ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

ম্যারিয়টস ইনের মায়া || শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৭, ৮ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ম্যারিয়টস ইনের মায়া || শান্তা মারিয়া

আমরা কজন

(লক্ষ্মণরেখার বাইরে : ১০ম পর্ব)

ম্যারিয়টস ইন। নামটা শুনলে চোখে ভেসে ওঠে চমৎকার কয়েকটি কটেজের ছবি। বাগান, ঘাসে ছাওয়া মাঠ, সুইমিং পুল, লন টেনিস ও বাস্কেটবল খেলার জায়গা।

২০০৬ সালে আমেরিকার ওকলাহমায় গিয়ে ওখানেই ছিলাম আমরা কজন দলবেঁধে। কটেজগুলোও চমৎকার। ডুপ্লেক্স কটেজ। প্রতিটি কটেজে দোতলায় আর নিচতলায় দুটি বেডরুম, দুটি ওয়াশরুম, কিচেন কাম ডাইনিং, ছোট্ট একটু বসার জায়গা। কিচেনে ওভেন, ফ্রিজ সবই আছে। আর বেডরুমে টিভি, ফোন তো আছেই।

কমন বারান্দা দিয়ে সংযুক্ত একটি কটেজের দুটি ডুপ্লেক্স রুমে আমরা ৯ জন মেয়ে রয়েছি। আর রাজি যেহেতু ছেলে তাই তার জন্য আলাদা একটি সিঙ্গেল রুমের ব্যবস্থা। হারাধনের দশটি ছেলের মতো শাহনাজ মুন্নী, সালমা ইয়াসমিন রিতা, শাহনাজ বেগম, রোজিনা ইসলাম, নাসিমা খান মন্টি, নাসরাত আশিয়ানা চৌধুরি, লাবণ্য কাবিলি, নাজমুন মিলি, রাজি ও এই অধম একসঙ্গে ভ্রমণ করছি।

ওকলাহমা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেলর্ড কলেজে রয়েছে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। সেই বিভাগেই একটি ওয়ার্কশপ বা বলা চলে সংক্ষিপ্ত ফেলোশিপ করছি আমরা দশজন। আমাদের সব খরচ বহন করছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট। আর এর মূল উদ্যোক্তা হলেন প্রফেসর জো ফুট। তিনি গেলর্ড কলেজের ম্যাসকমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের প্রধান।

দীর্ঘ বিমানযাত্রায় আমরা যখন এখানে পৌঁছালাম তখন প্রত্যেকেই দারুণ   ক্লান্ত। ঢাকা থেকে ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজে দশ ঘণ্টা উড়ে পৌঁছেছি হিথরো। সেখানে এক ঘণ্টা মাত্র স্টপওভার দৌড়ের উপরে গেছে। একটুর জন্য প্লেন মিস করেনি লাবণ্য কাবিলি। এরপর প্যানঅ্যাম বিমানে আরো  দশ ঘণ্টা যাত্রায় আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে গেছি শিকাগো। সেখান থেকে দুই ঘণ্টার বিমান যাত্রায় ওকলাহমা সিটি। তারপর এক ঘণ্টা মোটর ভ্রমণে ছোট্ট বিশ্ববিদ্যালয় শহর নরম্যান। এখানেই ওকলাহমা বিশ্ববিদ্যালয়। দূরত্ব? ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীরনগর। এর কাছেই ম্যারিয়টস ইন। ঢাকা থেকে ভোররাতে যখন রওনা দেই তখন বেশ প্রাণবন্ত ছিলাম। কথা ছিল তিন ঘণ্টা আগে পৌঁছাবো সবাই এয়ারপোর্টে। যাতে রিপোর্টিং টাইম এর আগে সবাই একসঙ্গে হতে পারি। তার মানে বাড়ি থেকে বের হয়েছি প্রায় ২৭/২৮ ঘণ্টা আগে।

আমি জার্নিতে কখনও ঘুমাতে পারি না। তাই এই ২৮ ঘণ্টা জেগে আছি। বলাবাহুল্য একেবারেই কাহিল হয়ে পড়েছি। ম্যারিয়টস ইনে যখন পৌঁছালাম তখন রাত। নাজমুন মিলি, আমি, শাহনাজ বেগম ও নাসরাত এক ডুপ্লেক্সে। পাশের ডুপ্লেক্সটিতেই শাহনাজ মুন্নী, রোজিনা, লাবণ্য, মন্টি আর রিতা। ওদেরটা আমাদেরটার চেয়ে একটু বড়।

 


হিথরো এয়ারপোর্টে আমি ও শাহনাজ মুন্নী

 

কটেজে ঢুকেই চোখে পড়ল ডাইনিং টেবিলের ওপর বড় একটি বাস্কেট। তাতে নানা রকম চকলেট, কুকিজ, ফ্রুটস আর সফট ড্রিংকসের ক্যান। বাহ। এটি ম্যারিয়টস ইনের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য স্বাগত উপহার। এত ক্লান্ত ছিলাম যে রাতে কিছু চিন্তা করার আগেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছি। জেট ল্যাগ।

পরদিন ভোর ছটায় ঘুম ভেঙে গেল। আবার ঘুমাবো? নাহ, নতুন দেশ। একটু বরং দেখা যাক। তখনো অন্ধকার কাটেনি। কটেজের বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটছে। জায়গাটা চমৎকার। সেপ্টেম্বর মাস। ওকলাহমায় তখন আমাদের পৌষ মাসের আরামদায়ক শীত। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে শীত কমে যাচ্ছে। ওকলাহমায় দেখেছি দুপুরের দিকে বেশ চড়া রোদ। তখন গরম লাগে। শুষ্ক গরম। তবে ভোরবেলাগুলো স্নিগ্ধ।

সাড়ে ৭টায় তৈরি হয়ে চললাম ডাইনিংয়ের খোঁজে। আলাদা একটি বড় বাংলোতে ডাইনিং। সব আন্তর্জাতিক বড় হোটেলের মতো বুফে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা। ওটস, দুধ, বাদাম, স্ক্র্যাম্বল এগ কোনো কিছুরই অভাব নেই। সবই ফ্রেশ। ম্যারিয়টস ইনে যে কদিন ছিলাম সকালবেলার খাবারটা খুব শান্তিতে খেয়েছি।

ম্যারিয়টস ইনে নিজেদের রান্না করে খাওয়ারও সুযোগ ছিল। আমি যেদেশে যাই, সেদেশের খাবার খেতেই বেশি ভালোবাসি। এর মাধ্যমে বৈচিত্র্য আর অভিজ্ঞতা দুটোই জোটে। তবে আমার রুমমেটরা দেখলাম বাংলা খাবার খেতে বেশ আগ্রহী। এক ছুটির দিনের সন্ধ্যায় নিজেরাই রান্না-বাড়ি খেলা শুরু করলাম। মেন্যু ঠিক হলো আলুভর্তা, ডিম ভাজা, ভাত, ডাল। প্রধান শেফ শাহনাজ আপা ও রিতা। বাকিরা সবাই জোগানদার। বেশ মজা হয়েছিল। কেউ পেঁয়াজ কাটছি, কেউ মরিচ, কেউ ডিমের আর আলুর খোসা ছাড়াচ্ছি। মনে হচ্ছিল ছোটবেলার চড়ুইভাতির  দিনগুলোতে ফিরে গেছি। যখন সব কাজিনরা মিলে বাড়ির বাগানে রান্না-বান্না করতাম। খাবারটাও নেহাত মন্দ হয়নি।

লেখক ও সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নী খুব আদুরে আর নরম স্বভাবের মেয়ে। বলতো, ‘আমাকে কেউ মুখে তুলে খাইয়ে দাও’। নামে মিল থাকলেও স্বভাবে পুরো বিপরীত শাহনাজ বেগম। তিনি ভীষণ কড়া মেজাজের। বলতেন, সবাইকেই রান্না করতে হবে, পারো বা না পারো।

একদিন রান্না করতে গিয়ে শাহনাজ আপা একটি ফ্রাইপ্যান পুড়িয়ে ফেলেন। আমরা ভাবছি ক্ষতিপূরণ না দিতে হয় আবার। পরে দেখলাম খামোখাই ভয় পেয়েছিলাম। কোনো জরিমানা করা হয়নি। দিনের পর দিন আমেরিকান খাদ্য স্মোকড বিফ, বার্গার, স্যান্ডউইচ, স্যুপ, কেক ইত্যাদি খেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে আমরা নিজেরাই রান্না করে নিতাম। রিতা হাসি-খুশি স্বভাবের। রোজিনাও খুব হাসি-খুশি মেয়ে। নাজমুন মিলি ভারিক্কী স্বভাবের। আমাকে বেশ উপদেশ দেয়। লাবণ্য কাবিলী সবচেয়ে চুপচাপ। নাসরাতের মুখে সারাক্ষণ তার মেয়ের গল্প। নাসিমা মন্টি আমুদে। আবার মাঝে মাঝে খুব চুপচাপ হয়ে যায়। আমরা সবাই এসেছি ভিন্ন ভিন্ন পরিবার থেকে, বিভিন্ন স্বভাব নিয়ে। তবে এখানে এসে যেন এক পরিবারের হয়ে গিয়েছি।

ম্যারিয়টস ইন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বেশ খানিকটা পথ। আমাদের গাড়ি করে আনা নেওয়া করতেন এক তরুণ। বেশ সুদর্শন। নাম উইল। এই তরুণ ওকলাহমা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। পার্টটাইম আমাদের আনা নেওয়ার কাজটি করে দিয়ে ভালোই রোজগার হচ্ছে তার। প্রথমদিন থেকেই ড্রাইভারের পাশের সিট মানে উইলের পাশের সিটটি চলে গেল বন্ধু রিতার দখলে।

 


ম্যারিয়টস ইন

 

আমরা রিতাকে আর উইলকে নিয়ে মজার মজার মন্তব্য করি। রিতাও সেই রসিকতা দারুণভাবে উপভোগ করে। যেহেতু উইল আমাদের ভাষা বোঝে না তাই তার সাথে বাংলায় ‘টাংকি’ মারতে তো কোনো সমস্যা নেই। উইল কিছু বুঝতে পেরেছিল কি না তা আমার জানা নেই। তবে এরই মধ্যে একদিন সে তার স্ত্রী নিয়ে হাজির। আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।

তরুণীর নাম মনিকা। ভিয়েতনামি বংশোদ্ভূত। দীর্ঘদেহী শ্বেতাঙ্গ উইলের পাশে ছোট্ট খাট্টো মনিকাকে বেশ সুইট লাগে। সেদিন বেড়াতে যাচ্ছি আমরা। মাইক্রোর পেছনের তিনটি সিটে সবাই। উইলের পাশে মনিকা। হায়, রিতার জায়গাটা দখল হয়ে গেছে। আমরা সবাই সমস্বরে গান ধরলাম, বন্ধু যখন বউ নিয়া আমার বাড়ির সামনে দিয়া হাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্যা যায়। হাসতে হাসতে আমাদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাল রিতাও।

ম্যারিয়টস ইনের চারপাশে ঘাসে ছাওয়া মাঠ, ফুলের বাগান আর লম্বা লম্বা গাছ। হেমন্তে হলুদ-লাল-কমলা নানা রকম রঙ ধরেছে। এখনও চোখ বুজলে দেখতে পাই আমাদের ক্ষণস্থায়ী আবাস সেই কটেজগুলো।

যে কোনো জায়গা থেকে চলে আসার সময় আমরা খুঁজে দেখি কিছু ফেলে যাচ্ছি কি না। কিন্তু সর্বত্রই আমরা স্মৃতি ফেলে আসি। কোনো জায়গায় কিছুদিন থাকলে মায়া পড়ে যায়। সেই মায়া কাটিয়ে চলে আসতে কষ্ট হয় বৈকি। ম্যারিয়টস ইনের সেই দিনগুলো ছিল দারুণ ‘মায়া জাগানিয়া’। আজও তার মায়া জেগে আছে স্মৃতির ফোল্ডারে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ এপ্রিল ২০১৭/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়