ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

শহীদ আসাদের ভাস্কর্যের সমাধান হোক ইতিহাসের স্বার্থেই

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১০ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শহীদ আসাদের ভাস্কর্যের সমাধান হোক ইতিহাসের স্বার্থেই

শহীদ আসাদের পোট্রেট এবং চুরি হয়ে যাওয়া গণজাগরণ ভাস্কর্য

হাসান মাহামুদ : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ঊনসত্তরের জনগণের আন্দোলন যে কেবল ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল তাই-ই নয়, এর মাধ্যমে আইয়ুব খানের শাসনামলে সাধিত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যথার্থ রূপটিও পৃথিবীর সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়ে। এই গণঅভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ আসলেই সর্বপ্রথমে যে নামটি মনে আসে, তা হলো শহীদ আসাদ।

শহীদ আসাদ বাংলাদেশের এক উজ্জল প্রেরণার নাম। বাঁধভাঙা জোয়ারের প্রতীক। ন্যায় ও প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক ‘শহীদ আসাদ’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ত্বরানিত হয়েছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ১৯৬৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে ছাত্র-জনতার এক সমাবেশে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র আসাদুজ্জামান। আসাদের এই আত্মত্যাগ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে আরো বেগবান করে। পরবর্তীতে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার আইয়ুব খানের পতন হয়। সেদিনের সেই আন্দোলন পরবর্তীতে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই শহীদ আসাদ অজানা। শহীদ আসাদ আসাদের পুরা নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তিনি ১৯৮২ সালের আজকের দিনে (১০ জুন) হাতিরদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আলহাজ্ব মাওলানা মোহাম্মদ আবু তাহের বিএবিটি হাতিরদিয়া সাদত আলী হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে তখন কর্মরত ছিলেন। সাবেক ঢাকা জেলার, বর্তমানে নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামের এক ঐতিব্যবাহী সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম তার।

১৯৬৯ সালের পরের বছর থেকেই বাংলাদেশে ২০ জানুয়ারি ‘শহীদ আসাদ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে দিনটি একটি স্মরণীয় দিন। ১১ দফা দাবিতে প্রায় ১০ হাজার ছাত্রের বিশাল মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পুলিশি বাধার মুখে পড়ে। আসাদসহ কিছু ছাত্র ছত্রভঙ্গ মিছিলটি আবার সংগঠিত করে ঢাকা হলের (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময়ই পুলিশের গুলিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের সড়কে আসাদ শহীদ হন।

আসাদ ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি। আসাদের মৃত্যুতে আন্দোলনের অগ্নিশিখা জ্বল উঠে। শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে পরদিন রাজধানী ঢাকায় বের হয় স্মরণকালের বৃহত্তর শোক মিছিল, যে মিছিলের সামনে ছিল শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট।বিক্ষোভের নগরীতে পরিণত হয় প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা। আসাদের মুত্যুর প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে বের হওয়া মিছিলটি প্রায় দু’মাইল দীর্ঘ হয়। আসাদের রক্ত আর বিক্ষুদ্ধ জনতা সেই সময়ই ছুটে যায় মোহাম্মদপুর তৎকালীন আইয়ূব গেটের সামনে এবং প্রতিবাদের ক্ষুদ্ধ প্রতীক হিসাবে আইয়ূব গেটের নামফলক গুড়িয়ে দিয়ে রক্ত দিয়েই লেখে আসাদ গেট। সেই থেকে মোহাম্মদপুর আসাদ গেটের জন্ম।

১৯৯২ সালে শহীদ আসাদের স্মরণে নির্মিত হয় ভাস্কর্য ‘গণজাগরণ’। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরী বিভাগের গেটের উত্তর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) উদ্যোগে আসাদের স্মৃতিকে অমর করে তুলতে এবং গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে জাগ্রত রাখতে গণজাগরণ নামে নির্মিত হয় আসাদের স্মৃতিস্তম্ভ। শিল্পী প্রদ্যোত দাস এ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়া ও আসাদ স্মৃতি পরিষদের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী’র উপস্থিতিতে এ ভাস্কর্য উদ্বোধন করেন শহীদ আসাদের বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার রশিদুজ্জামান। নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যেই কর্তৃপক্ষের অবহেলায়  ভাস্কর্যটি কাত হয়ে পড়ে। এরপর সেখান থেকে এটি উধাও হয়ে যায়। 

অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ভাস্কর্যটি হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কার্যত কোনো পদক্ষেপই কোনো সরকার নেয়নি। এই তো কয়েকদিন আগেই সুপ্রিম কোর্টের সামনের ভাস্কর্যটি নিয়ে কতকিছু ঘটে গেল। কিন্তু শহীদ আসাদের ভাস্কর্যটি নিয়ে কোনো পক্ষই কথা বলে না। যে উপলক্ষ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের জাতীয় গৌবর, তাকে আমরা কতটা সহজেই ভুলে আছি।

প্রতি বছরই জানুয়ারির ২০ তারিখে বাঙ্গালী জাতি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গভীর শ্রদ্ধায় শহীদ আসাদ দিবস পালন করে থাকে। কিন্তু তার ভাস্কর্যটির বিষয়ে আলোচনা ওঠে না। আমরা চাই, হারিয়ে যাওয়া ভাস্কর্যটির প্রকৃত কারণ উদঘাটন করা হোক। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এ জন্য প্রয়োজনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। এ অভ্যুত্থানের পরিণতিতে শুধু আইয়ুব খানের পতন ঘটেনি বরং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল আইয়ুব খানের শাসনামলে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী আন্দোলন। এটি শুরু হয়েছিল সরকারি নির্যাতনবিরোধী একটি সাধারণ লড়াই হিসেবে। কিন্তু অচিরেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে রূপ নিয়ে তা ছড়িয়ে পড়েছিল দেশময়। আন্দোলনের চরিত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে গণজাগরণের মধ্য দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের তাৎপর্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। গণআন্দোলন সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গেলেই বলতে হয় ১১ দফার কথা। এ কর্মসূচির ফলে ছাত্র সমাজ স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধ ও দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন।

লেখক: সাংবাদিক।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জুন ২০১৭/হাসান/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়