ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ঐ দূরের পাহাড় চূড়ার নাম সিপ্পি আর সুং

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৫, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঐ দূরের পাহাড় চূড়ার নাম সিপ্পি আর সুং

ফেরদৌস জামান: ব্যর্থতার ভার বয়ে বেড়ানো একেক জনের নিকট একেক মাত্রার বেদনাদায়ক। তবে কিছু মানুষের কাছে তা একটু অন্যরকম। জীবন এগিয়ে যাবে শুধুই ধারাবাহিক সাফল্যে; ব্যর্থতা থাকবে না- চলার পথ এমন সরলরৈখিক হওয়া অনুচিত। আবার ব্যর্থতার স্বাদ নেয়ার জন্য আয়োজন করে অপেক্ষা করাটাও ঠিক নয়। চলার পথে সে যদি আসে তাকে মেনে নেয়া এবং পরবর্তীতে যাতে এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই চেষ্টা করা- এটাই জীবন। ব্যর্থতা বেদনা বা কষ্টের কারণ হয়ে থাকে। জীবনে এমন দুচারটা না পাওয়ার বেদনা থাকা বেমানান কিছু নয়। ২০১৬ সাল, আমার ভ্রমণ বা অভিযাত্রা জীবনের একগুচ্ছ ব্যর্থতার বছর। এমনটা এর আগে কখনও হয়নি। এত অল্প সময়ের মধ্যে এত ব্যর্থতার সম্মুখীন আমি কখনও হইনি।

মে মাসে সিপ্পি আর সুং নামক এক পর্বত চূড়ায় আরোহণ করতে গিয়ে অতি বর্ষা আর তথ্য ঘাটতি ও বিভ্রাটের কারণে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল। সে নিয়ে একটি লেখাও রয়েছে। এই ঘটনার দেড়-দুই মাস পরে অর্থাৎ, রোজার ঈদের দুই কি তিন দিন পরে ফিরে আসতে হয়েছিল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে। ছয়-সাত দিনের লম্বা ভ্রমণ পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প এলাকা পরিদর্শন এবং আরও অনেক কিছু। সহযাত্রীর সাথে মতের অমিল হওয়ায় ভাটিয়ারী বাসস্ট্যান্ড থেকে অপ্রীতিকরভাবে ফিরে এসেছিলাম সোজা ঢাকা। সব শেষে আগস্ট মাসে দেখতে গেলাম উপকূলীয় দ্বীপ নতুন চর। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে মাঝপথ থেকে না ফিরে উপায় ছিল না, যাকে বলে একেবারে জানে বেঁচে ফেরা। এই অল্পদিন আগে রাইজিংবিডিতে শেষ হওয়া ১২ পর্বের এক ধারাবাহিকে তার বর্ণনা ছিল। এর আগে জানুয়ারিতে সুন্দরবনের দুবলার চরে অস্থায়ী জেলেপল্লীতে যেতে না পারার ব্যর্থতার কথা বাদই দিলাম। মাত্র কয়েক মাসে এত ব্যর্থতা খুব বেশি হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ পরে জায়গাগুলোতে সফল ও সুন্দরভাবে গিয়েছিলাম। এ বছরের জানুয়ারিতে সুজিতের কল্যাণে এবং উৎসাহে প্রায় সব জায়গাতেই যাওয়া হয়েছিল।
 


জানুয়ারির ১৫ তারিখ রাতে ঢাকা থেকে চড়ে বসলাম বান্দরবানের বাসে। এই চেনা পথে কতবার যে গেলাম ঠিক নেই। তবুও যেন নতুন কোথাও যাচ্ছি পুরনো গন্তব্য; নতুন করে দেখার জন্য। সুতরাং চেনা পথ, জানা গন্তব্য হলেই কি প্রতিবার বৈচিত্র্য থাকবে না- তা নয়। যথারীতি ভোরে পৌঁছলাম বান্দরবান। দেড়-দুই কিলোমিটারের মত হেঁটেই গেলাম রোয়াংছড়ির বাসস্ট্যান্ডে। কুয়াশা কাটেনি, ঘন কুয়াশার পড়ত থমকে আছে সমস্ত পথের ওপর। বাসস্ট্যান্ডে বাস নেই, সাড়ে আটটায় ছেড়ে যাবে দিনের প্রথম বাস। তার আগেই কীভাবে রওনা দেয়া যায় সেই চিন্তা করতে করতে ঘরির কাঁটা আটটা ছুঁইছুঁই।  এতক্ষণের প্রচেষ্টায় না পেলাম কোনো মোটর সাইকেল, না পেলাম কোনো ট্রাক বা অন্য বাহণ। আগেভাগে রোয়াংছড়ি পৌঁছার চিন্তা মাথায় থেকে ঝেড়ে ফেলে সাড়ে আটটার বাসের জন্যই হাল ছেড়ে অপেক্ষা করতে হলো। সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। দোকানের পরিবেশ এতটাই অপরিচ্ছন্ন আর নোংরা যে পরোটা আর তরকারি গলা দিয়ে ঠিক নামাতে পারলাম না। এদিকে ক্ষুধায় ভাঁজ হয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশে এই এক চরম সমস্যা যা প্রায় সর্বত্রই বিরাজমান। খাবারের দোকানের পরিবেশ কখনই মানসম্পন্ন নয়। এদেশে ঘুরতে আসা বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টিতে নেতিবাচক যত বিষয় উঠে আসে তার মধ্যে এক নম্বরে এটি থাকে। অসচেতনতাই এখানে প্রধান।

বাস ছাড়ল, প্রথম ধাক্কাতেই তিরতির করে উঠে গেল অনেকটা উঁচুতে। কিছুদূর যেতেই চেকপোস্ট। দুইজন ভেতরে উঠে চেক করতে লাগল সন্দেহভাজনদের ব্যাগ অথবা পোটলা। অনেককেই অসহায় মনে হলো। যেন তারা নিজভূমে পরবাসী। পাহাড়ের পুঞ্জিভূত সমস্যার সমাধান কবে হবে? আদৌ হবে কি না সে এক জটিল প্রশ্ন। এক এক করে চেক করার পর বাস ছেড়ে দেয়া হলো।
 


রোয়াংছড়ির সকালটা এক অপূর্ব দৃশ্য দেখার মধ্য দিয়ে শুরু হবে ভাবতে পারিনি। মন্দির এলাকার দোকান ও বাড়ি থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং শ্রমনগণ ঢং ঢং ঘণ্টা বাজিয়ে আহার সংগ্রহ করছে। নীরবে সুশৃঙ্খলভাবে এক জনের পেছনে আরেক জন। প্রত্যেকের হাতে একই ধরনের ধাতব পাত্র। লাইনের সম্মুখে দুই কিশোর শ্রমণের কাঁধে বাঁশের লাঠিতে ঝুলছে কাসর ঘণ্টা। খানিক পরপর কাঠের দণ্ড দিয়ে একটা করে হালকা আঘাত আর তাতেই তৈরি হচ্ছে গম্ভীর এক শব্দের অনুরণন। বম পাড়ার ছেলে আনাই, গতবার গিয়ে পরিচয়। সে সদরের পথে রওনা করেছে। আমরা কাছাকাছি চলে এসেছি শোনার পর ফোনে তার কথায় মনে হলো দৌড় শুরু করে দিয়েছে। বলেছিলাম চেনা পথ ঠিকই যেতে পারব। কিন্তু না। সে আমাদের নিতে এগিয়ে আসবেই। আমরা সদরে পৌঁছার প্রায় পনের মিনিট পরে আনাই এসে উপস্থিত। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই, কোমর পর্যন্ত ভেজা, ঝিরির মাঝ দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে এসেছে। এক সাথে নাস্তা খাব বলে দোকানে বসে আছি। তার ওসব রুটি-পরোটায় চলবে না, ভাত খেতে হবে। বৌদ্ধ মন্দিরের কাছাকাছি অর্থাৎ বাজারের পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় তার বন্ধুর দোকান। থালা ভরা ভাত সাথে এক বাটি শূকরের মাংসের ঝোল নিয়ে সে বসে গেল। কিছু কিছু দোকানে খাবার জায়গাটা পর্দা বা কোনো কিছুর দেয়াল দিয়ে আলাদা করা। পেছনের এই অংশে ভাত তরকারির পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত পানীয় পানের সুব্যবস্থা থাকে। আনাইয়ের সামনে মাংসের বাটির পাশে পানীয়ের গ্লাস। দুই-তিন গ্রাস ভাতের পর গ্লাসে একটু করে পরম তৃপ্তির চুমুক! এতক্ষণে বুঝতে পারলাম আমাদের এগিয়ে নিতে আসাটা যত না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে অধিক ওই এক গ্লাস পানীয়। তাদের পাড়ায় পান করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়, বর্তমানে যা নিষিদ্ধ প্রায়। লক্ষ্য করেছি বমদের প্রায় সব বসতি বা পাড়াতেই এই পানীয় নিষিদ্ধ। এখন হাঁটা শুরু করতে হবে খাল ধরে উজানে। খালের পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছি, সাথে পানীয় সেবন পরবর্তী আনাইয়ের রেডিও চলমান- এই বিবিসি তো, এই বেতার বাংলাদেশ।

ভেবেছিলাম অনেক পর্যটক থাকবে কিন্তু আমরা ছাড়া অন্য কারও দেখা পেলাম না। জানুয়ারি মাস বলে কথা, মৌসুমি পরিব্রাজক আর পর্বতারোহীদের হুমড়ি খাওয়া ভিড় থাকার কথা। কারণ সমস্ত বান্দরবান খেয়ে শেষ করার পর আমরা তো কেবল এই ট্রেইলটুকুই বাদ রেখেছি। যদিও এখানেও মাঝে বেশ কিছু নেতিবাচক ঘটনা ঘটে গেছে। হিমশীতল পানিতে পা যেন অবশ হয়ে এলো। এদিকে আনাইয়ের অতি কথনে কানের বারোটা আগেই বেজে গেছে। ঝিরিপথ ফুরালো, বেশ কিছুক্ষণ উঠতে হবে। গতবার এই পথে পুড়িয়ে দেয়া যত জুম ক্ষেত দেখেছিলাম সেগুলোতে এখন সবুজ পাতার সমারহ। সমস্ত পাহাড়ের পেছন থেকে ঐ দূরে যে চূড়াটা মাথা বের করে দিয়েছে তার নাম সিপ্পি আর সুং। উচ্চতার বিচারে এর অবস্থান প্রথম দশের মাঝে না থাকলেও বাংলার নব পর্বোতারোহীগণের প্রায় সকলেই একবার না একবার আরোহণ করে ফেলেছেন। তার অন্যতম কারণ বছর দেড়েক বান্দরবানের অন্যান্য ট্রেইল বন্ধ থাকা। আর একটা কারণ হলো তুলনামূলক স্বল্প পরিশ্রমে, খরচ বাঁচিয়ে এবং পিকনিক মুডে স্বপ্নপূরণ করা যায়। যে স্বপ্ন হুজুগে বাঙালিকে চালিত করছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থান মাউন্ট এভারেস্টে জীবনে অন্তত একবার হলেও দেশের পতাকাটা মেলে ধরতে।
 


অতীতে স্কুল, কলেজ ও সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ে পতাকা উড়তে দেখতাম। এখন পতাকা অনেক জায়গাতেই  উড়তে দেখা যায়। পাহাড়-সমুদ্র, খাল-বিল অথবা টিলা- সর্বত্রই পতাকা ওড়ে। পৌঁছা মাত্রই পতাকা হাতে একটা ছবি এবং দ্রুত ফেসবুকে আপলোড। ভালো চর্চা বটে! এই সুযোগে অন্তত আমাদের জং ধরা দেশপ্রেমের উন্মেষ এবং ভবিষ্যতের জন্য অনুশীলন দুটোই হচ্ছে। তাছাড়া, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এদেশ থেকে সত্তুর-আশি গণ্ডা এভারেস্ট সামিট না হলে ইজ্জত ফুটো হওয়ার জোগাড় হবে বৈকি! হিমালয়ের পাদদেশে উষ্ণ ওমে ঘুমিয়ে থাকা বাঙালিকে জাগিয়েছে- এবার বুঝবে ঠেলা! যানজট থেকে শুরু করে প্রশ্নপত্র ফাঁস বা সনদ জালিয়াতির মতো কারবার হিমালয়েও শুরু হলো বলে! 

সামনেই দোকান, পণ্য শুধু বুনো কলা আর বিস্কুট। চা রয়েছে। এই প্রত্যন্ত পাহাড়ে কৌটার দুধের চা- ভাবতেই অবাক লাগে! দোকানিকে সরিয়ে দিয়ে আনাই নিজেই তার অদক্ষ হাতে কড়া লিকারে এক পেয়ালা চা পাঁচ মিনিটেই প্রস্তুত করে ফেলল। চায়ের কাপে চুমুকের শব্দ ভেদ করে ভটভট শব্দে চারপাশ কাঁপিয়ে পার হয়ে গেল একটি চান্দের গাড়ি। বমপাড়া পেরিয়ে পরবর্তী পাড়ার আগে উঁচু পাহাড়টা পর্যন্ত যায়। জুমের ফসল পরিবহণে এ পর্যন্ত পাহাড় কেটে চওড়া রাস্তা বানানো হয়েছে। আর ঠিক একই পথ দিয়ে আমাদেরকেও যেতে হবে। 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়