ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আত্মহত্যাকারীকে বাঁচানোই তার কাজ

শুচিষ্মিতা ভূমি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৭, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আত্মহত্যাকারীকে বাঁচানোই তার কাজ

শুচিষ্মিতা ভূমি : কর্মব্যস্ততার দিক থেকে অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে চীন। আর তাই কর্মক্ষেত্র এবং কাজের চাপটাও অনেকাংশে বেশি। সেই সঙ্গে ব্যস্ত এ সময়ে বেড়েই চলেছে আত্মহত্যার হার এবং প্রবণতা।

 

সুউচ্চ দালান থেকে ঝাপ দিয়ে জীবন যন্ত্রণা শেষ করা নৈমিত্তিক ঘটনা। আজকাল এমন ঘটনা প্রতিরোধে দালানের নিচের দিকে পাতা হয় জাল, যেন ঝাপ দিলেও মাটিতে না পড়ে আটকে থাকে সেই জালে।

 

আত্মহত্যার জন্য কুখ্যাত পুকো এবং জিয়াগুয়ান জেলার মধ্যে অবস্থিত নানজিং-ইয়াংজে সেতু। ১৯৬৮ সালে চীনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে স্থাপিত হয় এ সেতু, কিন্তু ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই সেতু থেকে ইয়াংজে নদীতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে ২০০০ মানুষ।

 

মৃত মানুষের সংখ্যাটা কমাতে নিরলস পরিশ্রম করছেন চীনের এক নাগরিক চেন শি। প্রতিটি ছুটির দিনে তিনি এই সেতুর আগাগোড়া হাটেন, যাতে মানুষের আত্মহত্যা ঠেকাতে পারেন। গত ১৩ বছর ধরে আত্মহত্যা প্রবণতা রোধে কাজ করছেন ৪৮ বছর বয়সী চেন শি, নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছেন ৩২১ জন মানুষের জীবন।

 

এমন কোনো ছুটির দিন নেই, চেন শি নামের স্বেচ্ছাসেবীকে পাওয়া যায় না। যখনই তিনি দেখেন, কেউ আত্মহত্যা করতে ইয়াংজে নদীতে ঝাপ দিতে যাচ্ছেন- কাছে গিয়ে কথা বলে কিংবা ধরে টেনে এনে বাধা দেন। আশার কথা বলেন, প্রেরণার কথা বলেন, এমনকি বিশ্রাম নিয়ে মানসিক পরিবর্তন আনতে থাকার জায়গা পর্যন্ত তিনিই দেন। নানজিং শহরে এসে কাজের অভাব বা স্বপ্নভঙ্গ হয় অনেকের, গ্রামে ফিরে যাওয়ার সাহসটাও হারিয়ে ফেলে তারা- এমন দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।

 

চেন শি নিজেও একটা সময় হতাশাগ্রস্থ ছিলেন, কিন্তু দয়ালু এক মানুষের সাহায্যে বর্তমান ভালো অবস্থান তৈরি করেছেন ঠিকই। অতীত মনে রেখে বিপর্যস্ত মানসিকতার মানুষদের সাহায্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন তিনি।

 

 

ডেইলিমেইলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চেন শি বলেন, ‘এসব মনভাঙা মানুষদের পাশে এসে দাড়ালে মনে হয় অতীতের আমাকেই আমি সাহায্য করছি। একটা সময় আমিও এই হতাশ দুর্দশাগ্রস্তদের দলেই ছিলাম। নানজিং শহরে সবজি বিক্রেতা হিসেবে জীবনের কঠিন সময় পার করেছি, প্রতিদিনই ভাবতাম এ জীবন রেখে কি লাভ। কিন্তু আমার সময় বদলেছে, তাই আমিও অন্যদের মনে আশা জাগাতে চাই।’

 

১৯৯০ সালে ভাগ্যের খোঁজে শুকিয়ান গ্রাম থেকে নানজিং শহরে আসেন চেন শি। রাজমিস্ত্রির কাজের পাশাপাশি সবজি বিক্রি করতেন একটু ভালো থাকার আশায়। তবুও বেঁচে থাকাই কষ্টকর ছিল- ভালো ঘর নেই, ঘুমানোর বিছানা নেই, পেটে নেই পর্যাপ্ত খাবার। হতাশায় ডুবে গিয়েছিলেন চেন শি। কিন্তু একজন বুদ্ধিমান দয়ালু ব্যক্তির পরামর্শ ও সহায়তায় একটি মুদি দোকান খোলেন তিনি, সেখান থেকেই শুরু হয় তার জীবন জয়ের গল্পটা।

 

১৯৯৭ সালে বিয়ে করেন চেন শি, বর্তমানে একটি কন্যা সন্তানের আদর্শ পিতা। পত্রিকার মাধ্যমেই জানতে পারেন ইয়াংজে নদীতে আত্মহত্যার ক্রমবর্ধমান হারের কথা, তারপরই সিদ্ধান্ত নেন নিজের করণীয় নিয়ে।

 

 

সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘পরিবার থেকে দূরে একা থাকার সময় আমরা অনেক প্রতিকূলতা সামলে নিতে পারি না। এমনকি মনের কথা বলার মতোও কাউকে খুঁজে পাই না। তখন দরকার একটু সাহস, অন্যদের একটু সহানুভূতি।’

 

প্রতি শনিবার ও রোববার নিজের বাড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে এই ইয়াংজে নদীর সেতুতে আসেন চেন শি, সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত পুরো সেতুতে বাইক নিয়ে টহল দেন। তাকে অনুসরণ করেই বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এগিয়ে এসেছে মহান এ উদ্যোগে, মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা মানসিক অবসাদ কাটাতে চিকিৎসাও করেন। চেন শি এই সেতুর উত্তর দিকে দুই রুমের একটি বাড়ি ভাড়া করেছেন, দরকার হলে আত্মহত্যা করতে আসা মানুষ সেখানে থাকেন।

 

ইয়াংজে নদীর এই সেতুটি গণচীনের একটি প্রতীক। তবে চেন শি আত্মহত্যা প্রতিরোধে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার পরে সেতুটি মানবতার প্রতীক, নতুন জীবন প্রাপ্ত মানুষের প্রতীক, ভালো কাজে অনুপ্রেরণার প্রতীক।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ডিসেম্বর ২০১৬/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়