঃশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তখন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রমনা রেসকোর্স ময়দানে জনসভার আয়োজন করে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করে। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি ‘মুজিব ভাই’ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে উপকূল অঞ্চলে ঘটে যাওয়া সাইক্লোনের পর মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে পর পর দুটি জনসভা করে পাকিস্তানকে নাকচ করে দিয়ে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য দলমত নির্বিশেষে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হত্যাযজ্ঞের রাতে বঙ্গবন্ধু নিজের বাড়িতে থেকে যান। তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে আটক করে ইসলামাবাদ নিয়ে যায়। তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লি ও  মস্কোর সহায়তা নিয়ে বিশ্ব-জনমত জয় করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাজউদ্দীন সরকারই মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদান করে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব ও সফল হতো না। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতার কোনো কোনো অংশ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রচার করা হয়। ছয় দফা আন্দোলনকালে আওয়ামী লীগ দলটির সাংগঠনিক দিক দিয়ে ভেতর থেকে যেভাবে সংগঠিত হওয়ার দরকার ছিল, সেভাবে সংগঠিত হয়নি। এটা ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ও মুক্তিযুদ্ধের একটি দুর্বলতা। মুক্তিযুদ্ধকালে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের উদ্যোগে মওলানা ভাসানীকে চেয়ারম্যান করে একটি সর্বদলীয় জাতীয় উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করা হয়েছিল। তাজউদ্দীন সরকার ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আগাগোড়া বিরোধিতা করার জন্য এবং যুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করার জন্য মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী ও পিডিপি- এই চারটি রাজনৈতিক দলকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করেছিল।

সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়েই তাজউদ্দীন সরকারকে কাজ করতে হয়েছে। এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজনে তাজউদ্দীন সরকার মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জয়েন্ট কমান্ড গঠন করে। জয়েন্ট কমান্ডের প্রধান ছিলেন লে. জেনারেল অরোরা, আর মুক্তিবাহিনীর প্রধান ছিলেন কর্নেল ওসমানী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জয়েন্ট কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়। সে অবস্থায় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামাবাদ থেকে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ঢাকা আসেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তাজউদ্দীনকে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী করেন। যে সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে তাজউদ্দীনকে কাজ করতে হয়েছিল, সেই দুর্বলতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকেও কাজ করতে হয়েছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর সরকারের মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠনে তিনি সম্মত হননি। তখন সেনাবাহিনীর ভেতরে ঐক্য দৃঢ় হয়নি। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিরোধী দল হিসেবে জাসদ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী ও পিকিংপন্থীরা সরকারবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। মোজাফফর আহমদ ও মস্কোপন্থীরা এক বছর সরকারের বিরোধিতা করে এবং পরে সরকারকে সমর্থন দেয়। দেশে দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা প্রবল হয়ে ওঠে। নানারকম অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপও দেখা দেয়। দিল্লি-মস্কোর সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুর সরকারকে বিপন্ন করার নানাবিধ চেষ্টা চালাতে থাকে।

সে অবস্থায় বন্যার কারণে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতার জন্য ১৯৭৪ সালে দেশে একটি বড় দুর্ভিক্ষ হয়। তখন বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য এবং জনজীবনের সমস্যাবলি সমাধানের জন্য বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর প্রতি দ্বিতীয় বিপ্লবের আহ্বান জানিয়ে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে গঠন করেন একদলীয় ব্যবস্থা ‘বাকশাল’। বাকশাল জনসমর্থন পায়নি। বাকশালের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রতি রুষ্ট হয়। এর আগে তিনি তাজউদ্দীনকে মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারিত করেন। বাকশালের কার্যক্রম চলতে থাকে। এরই মধ্যে নেমে আসে সেই শোকের রাত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সে রাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে মূল ষড়যন্ত্রকারী খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দখল করেন। এর কয়েকদিন পরে ৩ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি মোশতাকের আদেশে কারাগারে বন্দি সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। এর ফলে যে অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় তাতে মোশতাক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু দুর্ভাগ্য জেনারেল ওসমানী তখন মোশতাকের পক্ষে কাজ করেন।

আমাদের জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলন এবং তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী তাজউদ্দীনের সুযোগ্য পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায়। রাষ্ট্র, জাতি ও জনগণের উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়োজনে তৎকালীন ইতিহাসকে গভীরভাবে জানা এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা বাঙালি হিসেবে আমাদের অবশ্যকর্তব্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ এবং তাঁদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল নেতাকে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। বঙ্গবন্ধু দল বিশেষের নেতা নন; তিনি জাতীয় নেতা, আমাদের সকলের নেতা, তিনি চিরকাল স্মরণীয়।

লেখক: অধ্যাপক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়