ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অগ্রণী ব্যাংকে ৯০০ কোটি টাকার ঋণে অনিয়ম, দুদকের অনুসন্ধান

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৮, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অগ্রণী ব্যাংকে ৯০০ কোটি টাকার ঋণে অনিয়ম, দুদকের অনুসন্ধান

এম এ রহমান মাসুম: রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ১৯ শাখা থেকে ৯০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণে অনিয়মের তথ্য মিলেছে। বাংলাদেশ  ব্যাংক পরিচালিত অডিটে বেরিয়ে আসা ওই অনিয়মের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

যদিও দেশের ২৬টি প্রতিষ্ঠানকে ঋণের নামে দেওয়া এমন অনিয়মকে মন্দ ঋণ বলছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। আর ওই অনিয়মের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।

বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির ওই অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে অনুসন্ধানের সিন্ধান্ত নেওয়া হয় কমিশন থেকে। এর পরপরই নিয়োগ দেওয়া হয় অনুসন্ধান কর্মকর্তা। দুদকের উপপরিচালক এ কে এম মাহবুবুর রহমানকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনুসন্ধানের বিষয়টি রাইজিংবিডিকে নিশ্চিত করেছেন। অনুসন্ধানের দায়িত্ব পাওয়ার পর উপপরিচালক মাহবুবুর রহমান ইতিমধ্যে অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত নথিপত্র তলব করেন।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামস-উল-ইসলাম বরাবর পাঠানো চিঠিতে যে সব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হয়েছে সেগুলোর বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত, বিভিন্ন সময়ে দেওয়া ঋণের পরিমাণ, ঋণের শর্ত ও ঋণের বর্তমান পরিস্থিতি, বাংলাদেশ কর্তৃক অডিট আপত্তিসহ অনিয়ম এবং দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করা হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে শেষ সপ্তাহে এই তলব করা হয়েছিল।

এ বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকটি চাওয়া নথিপত্রের অধিকাংশ এখনো দুদকের পৌঁছেনি। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার তাগিদপত্রও দিয়েছেন দুদক কর্মকর্তা। আর যে সকল কাগজ দুদকে এসেছে তার যাচাই-বাছাই চলছে। যাচাই-বাছাই শেষে ঋণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হবে বলে দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে দুদক সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিন রাইজংবিডিকে বলেন, ‘অনুসন্ধান কেবল শুরু হয়েছে। এখনো অনুসন্ধান চলমান। এ অবস্থায় কোনো মন্তব্য করা যাবে না।’

অভিযোগের বিষয়ে দুদক জানায়, অগ্রণী ব্যাংকের ১৯টি শাখা থেকে ২৬টি প্রতিষ্ঠানকে ঋণের নামে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়। বিপুল পরিমাণ এ অর্থ আদায় না হওয়ায় বর্তমানে মন্দ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে- যা আদায়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। অগ্রণী ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালিত বিশদ পরিদর্শনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায়, অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সেন্ট্রাল অ্যাকাউন্টস ডিভিশনে পেনশনের টাকা নিয়ে অনিয়ম করা হয়েছে। ৩০২ কোটি টাকা বিল হিসেবে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকটি। এছাড়া একই ডিভিশন থেকে ব্যাংকের ২৫৩ কোটি টাকা শেয়ারবাজারের অতালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করায় পুরো অর্থই ক্ষতির সম্মুখীন। এর বাইরে ব্যাংকের বি-ওয়াপদা কর্পোরেট শাখায় সাড়ে ৩৭ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম করা হয়েছে। আলভি স্পিনিং মিলসের কাছে ব্যাংকের পাওনা এসব টাকা আদায় অনিশ্চিত এবং ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ পাওনা আদায়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। একই শাখায় আরও প্রায় ৪ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম করা হয়েছে। মেসার্স ডোমার স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজের অনুকূলে দেওয়া এসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ, সীমাতিরিক্ত ও ক্ষতিমানে শ্রেণিকৃত। ঋণ আদায়ে ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, টাকা আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, অগ্রণী ব্যাংকের রমনা কর্পোরেট শাখার ৩ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে নিয়ে গেছে প্রায় ৫২ কোটি টাকা। এগুলো হল- আহমেদ স্পিনিং মিলসের অনুকূলে ৩০ কোটি টাকা, রবি ফ্যাশনের অনুকূলে প্রায় ৬ কোটি এবং মেসার্স হেলেনা এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে ১৬ কোটি টাকা। একইভাবে আমিন কোর্ট কর্পোরেট শাখার ৪ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে নিয়েছে প্রায় সাড়ে ৫৪ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলো হল- মেসার্স প্যান্ডোরা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ৬ কোটি টাকা, মেসার্স বেস্ট ট্রেড লিংকের অনুকূলে সাড়ে ২৪ কোটি, মেসার্স রেদোয়ান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ১৪ কোটি, ইউনি অ্যালায়েন্স জুট ইন্ডাস্ট্রিজের অনুকূলে ১০ কোটি টাকা। এসব ঋণের পুরোটাই আদায় অনিশ্চিত হয়ে মন্দ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট ডিভিশন-১ এর গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স লীনা পেপার মিলসের অনুকূলে প্রায় সাড়ে ৪৪ কোটি টাকা, ঢাকার চক বাজার শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স শহীদ স্টোরের অনুকূলে ১ কোটি টাকা, গ্রিনরোড কর্পোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মৌরিশাস ইন্টারকন্টিনেন্টালের অনুকূলে ৩৪ কোটি টাকা, কক্সবাজার শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স কর্ণফুলী সি ফুডসের অনুকূলে সাড়ে ৪ কোটি, পুরানা পল্টন কর্পোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স গ্লোবাল জুট ইন্ডাস্ট্রিজের অনুকূলে প্রায় ১২ কোটি, শান্তিনগর শাখার গ্রাহক মোসাম্মৎ তাহমিনা ইসলামের অনুকূলে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি, সদরঘাট কর্পোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স জুয়েল ক্লথ স্টোরের অনুকূলে দেড় কোটি, বরগুনা শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান এমআর ট্রেডিং কোংয়ের অনুকূলে প্রায় ৬৫ কোটি, ঢাকার ওয়াসা কর্পোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান অ্যাপোলো ফার্মাসিউটিক্যালস ল্যাব. লিমিটেডের অনুকূলে প্রায় ৩ কোটি, ঢাকার শ্যামলী শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স ডিজিটাল ব্রিকস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের অনুকূলে প্রায় ৬ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম করা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে পুরাতন গাড়ি ঠিক করার নামে প্রায় ২০ লাখ টাকার নয়ছয়, কম্বল ক্রয়ের নামে প্রায় দেড় কোটি টাকার অনিয়ম।

যদিও ওই অনিয়মকে বেশ পুরাতন উল্লেখ করে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এসব অনিয়ম পুরনো। তাছাড়া এক দিনে তা সংঘটিত হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ভাবে অনিয়মগুলো হয়েছে। অডিটে যেসব অনিয়ম বেরিয়ে আসছে তা সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়