ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সেই রাতের বর্ণনা দিলেন হাসনাতের স্ত্রী

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০০, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সেই রাতের বর্ণনা দিলেন হাসনাতের স্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলায় সেই রাতের বর্ণনা দিয়েছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমের স্ত্রী শারমিনা পারভীন।

বুধবার ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমানের আদালতে সাক্ষ্য দেন তিনি। ওই রাতে নিহত এসি রবিউল ইসলামের ভাই মো. শামসুজ্জামান ও তার খালাত ভাই মোল্লা মো. আনোয়ারুল আমিনও সাক্ষ্য দিয়েছেন।

শারমিনা পারভীন জবানবন্দিতে বলেন, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত ৮টার দিকে স্বামী, ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় যাই। মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সেখানে আমরা ডিনার করতে যাই। হলি আর্টিজানের হল রুমের শেষের টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে থাকি। মেন্যু দেখে খাবারের অর্ডার দেই। এর ৩/৪ মিনিট পর ৩/৪ জন অস্ত্রসহ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করে। তারা গুলি করতে থাকে। এরপর আমাদের টেবিলের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে আমরা মুসলিম কি না? আমরা মুসলমান জানালে তারা বলে, আপনারা মুসলমান আপনাদের কোন ক্ষতি করব না। আপনারা মাথা নীচু করে টেবিলে বসে থাকুন।

তিনি বলেন, বেকারীতে গ্লাস ঘেরা রুমে আনুমানিক ৮-১০ জন বা তার বেশি ফরেনার বসা ছিলেন। তাদের ওপর তারা গুলি করা শুরু করে। তারা আমাদের বলে, আপনাদের ছেলে-মেয়েদের চোখ-কান বন্ধ করে রাখেন যেন তারা কোন কিছু দেখতে বা শুনতে না পাই। আমি তাদের চোখ-মুখ বন্ধ করে রাখি।

তিনি আরো বলেন, কিছুক্ষণ পর তারা একটা ছেলে, দুটো কম বয়সী মেয়েসহ চারজনকে আমাদের টেবিলের কাছে নিয়ে আসে। আমাদের সারারাত মাথা নীচু করে টেবিলে বসিয়ে রাখে। বারান্দার একটা লাইট বাদে হলরুমের সব লাইট বন্ধ করে দেয়। রাত দেড়টার দিকে একজন ওয়েটার এবং একজন ফরেনারকে বের করে নিয়ে আসে। ওয়েটারকে সরিয়ে ফরেনারকে সরাসরি গুলি করে। আর আমাদের আশে-পাশে পড়ে থাকা ডেড বডিগুলো ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়। রমজান মাস, যখন সেহরির সময় হয়, তখন তারা আমাদের সেহরির ব্যবস্থা করে।  পরিস্থিতি খাবার উপযোগি ছিল না। তারা বারবার আমাদের জিজ্ঞাসা করে, খাচ্ছি না কেন? তারা ধমক দেয় তাই এক কামড় খাবার খেয়েছিলাম। এরপর রাতে আমাদের অস্ত্রের মুখে বসিয়ে রাখে।

শারমিনা পারভীন বলেন, ভোরে আমার স্বামী এবং আরেকটি ছেলে তাহমিদকে ছাদে নিয়ে যায়। এরপর তাদের আবার টেবিলে এনে বসায়। আমার স্বামীকে চাবি দিয়ে বাইরের গেটের তালা খুলে আসতে বলে। তালা খুলে আসার পর বলে আপনারা এক এক জন করে বের হয়ে যান। বের হয়ে আসার আগে মোবাইলসহ যা যা নিয়েছিল তা ফেরত দেয়। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে প্রথমে আমরা আটজন বের হয়ে আসি। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের নিরাপদ হেফাজতে নিয়ে যায়। পরে আমাদের ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

নিহত এসি রবিউল ইসলামের ভাই মো. শামসুজ্জামান তার সাক্ষ্যে বলেন, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে জানতে পারি আমার ভাই হলি আর্টিজান বেকারিতে দুষ্কৃতকারীদের হামলায় আহত হয়েছেন। তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়ার খবর জানতে পেরে সেখানে গিয়ে তাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পাই। বুকের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। পরে জানতে পারি গুলি ও স্পিøন্টারের আঘাত।  

এরপর রবিউল ইসলামের খালাত ভাই মোল্লা মো. আনোয়ারুল আমিন সাক্ষ্য দেন। তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেন।

এনিয়ে এ মামলায় ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলো। মামলার আসামিদের মধ্যে প্রথম ছয়জন কারাগারে আছেন। এদিন তাদের কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। মামলার অপর দুই আসামি পলাতক রয়েছেন।

এ মামলার আসামিরা হলেন- হামলার মূল সমন্বয়ক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা ওরফে র‌্যাশ, ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবি নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক শাখার প্রধান মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ।

উল্লেখ্য, এ মামলার পলাতক আসামি মামুনুর রশিদকে গত ১৯ জানুয়ারি রাতে গাজীপুরের বোর্ডবাজারের একটি বাস থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এরপর তাকে রাজধানীর সবুজবাগ থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় আদালত তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত তাকে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি।

পলাতক আরেক আসামি শরিফুল ইসলামকে গত ২৫ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন রাজধানীর মুগদা থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনের এক মামলায় আদালত তার ছয় দিনের রিমান্ড শেষে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানন্দি দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত তাকেও গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি।

মামলাটিতে গত ৮ আগস্ট আট আসামির বিরুদ্ধে দাখিল করা চার্জশিট গ্রহণ করেন আদালত। চার্জশিটে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমের বিরুদ্ধে ওই ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য-প্রমান না পাওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর গত ২৬ নভেম্বর আট আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।

এর আগে গত ২৩ জুলাই তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম বিভাগের পরিদর্শক হুমায়ূন কবির এ মামলার চার্জশিট দাখিল করেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/মামুন খান/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়