ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

কারাগারে মানসিক রোগীদের নেই চিকিৎসা সুবিধা

আহমদ নূর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৫, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কারাগারে মানসিক রোগীদের নেই চিকিৎসা সুবিধা

আহমদ নূর : আইনের চোখে সকল অপরাধী সমান। এর মধ্যে যারা মানসিক রোগী, বিভিন্নভাবে মাদকাসক্ত এমনকি যারা পরবর্তীকালে মানসিক সমস্যায় পড়েন তাদের কোনো চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই দেশের কোনো কারাগারে। এর ফলে একদিকে যেমন রোগীরা মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে সাধারণ আসামিরা পড়ছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

কারা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমাবদ্ধতার কারণে এই সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সমস্যাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। কারণ এর থেকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

কারা অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৬৮টি কারাগার রয়েছে। এসব কারাগারে বন্দি রয়েছেন পাঁচ শতাধিক মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত আসামি। তবে এই সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার সংস্থার কর্মীরা। তারা বলছেন, যেসব আসামি মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত এবং চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদেরই কেবল এই পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু যেসব আসামি ‘সিভিয়ার এফেক্টেড’ নয়, তাদের এই পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সে হিসেবে বলা যায়, কারাগারে মানসিক সমস্যাজনিত রোগীর সংখ্যা উল্লেখিত পরিমাণের চেয়ে বেশি।

জানা গেছে, দেশের কোনো কারাগারে মানসিক রোগীর চিকিৎসক নেই। কিন্তু সেই ১৯৭২ সাল থেকেই কারাগারে মানসিক রোগের ডাক্তার থাকার বিধানটি রয়েছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা প্রস্তাবনাও পাঠানো হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে পদ সংক্রান্ত জটিলতা এবং অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নতুন পদের বিপরীতে বেতনকাঠামো অনুমোদন না হওয়ায় সেই সমস্যা আর সমাধান হয়নি বছরের পর বছর ধরে।

জানা গেছে, দেশের কোনো কারাগারে মানসিক রোগের চিকিৎসক না থাকায় যেসব বন্দি কারাগারে থেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হচ্ছেন তাদের সুস্থতার জন্য স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না কারা কর্তৃপক্ষ। অথচ, কারা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশের সকল কারাগারে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বন্দি রয়েছে।

হিসেব অনুযায়ী এদের মধ্যে মানসিক রোগে আক্রান্ত বন্দির সংখ্যা রয়েছে ৫৩৭ জন। এ ছাড়া মাদকাসক্ত বন্দির সংখ্যা রয়েছে প্রায় সাত হাজার ১৩৫ জন। পাশাপাশি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া অনেক হাই লেভেল রিস্কের বন্দিরা রয়েছে।

এসব বিষয়ে কারা অধিদপ্তরের মাহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়াসহ মাদকাসক্ত ও মানসিক রোগে আক্রান্তদের জন্য চিকিৎসক দরকার। কিন্তু ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা কারাগারে কাজ করতে তেমনভাবে আগ্রহী নয়।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কারাগারে যারা মানসিকভাবে অসুস্থ বা যাদের মানসিক চিকিৎসা দেওয়া দরকার তাদেরকে ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ, পাবনা মানসিক হাসপাতাল বা যেসব মেডিক্যাল কলেজে মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে সেখানে পাঠানো হয়। অনেক সময় তাদের চিকিৎসার জন্য পাঠাতে অনেক রিস্ক নিতে হয়। হাসপাতালগুলোতে বন্দিদের আলাদা চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বিশেষ সেল নেই। এজন্য রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা দেওয়াও সম্ভব হয় না।

সূত্র জানায়, কারা কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে মানসিক রোগী ও মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দিলেও পরবর্তীকালে তাদের ফলোআপ করতে না পারায় স্থায়ীভাবে সুস্থ করা সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে সৈয়দ ইফতেখান উদ্দীন আরো বলেন, ‘ইতোমধ্যে কারাগারে মানসিক চিকিৎসক নিয়োগের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আমরা চাহিদা জানিয়েছি। তবে খুব সহজে যে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট পাব তা মনে হচ্ছে না। তবে যদি পাই তাহলে মানসিক রোগাক্রান্ত বন্দিদের জন্য সেটা নিঃসন্দেহে ভালো একটি খবর হবে।’

শুধু মানসিক রোগীর চিকিৎসক নয় করাগারে দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের মোটিভেশন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। তারা হাই রিস্ক লেভেলের বন্দি হওয়ার ফলে মিডিয়াম বা লো রিস্ক লেভেলের বন্দিদের সঙ্গেও সময় কাটানো বা আলাপচারিতা করতে পারে না। ফলে বিচারকাজ শুরু হওয়া থেকে আরম্ভ করে সাজা কাটানোর সময় পর্যন্ত তাদের সময় কাটে খুব একা।

মনোবিজ্ঞানী মনে করছেন, একজন মানুষ একা থাকলে সে অনেক বিষয় চিন্তা করে। হয়ত সেই সময়ে সে ভবিষ্যতের জন্য অপরাধমূলক কোনো ছক আঁকতে পারে।

মনোবিজ্ঞানী ড. কামাল উদ্দীন বলেন, ‘এটা অসম্ভব কিছু না। যখন কেউ একা থাকে তখন তার মস্তিষ্ক সকল অপরাধকে সঠিক মনে করে এবং অপরাধে জড়ানোকে কোনো বিষয়ই মনে করে না। ওই সময় সে যা ভাবে তা তার কাছে সহিহ মনে হয়। ফলে অপরাধী বা নির্দোষ যে কেউ হোক না কেন, তাকে সমাজের মানুষের সংস্পর্শে রাখা উচিত।’

ইফতেখার উদ্দীন বলেন, ‘জঙ্গিদের বুঝিয়ে পুনর্বাসনের বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। এটি উন্নত বিশ্বের অনেক কারাগারেই হয়। কারণ তাদের এ বিষয়ে এক্সপার্ট আছে। কিন্তু আমাদের সেটি নেই।’

তিনি বলেন, ‘এমনিতেই জঙ্গিরা একটা মতবাদে বিশ্বাসী। তাদের এই বিশ্বাস যিনি তৈরি করে দিয়েছেন তার থেকেও জ্ঞানী লোক ছাড়া তাকে (বন্দি জঙ্গি) সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। ধরুন, আমি একজন জঙ্গিকে বললাম যে তুমি যে পথে আছ সে পথ ভালো না। এই পথ ছেড়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আস। দেখা যাবে সে আমাকে কয়েকটি যুক্তি দিয়ে তার পথ সঠিক বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। আমাদের এমন লোক দরকার যিনি জঙ্গিদের যুক্তিকে পরাস্ত করে সঠিক বিষয়গুলো বুঝতে পারবেন এবং সেটা খুবই কৌশলী হয়ে।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/নূর/সাইফুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়