ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হিমশীতে মায়ের সঙ্গে রাজপথে শিশুরাও

আহমদ নূর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৫, ১১ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হিমশীতে মায়ের সঙ্গে রাজপথে শিশুরাও

আহমদ নূর : তৃষ্ণার বয়স তিন বছর। আগে সকালের নাস্তার পর থেকে শুরু করে তার দিন পার হতো খেলাধুলা আর আনন্দে। দিনের বেশিরভাগ সময় মিষ্টি সব দুষ্টুমিতে বাড়ি মাতিয়ে রাখত সে। অথচ তৃষ্ণার এখন রাত পার হয় রাস্তায় ঘুমিয়ে, সকালের ঘুম ভাঙে যানবাহনের বিরক্তিকর শব্দে।

গত বছর যখন শীত দরজায় কড়া নেড়েছিল, মা কোহিনূর আক্তার ব্যস্ত ছিলেন তৃষ্ণার স্বাস্থ্য সুরক্ষায়। অথচ এখন কোহিনূর আক্তারও সেই সুযোগ পাচ্ছেন না।

তৃষ্ণার বিরক্তিকর সকাল আর মায়ের স্নেহের ঘটতি উপলব্ধি করতে পারছেন গাইবান্ধার দুর্গাপুরের মাদরাসা শিক্ষিকা কোহিনূর আক্তার। তিনি কখনো চিন্তা করেননি তার মেয়ে রাস্তায় ঘুমাবে। আর ছোট্ট শিশু তৃষ্ণাও বুঝতে পারছে না কেন হিমশীতে সে রাস্তায় রাত কাটাচ্ছে। কেনই বা দিনে যানবাহনের বিরক্তিকর শব্দ, মানুষের কোলাহল আর ধুলাবালির সঙ্গে থাকতে হচ্ছে। তবুও তৃষ্ণার তৃপ্তি এক জায়গায়, সে তো মায়ের সঙ্গেই আছে।

দেশের সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষক সমিতির ব্যানারে আন্দোলন করছেন শিক্ষকরা। গত ১ জানুয়ারি থেকে শিক্ষকরা এখানে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষকরা কোনো সাড়া না পেয়ে গত মঙ্গলবার (৯ জানুয়রি) শিক্ষকরা আমরণ অনশনে যান।

শিক্ষকরা বলছেন, তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বেন না। অনশন চালিয়ে যাবেন।



এই আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে শুরু থেকেই আছেন কোহিনূর আক্তার। যখন আন্দোলনের জন্য ঢাকায় আসেন তখন তিন বছরের মেয়ে তৃষ্ণাকে ফেলে আসতে পারেননি।

রাইজিংবিডির এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে কোহিনূর আক্তার বলছিলেন গত ২৪ বছরে শিক্ষকতা করেও অবহেলিত থাকার কথা।

‘২৪ বছর ধরে দুর্গাপুর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসায় শিক্ষকতা করছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো দিন কোনো বেতন-ভাতা পাইনি। আমার এক ছেলে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। স্বামীর উপার্জনে সবার খরচ চলে না। সরকারি বেতনের আওতায় আসব, এই আশায় মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেছিলাম। কিন্তু এতদিনেও সরকারের কাছ থেকে কোনো কিছু পাইনি। একপ্রকার মানবেতর জীবন পার করছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘দাবি আদায়ে আন্দোলন অনেকদিন ধরে করছি। এবার ঢাকায় আসার আগে কোলের শিশুকে রেখে আসতে পারিনি। তাকে রেখে আসতে মন সায় দেয়নি। মেয়েকে নিয়ে কষ্ট করে এখানে আছি। সরকারের কেউ কি আমাদের এই কষ্ট দেখেন না? উপলব্ধি করেন না?’

তৃষ্ণা এখনো বুঝে না সে এখানে কেন এসেছে। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে মায়ের কোলে মুখ লুকানো আর মায়ের সঙ্গে এসেছি ছাড়া অন্য কিছুই বলতে পারেনি।

শুধু কোহিনূর আক্তরই নয়, শিশুসন্তান নিয়ে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন আরো বেশ কয়েকজন শিক্ষিকা। তারা বলছিলেন প্রচণ্ড শীতে মানুষ যখন তাদের শিশুদের উষ্ণতায় রাখার চেষ্টা করেন তখন তাদের শিশুদের জন্য মাতৃকোলের উষ্ণতাই হয়ে উঠেছে একমাত্র ভরসা। এর পরও তাদের প্রত্যাশা, এবারের আন্দোলনে তাদের আর শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে হাহাকার করতে হবে না। সরকার তাদের অবশ্যই স্বীকৃতি দেবে।

চার বছরের ছেলে মাহিমকে নিয়ে ভোলা থেকে আসা শিক্ষিকা কামরুন নাহার আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অন্তত আমাদের সন্তানদের কথা বিবেচনা করে আমাদের স্বীকৃতি দিন। এতদিন ধরে আমরা অভুক্ত থেকে আসছি। আমাদের দিকে একটু মুখ তুলে তাকান।’



তিনি আরো বলেন, ‘সরকার যদি আমাদের দাবি না মানে তাহলে আমরা এখানেই মরব, কিন্তু অনশন ভাঙব না। আমার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দাবি মেনে নেবেন। তিনি যদি আমাদের দাবি না মানেন তাহলে রাস্তায় মরব, কিন্তু বাড়ি ফিরে যাব না।’

আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একই পরিপত্রে ১৯৯৪ সালে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণ করা হয় ৫০০ টাকা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি ৫ম শ্রেণির কার্যক্রম একই হলেও ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে সরকার। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি মাসে ২২ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতন হলেও ১ হাজার ৫১৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা সরকারের থেকে কোনো বেতন পান না।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ জানুয়ারি ২০১৭/নূর/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়