ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ফিল্ম রিভিউ

কেন ‘ভয়ংকর সুন্দর’ বোঝা গেল না

মোহাম্মদ নূরউল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৬, ৯ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কেন ‘ভয়ংকর সুন্দর’ বোঝা গেল না

‘ভয়ংকর সুন্দর’ সিনেমার একটি দৃশ্য

মোহাম্মদ নূরউল্লাহ: রাজধানী ঢাকায় খাবার পানির সংকট ভয়াবহ। এই সংকট আজকের নয়। পৃথিবীর অপরিকল্পিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এর জনসংখ্যা। সংবাদমাধ্যমে সকল প্রকার প্রতিষ্ঠান থেকে আমাদের নীতি নির্ধারকদের সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এখন তো এক হাজার ফুট নিচেও পানি পাওয়া যায় না। আমি নিজে এই শহরে আছি আশির দশকের শুরু থেকে। জ্ঞান হবার পর থেকেই  পানির সংকটের কারণে আমি নিজেও ভুক্তভোগি। আমার পরিবারের লোকজনকে রাতে বা ভোরে যখন পানি আসতো, তখন গোসল করা বা কাপড় ধোয়ার কাজ করতে দেখেছি। আমি নিজে প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে আট-দশ লিটার পানি নিয়ে এসেছি নব্বইয়ের দশকে।

এখন বড় বড় এপার্টমেন্টগুলোতে বিশাল পানির হাউস তৈরি করা হয়েছে। হাউসে নিজস্ব মটর লাগানো থাকে। ফলে ওয়াসার পানি এপার্টমেন্টের লোকজন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পায়। আমাকে হয়তো আর পানি বহন করে নিয়ে আসতে হয় না, কিন্তু পরিস্থিতি এখন আরো ভয়াবহ! সরকার বিভিন্ন সময় হাজার কোটি টাকা বাজেটে বিভিন্ন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে, তাতে পানির সংকটের চরিত্র গত তিন দশকে বদলায়নি। ওয়াসার পানির লাইন পরিকল্পনা করে নষ্ট করা হয়েছে বোতলজাত পানির বাজার তৈরির জন্য- এসবই আমরা পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি। নদীমাতৃক দেশে খাবার পানির সংকট- ভয়ংকর দুঃখজনক!

যাই হোক, পানি নিয়ে এই আলোচনা শুরুর কারণ হলো, অনিমেষ আইচ তার ‘ভয়ংকর সুন্দর’ সিনেমায় এই সামাজিক সংকট তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি আশা করেছেন যে, সিনেমাটি দেখে ঢাকার লোকজন যদি পানির অপব্যবহার কমায় তবে একটা সার্থকতা তৈরি হবে। সমালোচকেরা যখন একটা সিনেমা বিচার করেন, সিনেমার গল্প, বিষয়, বলার ধরন ইত্যাদির সঙ্গে দর্শকের উপর সিনেমার প্রভাবও বিচার করেন। অনিমেষের অবশ্যই এটা একটা ভালো উদ্যোগ যে, তিনি খাবার পানির এই সংকটের কথা সেলুলয়েডে তুলে ধরেছেন। এতে যদি সমাজের লোকজন পানির অপচয় রোধ করেন, ওয়াসা যদি অজুহাত দেখানো বন্ধ করে ঢাকাবাসীকে আন্তরিকভাবে পানির সরবরাহ করে, সরকার যদি প্রজেক্টে বাজেটের চেয়ে কার্যকরী বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ দেয়- সত্যিই তা মিরাকল হবে। এই সিনেমা যদি মানুষের মনে কোনো প্রভাব না-ও ফেলে তবুও বিষয়টি এভাবে সিনেমায় তুলে আনার জন্য অনিমেষের ধন্যবাদ প্রাপ্য।

এবার সিনেমাটির প্রসঙ্গে আসি। মতি নন্দীর লেখা গল্প ‘জলের ঘূর্ণি ও বকবক শব্দ’ অবলম্বনে অনিমেষ তৈরি করেছেন ‘ভয়ংকর সুন্দর’। বাংলা ভাষার সাহিত্য থেকে অনেক সার্থক সিনেমা তৈরি হয়েছে- পথের পাঁচালী, দেবদাস, ইতি শ্রীকান্ত এমন অনেক নাম বলা যাবে। সাহিত্য থেকে সিনেমা হলে তুলনামূলক আলোচনার অবকাশ তৈরি হয়। যদিও দুটি আলাদা মাধ্যম। আলাদা প্রকাশশৈলী। গল্প চিত্রায়িত করতে গিয়ে প্রাথমিক জটিলতা যেখানে তৈরি হয় তা দৈর্ঘ্য। সিনেমা হলে চলার জন্য সিনেমাকে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার হতে হয়। কারণ লোকজন টাকা দিয়ে টিকেট কেটে সিনেমা দেখতে যায়। তাই একটা নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য দেয়া হল মালিকদের জন্য জরুরি। গল্পের ক্ষেত্রে যত পৃষ্ঠা লাগে প্রিন্ট হতে, তার উপর ভিত্তি করে একটা দাম হয়। কোয়ালিটির ওপর নির্ভর করে দাম হয় না। সিনেমার ক্ষেত্রে সেই দৈর্ঘ্য নির্মাতাকেই করতে হয়। তাই গল্পকার যে কোয়ালিটিতে তার গল্পের বুনন তৈরি করেন, ফিল্মমেকার যদি সমান মেধা নিয়ে চিত্রনাট্য তৈরি করতে না পারেন, তবে তা বিভিন্ন জায়গায় দুর্বলতা তৈরি করে। দর্শক গল্পে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অনিমেষ এক দিক থেকে এগিয়ে আছেন যে, গল্পটা বেশিরভাগ লোকেরই পড়া নেই। তবুও বাণিজ্যিক সাফল্যের ক্ষেত্রে এই সিনেমার হোচট খাবার আশংকা প্রবল।

গল্পটা প্রসঙ্গে একটু ধারণা নেয়া যাক। বরিশাল থেকে লঞ্চে ঢাকায় এসে নয়নতারা পুরান ঢাকার একটা হোটেলে ওঠে। দেখা হয় হোটেল বয় মুকুর সাথে। টিনএইজ পার না হওয়া মেয়েটা পরিবারের সাথে অভিমান করে ঢাকায় আসে। মুকুর সেবা তার ভালো লাগে। মুকুরও তাকে ভালো লাগে। হোটেলে খারাপ লোকের ‘এটেম্প টু রেপ’ থেকে মুকু নয়নকে উদ্ধার করে নিয়ে পালায়। তারপর শুরু হয় তাদের ঢাকায় বেঁচে থাকার সংগ্রাম। বিরাট বড় লোকের আল্লাদি মেয়ে নয়ন, কিভাবে ঢাকার এক বস্তিতে থাকে, এতিম, নিচু শ্রেণীর শ্রমিক মুকুকে বিয়ে করে, তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে  সিনেমায়।

আমরা আমাদের সাধারণ দর্শকদের বোকা ভাবি। ধরে নেই ওরা অনেক কিছু বুঝতে পারে না। কিন্তু ভুলে যাই যে, সকলেরই আধুনিক কালের মানসম্পন্ন সিনেমা দেখার চোখ আছে। এখন যে তরুণ দর্শক প্রজন্ম, ভালো সিনেমা বোঝার জন্য এখন আর তাদের ফিল্ম এপ্রেসিয়েশন কোর্স করার দরকার পড়ে না। আর ভয়ংকর সুন্দর সিনেমার মধ্যে এমন কোনো বিশেষ কিছু চোখেও পড়েনি। তাই দর্শকদের মূল সমালোচনার জায়গা সবসময়ই গল্প ও অভিনয়। সিনেমার গল্পে প্রচুর দুর্বলতা রয়ে গেছে। অনেক ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না- কেনো ঘটলো বা কেনো ঘটলো না বোঝা কষ্টদায়ক। যেমন নয়নকে রেপ করতে চাওয়ায় মুকু পাড়ার গুন্ডার মাথায় আঘাত করে নয়নকে নিয়ে পালায়। পাড়ার গুন্ডার চরিত্রে অভিনয় করেছেন সমাপ্তি মাসুক। আঘাত পাওয়ার পর, সে মারা গেল কি না- ঠিক বোঝা গেল না। এবং এই ঘটনার কোনো প্রতিক্রিয়া বাকি সিনেমাজুড়ে কোথাও নেই। মূল পুরুষ চরিত্র মুকু অর্থাৎ পরমব্রত যে চরিত্র অলংকৃত করেছেন, তাকে শুধু এতিম বলে ছেড়ে দেয়া হলো, তার কোনো অতীত দর্শক দেখতে পেল না। এমন অসংখ্য ফোকর রয়ে গেছে গল্পের উপস্থাপনায়। সব তুলে আনতে গেলে লেখা অবৈধ রকম বড় হয়ে যাবে।

অভিনয়ে পরমব্রত একেবারেই হতাশ করেননি। বাকি সকলের অতি অভিনয়ের ডামাডোলে পরমব্রত সত্যিই অসাধারণ। নয়নের চরিত্রে ভাবনা অনেকাংশে ভালো করেছে। গল্প ও গল্পের প্রেক্ষাপটে ভাবনাকে পরিচালক যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে পরিচালকের বাণিজ্যিক সাফল্যের ব্যাকুলতা স্পষ্ট হয়েছে। সৈয়দ হাসান ইমামসহ অন্য অভিনেতারা তাদের সাধারণ অতি অভিনয়ের মাত্রা তাদের মতো করে প্রকাশ করেছেন। অন্যান্য সিনেমা বা নাটকের চেয়ে বিশেষ আলাদা কিছু চোখে পড়েনি। কারগরী দিক থেকে চিত্রগ্রহণ বেশ ভালো। সংগীত, শব্দগ্রহণ, আলোক বিন্যাস আয়োজন মুটামুটি ভালো। অন্তত সমসাময়িক আরো দশ-বারোটা সিনেমার চেয়ে এর কারিগরী দিক প্রশংসাযোগ্য। অন্যান্য কারিগরী ত্রুটি, ঠিক সিনেমার কর্মী না হলে কারো চোখে পড়ার কথা নয়। আর এসব নিয়ে দর্শকেরা খুব একটা মাথা ঘামায় না।

যে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে আমি আলোচনা করতেই চাই, সিনেমার বিষয় যেহেতু পানি সংকট তাই প্রথম শট নদীর পানি থেকে টিল্টআপ করে লঞ্চ দেখানো খুবই প্রাসঙ্গিক। নদীমাতৃক দেশে খাবার পানির সংকটের গল্প- এরচেয়ে ভালো ভাবনা আর কী হতে পারে? কিন্তু দুঃখজনক বিষয়, টাইটেলের আগে তিনটি সিকোয়েন্সের মাধ্যমেও আসলে গল্পের বিষয়বস্তু বোঝা যায় না। সেই তিনটি সিকোয়েন্সের এমন কোনো গুরুত্বও চোখে পড়েনি যে, টাইটেলের আগে সেগুলোর জায়গা দিতে হবে। পরিচালক হয়তো এসব কিছু ভাবেননি।           

নয়নের প্রতি বস্তির অন্যান্য মহিলাদের আক্রোশের দৃশ্যের চিত্রায়ণ দুর্বল হলেও দৃশ্যটির প্রশংসা করতে চাই। দরিদ্রদের ধনীদের প্রতি আক্রোশটা এমনই ভয়ংকর। যদিও এতো কিছু করেও পানি সংকটের বিষয়টি পরিচালক ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। নদীমাতৃক দেশে মিঠা পানির সংকট দেখানো খুবই কঠিন কাজ। পানি সংকট দেখাতে মুকু ও নয়নের পানি পানের দৃশ্য খুবই হাস্যকর মনে হয়েছে। বারবার মনে হয়েছে, শুধু পানি খেয়েই বেঁচে আছে ওরা। বুড়িগঙ্গার পানি নষ্ট হবার বিষয়টি এখানে আসা খুবই প্রাসঙ্গিক ছিলো। সর্বোপরি, বিশেষ করে চিত্রনাট্যের প্রতি অবহেলা খুবই চোখে পড়েছে। আর সিনেমার নাম কেন ‘ভয়ংকর সুন্দর’ বোঝা গেল না।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়