ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সমাজের দর্পণ খান সারওয়ার মুরশিদ

রাসেল পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৬, ২ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সমাজের দর্পণ খান সারওয়ার মুরশিদ

মামুন আব্দুল্লাহ : একজন জ্ঞানসন্ধানী ব্যক্তি; যিনি সংগঠক, বিভিন্ন আন্দোলনের অগ্রনায়ক, আদর্শ শিক্ষক, দক্ষ কূটনীতিক এবং দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী যোদ্ধা, তিনি হলেন অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ।

১৯২৪ সালের ১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপজেলার নাসিরাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আলী আহমদ ছিলেন অবিভক্ত বাংলার এবং পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য। মাতা বেগম সিদ্দিকা খানম।

এই বরণ্যে শিক্ষাবিদ ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। কর্মজীবনে শিল্প-সংস্কৃতি, শিক্ষা-সাহিত্যে অবদান রেখে গেছেন। সমসাময়িক বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকারে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বর্তমানে তার যেসব ছাত্র-ছাত্রী জীবিত আছেন, তাঁদের স্মৃতিচারণে খান সারওয়ার মুরশিদের অজানা অনেক গৌরবান্বিত তথ্য উঠে এসেছে। ২০০১ সালে প্রকাশিত ‘কালের কথা’ গ্রন্থটি খান সারওয়ার মুরশিদের জীবনের একটি অনন্য দলিল।

‘নিউ ভ্যালিউজ’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে, পাকিস্তানি শাসনের শুরুতে নানা জিজ্ঞাসা এবং সাংস্কৃতিক শূন্যতার পটভূমিতে। ধর্মীয় রাজনীতির সংকীর্ণতা, রাষ্ট্রীয় আচরণে সামন্ত ও স্বৈরতান্ত্রিকপ্রবণতা, অহেতুক রাষ্ট্রপূজার রিরুদ্ধে তরুণ বুদ্ধীজীবীদের মনে যে প্রতিবাদ সৃষ্টি হয়েছিল তার নেপথ্যে ছিল এবং সেসব ধারণ করেছিল পত্রিকাটি। আরও একটি ভাবনা ছিল- নতুন রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলিমের মিলিত জাতীয়তার বিকাশ।

দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি খান সারওয়ার মুরশিদ বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে গেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ‘সংস্কৃতি সংসদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান লেখকসংঘের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন সারওয়ার মুরশিদ। তৎকালীন পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তিনি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর প্রবল বাধা পেরিয়ে বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও অন্যান্যদের নিয়ে রবীন্দ্র জন্মশতবার্র্ষিকী পালন করেন। তিনি রবীন্দ্র জন্মশতবার্র্ষিকী উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রবীন্দ্র জন্মশতবার্র্ষিকী পালনের পর বনভোজনের আয়োজন করা হয় আর সেখানেই আজকের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের সৃষ্টি।

অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা প্রণয়ন ও পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম ছিলেন তিনি। তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের উপদেষ্টা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর পরিবারের সবাই বিশেষ করে তার স্ত্রী নূরজাহান মুরশিদ, দুই ছেলে-মেয়ে সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন।

সদ্য স্বাধীন হওয়া বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গঠনে তিনি কাজ শুরু করেন। ১৯৭২-৭৪ সাল পর্যন্ত খান সারওয়ার মুরশিদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উপাচার্য থাকাকালে ‘ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ’ গঠন করেন। বিখ্যাত ফরাসি বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মালরো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন জানানোর সম্মানার্থে বাংলাদেশে আমন্ত্রন জানান এবং আন্দ্রে মালরোকে সম্মানজনক ডিলিট ডিগ্রী প্রদান করেন।

১৯৭৫-১৯৮৩ সাল পর্যন্ত খান সারওয়ার মুরশিদ পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি কমনওয়েলথ- এর সহকারী মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে দেশে ফিরে পুরোনো কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৪ সালে অবসর গ্রহণ করেও তিনি সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে ২০০৩ সাল পর্যন্ত অধ্যাপন করেন।

সারওয়ার মুরশিদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সে সময় তিনি সুশীল সমাজকে নিয়ে নাগরিক ঐক্য গড়ে তোলেন।

২০০১-২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য পুরুস্কার পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে শিক্ষা ও গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য তাকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। ২০০৬ সালে জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক, ২০০৮ সালে কণ্ঠশীলন ও ২০১১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান।

এই বরণ্যে শিক্ষাবিদ ২০১২ সালে ৮ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১ জুলাই সারওয়ার মুরশিদের জন্মদিনে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নাগরিক স্বরণসভার আয়োজন করা হয়। বিশিষ্ট্য ব্যক্তিবর্গ অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের কর্মজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সারওয়ার মুরশিদ সমাজকে বদলাতে চাইতেন। তিনি সৃজনশীল কাজে নিপুনতার বিষয়ে ছিলেন আপোশহীন।’

অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ সম্পর্কে সংবিধান প্রণেতা ও গণফোরামের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘খান সারওয়ার মুরশিদ ছিলেন আজীবন সংগ্রামী। স্বাধীনতা-উত্তর ও পরে দেশের রাজনীতি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে তার অবদান অবিস্মরণীয়। মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমাজ পরিবর্তনে কাজ করেছেন তিনি। দেশের প্রয়োজনে সব সংগ্রামে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলেও তিনি সেটা জাহির করতেন না।’

এই মহান শিক্ষাবিদ ও সংগ্রামী মানুষ এদেশের কথা ভেবেছেন, মানুষের কথা ভেবেছেন। বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের কাছে অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ একজন আদর্শ শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নবজাগরণের মূর্ত প্রতীক। তবে আজ পর্যন্ত তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করা হয়নি, যা বাঙালি জাতির জন্য গ্লানিকর।

এই বরণ্যে শিক্ষাবিদের ৯৩তম জন্মবার্ষিকীতে গভীরশ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : উন্নয়নকর্মী



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ জুলাই ২০১৭/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়