ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সিরাজুদ্দীন হোসেন মাগুরার সন্তান

মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সিরাজুদ্দীন হোসেন মাগুরার সন্তান

মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন, মাগুরা : ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১। রাত তিনটা। স্থান : ৫ নং চামেলিবাগ, শান্তিনগর, ঢাকা। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ। কে ? শাহীন দরজা খোলো। বাড়িওয়ালা ডাক্তার সাহেবের কন্ঠ। এতো রাতে হয়ত কোন বিপদে পড়েছেন। দরজা খুলে দিতেই কয়েকটি উদ্যত রাইফেলের সামনে হতবাক হয়ে যায় সিরাজুদ্দীন হোসেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র  শাহীন।

সিরাজুদ্দীন হোসেনকেই খুঁজতে এসেছে এরা। বাড়িওয়ালাকে বন্দুকের নলের সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। সবার মুখে কাপড় বাঁধা। ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সিরাজ। প্রথমে তারা নিশ্চিত হয়ে নেয় ঠিক লোকের কাছে তারা এসেছে কিনা। তারপর বলে, আমাদের সাথে যেতে হবে। পাঞ্জাবিটাও নিতে দেয় না। গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে একটি মাইক্রোবাসে তোলা হয় সিরাজুদ্দীন হোসেনকে।

পরদিন রায়ের বাজার-কাটাসুরের অসংখ্য গলিত লাশের মধ্যে খোঁজা হয় তাকে, না পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তাদের দোসর, আলবদর, আস্সামস ও রাজাকারবাহিনীর সদস্যেরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল পাকিস্তানিদের বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের গ্রামের বাড়ি মাগুরার শালিখা উপজেলার শরশুনা গ্রামে। তার বড় ছেলে শাহীন রেজানূর ও মেজ ছেলে জাহিদ রেজানূর ইত্তেফাক ও প্রথম আলোয় সাংবাদিকতা করেন।

শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের অনাথ সন্তানেরা একসময় বুঝতে পারেন, তাদের বাবা আর কোনদিন ফিরে আসবেন না। একসময় তারা মেনে নিয়েছেন, তাদের প্রিয়জনকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু মেনে নিতে পারেননি শহীদ সাংবাদিকের মা বেগম আশরাফুন্নেছা। এই বৃদ্ধা আমৃত্যু বিশ্বাস করতেন, তার ছেলে ফিরে আসবে। হয়তো পাকিস্তানের কোন জেলখানায় বন্দি আছে। ছেলের বউ নূরজাহানের চোখে পানি দেখলেই তিনি বলে উঠতেন, ‘কাঁদো কেন বউ, সেরাজ কে ওরা মারতি পারে না। সেরাজতো কখনও কারো ক্ষতি করেনি। দেখো ঠিকই একদিন  সিরাজ চলে আসবে’।

আট সন্তান নিয়ে মাত্র ৩২ বছর বয়সে স্বামীহারা হলেন নূরজাহান। এই শিশুদের লেখাপড়া কিভাবে চলবে, তারা কি খাবে, কি পরবে- এই বিষয়গুলি ভাবিয়ে তুলতো তাকে। সিরাজ আবার ফিরে আসবে এমন বিশ্বাস থেকেই তিনি ফিরে পেতেন বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। স্বাধীন দেশেও এই শহীদ পরিবারটিকে তার ঢাকার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য চেষ্টা চালানো হয়েছে কয়েকবার। দোতলা থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে আসবাব।   

সিরাজুদ্দীন ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাক এর কার্যনির্বাহী ও বার্তা সম্পাদক। ১৯৭১ সালে তিনিও সাহসের সঙ্গে সাংবাদিকতা করে গেছেন। সে সময় তার ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’, ‘অধূনা রাজনীতির কয়েকটি অধ্যায়’ এবং ‘এতদিনে’ শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে দৃঢ় অবস্থানের সাক্ষ্য দেয়। ১৯৫২ সালে দৈনিক আজাদ এর বার্তা সম্পাদক থাকাকালে ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। যুদ্ধের সময় তিনি নিজ গ্রাম মাগুরার শালিখার শরশুনায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন।

গ্রামের বাড়ি মাগুরার শরশুনা গ্রামেই কেটেছে সিরাজুদ্দীন হোসেনের শৈশব-কৈশোর। বাংলাদেশের অন্য দশটি গ্রামের  মতোই সুশীতল ছায়া ঘেরা গ্রাম শরশুনা। একসময়ের খরস্রোতা চিত্রা নদী গ্রামটিকে উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত করেছে। এই গ্রামেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। গ্রামের বাড়িতে তার স্মৃতি বিজড়িত টিনের একটি ঘর রয়েছে। এই ঘরেই তিনি জন্মেছিলেন।  ছোট বেলা থেকে শহরে থাকার কারণে গ্রামের লোকজনের কাছে তিনি তেমন পরিচিত ছিলেন না। নতুন প্রজন্মের অনেকেই শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে চেনেন না। তার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে শহীদের গ্রামে একটি স্মৃৃতিফলক তৈরি করার দাবি জানিয়েছেন মাগুরার সচেতন জনসাধারণ।

সিরাজের মাতা শহীদ জননী আশরাফুন্নেসা মারা গেছেন অনেক আগেই। স্ত্রী নূরজাহান স্বামীর মৃত্যু যন্ত্রণার পুরোটাই বুকে ধারণ করে তিনিও মারা গেছেন।

প্রতিবছর ডিসেম্বর আসে, চলে যায়। সিরাজুদ্দীন হোসেন আর ফিরে আসেন না ।
 

 

 


রাইজিংবিডি/মাগুরা/১৪ ডিসেম্বর ২০৬৫/আনোয়ার শাহীন/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়