ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কালো টাকা উদ্ধারের উদ‌্যোগ চায় অর্থনীতি সমিতি

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৫, ৯ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কালো টাকা উদ্ধারের উদ‌্যোগ চায় অর্থনীতি সমিতি

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক: দেশে পুঞ্জীভূত কালো টাকার আনুমানিক পরিমাণ হবে ৫ লাখ কোটি থেকে ৭ লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ উদ্ধারে আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে সরকারের পদক্ষেপ চায় বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।

মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচার জাতীয় রাজস্ব র্বোডের (এনবিআর) প্রাক-বাজেট আলোচনা সভায় অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আবুল বারকাত এ দাবি করেন। এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এনবিআরের একাধিক সদস্য ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পাশাপাশি অর্থনীতিবিদ ও পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

আলোচনা সভায় পরোক্ষ করের চেয়ে প্রত‌্যক্ষ করে জোড় দেওয়া, তুলনামূলক ধনীদের থেকে কর আদায়ে বেশি নজর, রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ‌্যতামূলক করা, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ হিসেবে দেখে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা,  অব‌্যাহতিবহুল কর ব‌্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা, শুল্ক ও ভ‌্যাট হ্রাস-বৃদ্ধিতে বৈষম‌্য ও দরিদ্রতা হ্রাসের বিষয়টি অগ্রাধিকার, টেবাকো স্ল‌্যাব না থাকা, রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধি করাসহ এক গুচ্ছ প্রস্তাব উপস্থাপনা করে সমিতি।

প্রস্তাবগুলোর মধ‌্যে উল্লেখযোগ‌্য হলো-

রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে নতুন উৎস খোঁজা:
বাজেটে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা মোট ২২টি নতুন উৎস নির্দেশ করেছি যা অতীতে ছিল না। সরকারি আয় বৃদ্ধির নতুন এসব উৎসের মধ্যে থাকবে অর্থপাচার রোধ থেকে আহরণ, কালো টাকা উদ্ধার থেকে আহরণ, বিদেশী নাগরিকদের উপর কর, বন্ড মার্কেট, সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্ব, সেবা থেকে প্রাপ্তি কর, সম্পদ কর, বিমান পরিবহন ও ভ্রমণকর, তার ও টেলিফোন বোর্ড, টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, ইনস্যুরেন্স রেগুলেটরি কমিশন, সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিআইডাব্লিউটিএ, বেসরকারি হাসপাতাল অনুমতি নবায়ন ফিস, সরকারি স্টেশনারি বিক্রয়, পৌর হোল্ডিং কর ইত্যাদি। এর মধ্যে নতুন খাত ‘বন্ড মার্কেট’ এবং ‘সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্ব’। প্রস্তাবিত এ দুটি নতুন উৎস থেকে পাওয়া যাবে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা যা ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ ঘাটতি অর্থায়ন পূরণ করতে সক্ষম (যা মোট রাজস্ব প্রাপ্তির ১৪ দশমিক ৭ শতাংশের সমপরিমাণ)।

শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর হ্রাস অথবা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়:
যৌক্তিক বা অযৌক্তিক যাই হোক না কেন, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি মনে করে, শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর হ্রাস অথবা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ৫টি বিষয় সরকারের বিবেচ্য হতে হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য অসমতা হ্রাস, ন্যয্যতা প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য নিরসন ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করা।

কর প্রশাসনের আওতা জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নেওয়া প্রয়োজন। তথ্য-প্রযুক্তির প্রয়োগে এ কাজ সম্পাদন করা সম্ভব। বিষয়টি বাজেট প্রণয়ণে বিবেচনা করা যেতে পারে।

অব্যাহতি বহুল কর ব্যবস্থা:
অব্যাহতি বহুল কর ব্যবস্থা থেকে মুক্তি কর ব্যবস্থা যেন অব্যাহতি বহুল না হয় সে লক্ষ্যে পদক্ষেপসমূহ বলা জরুরি।

রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা:
সকল রিটার্নধারীর (ব্যক্তিগত এবং কোম্পানি) রিটার্ন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত এবং প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট ফি প্রদানের মাধ্যমে নবায়ন করার প্রচলন যুক্তিযুক্ত হবে। এ দেশে রিটার্নধারী মানুষের সম্ভাব্য সংখ্যা হওয়া উচিত কমপক্ষে ৫০ লাখ।

বৃহৎ করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি:
এ দেশে ১০০-এর কম ব্যক্তি বছরে ১ কোটি টাকা বা তদুর্ধ্ব ব্যক্তিগত আয়কর প্রদান করেন। আমাদের হিসেবে বছরে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা বা তদুর্ধ্ব ব্যক্তিগত আয়কর দেওয়ার যোগ্য মানুষের সংখ্যা হবে কমপক্ষে ৫০ হাজার। অর্থাৎ এ শ্রেণি থেকেই ব্যক্তিগত আয়কর হিসেবে বছরে কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকা আহরণ সম্ভব। আশা করবো বিষয়টি আসন্ন বাজেটে বিবেচনা করা হবে।

সিগারেট, বিড়ি ও ধোয়াবিহীন তামাকজাত পণ্যে অধিকহারে আবগারী শুল্ক আরোপ:
বর্তমান মোট ১৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে সিগারেটের কারণে ৬০ লাখ এবং বিড়ির কারণে ২৪ লাখ অকালমৃত্যু রোধ করা যাবে। সিগারেটের কয়েক স্তর বিশিষ্ট মূল্য স্তর বাতিল করে প্রতি ১০ শলাকার সিগারেটের উপর কমপক্ষে ৬০ টাকা আবগারী শুল্ক, প্রতি ২৫ শলাকার বিড়ির উপর ১৫ টাকা আবগারী শুল্ক, আর প্রতি ১০০ গ্রাম ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্যের উপর ১৫০ টাকা আবগারী শুল্ক আরোপ করা হোক। একইসঙ্গে আমরা মনে করি যে, বর্তমানে তামাকজাত পণ্যের বিক্রয়মূল্যের উপর যে ১ শতাংশ হারে হেলথ সারচার্জ আছে তা বাড়িয়ে ২ শতাংশ করা উচিত। আহরিত হেলথ সারচার্জ থেকে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করা সম্ভব।

কর-রাজস্ব ফাঁকি রোধ:
ভ্যাট ও ট্যাক্স খাতে আদায়ের বর্তমান কাঠামো অর্থনীতির পরিবর্তিত কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ কাঠামোতে দেখা যায় যথাক্রমে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎসে কর্তন সূত্রে ৪৫ দশমিক ৫০%, পণ্য খাতে ৪৭% এবং সেবা খাতে ৮ দশমিক ১৫%। অপরদিকে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিগত ৯ মাসের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় গত ৯ মাসে আয়কর খাতে উৎসে কর্তন ৬৪ দশমিক ৩২%, ব্যক্তি খাতে ৯ দশমিক ৯৩% এবং প্রতিষ্ঠান খাতে ২৫ দশমিক ৭৩% আদায় হয়েছে। আমরা মনে করি ভ্যাট এবং কর আদায়ের কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি।

দুর্নীতি প্রতিরোধে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান, সংস্থার সঙ্গে লেনদেন

দুর্নীতি প্রতিরোধে রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বশীলদের রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান, সংস্থার সঙ্গে লেনদেন নিষিদ্ধ করতে হবে। এ নীতি ভঙ্গকারীদের শাস্তির বিধান করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ বা ‘শূন্য সহনশীলতার’ নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।

কালো টাকা উদ্ধার:
দেশে পুঞ্জীভূত কালো টাকার আনুমানিক পরিমাণ হবে ৫ লক্ষ কোটি থেকে ৭ লক্ষ কোটি টাকা। এ অর্থ উদ্ধার প্রয়োজন। একদিকে এমন কোনো পথ-পদ্ধতি অবলম্বণ করা উচিত হবে না যার ফলে সৎ ব্যক্তিরা ভবিষ্যতে অসৎ হতে প্রণোদিত হতে পারেন। আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে আমরা ২০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ কালো টাকা উদ্ধারের প্রস্তাব করছি।

অর্থপাচার রোধ:
দেশ থেকে এখন বছরে ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমান অর্থপাচার হচ্ছে। বাজেটে এ সমস্যা সমাধানের পদ্ধতিগত নিদের্শনা থাকতে হবে। আমরা অর্থপাচার রোধ থেকে আগামী অর্থবছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায়ের প্রস্তাব করছি। মাদক চোরাচালানীদের বিরুদ্ধে চলমান সরকারি উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন করা।

কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার:
জমি-জলা-জঙ্গল সম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আমরা মনে করি যে আসন্ন বাজেট বছরেই কৃষি ও কৃষক ভাবনার যর্থাথতা বিচারে ১ লক্ষ ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে কমপক্ষে ২ লক্ষ বিঘা কৃষি খাস জমি বন্দোবস্ত দ্রিয়া সম্ভব। পাশাপাশি ২০ হাজার জলাহীন প্রকৃত মৎস্যজীবী পরিবারের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ হাজার বিঘা খাস জলাশয় বন্দোবস্ত দেওয়া সম্ভব। বিষয়টি বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দসহ বাস্তবায়ন কৌশল সংশ্লিষ্ট পথ নির্দেশনা প্রদান জরুরি।

তামাক চাষ নিরুৎসাহিতকরণ:
কৃষি জমির বাণিজ্যিক ব্যবহার যা খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে বিশেষত: তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে বাজেটে আর্থিক নিদের্শনা থাকা জরুরি।

ক্রমবর্ধমান মানব বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা দূরীকরণ:
এদেশে ক্রমবর্ধমান মানব বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা ও বহুমুখী দারিদ্র্য নিরসনে এই বিষয়সমূহ জরুরি ভিত্তিতে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন: (ক) বাজেটের ব্যয় বরাদ্দ কিভাবে এবং কোন সময়ের মধ্যে মানব বঞ্চনা, দুর্দশা ও দারিদ্র্য দূরীকরণসহ সকল ধরণের বৈষম্য হ্রাসে অবদান রাখবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ দিক-নির্দেশনা; (খ) দারিদ্র্য নিরসন সম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করার কার্যকরী পদক্ষেপ; (গ) দেশে প্রতিবছর যে ৩০ লাখ মানুষ শ্রম বাজারে প্রবেশ করে তার মধ্যে ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয় না। এসব বেকারের স্বকর্মসংস্থানসহ ব্যাপক কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার পথ-পদ্ধতি। সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান যুব বেকারদের বছরে কমপক্ষে ২০০ দিনের কর্মসংস্থানের কর্মসূচি।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ এপ্রিল ২০১৯/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়