ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ঐতিহ্য অহংকারের বিদ্যাপিঠ যশোর জিলা স্কুল

বিএম ফারুক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঐতিহ্য অহংকারের বিদ্যাপিঠ যশোর জিলা স্কুল

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর: যশোর জিলা স্কুল প্রাচীনতম ঐতিহ্য’র অহংকার হয়ে আজো স্বমহিমায় উজ্জ্বল। ১৮৩৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি আজো ছড়িয়ে চলেছে শিক্ষার আলো।

লম্বা হলুদ রঙের দালান। ইতালিয় স্থাপনা শৈলীর মোটা পিলারের অন্য রকম ভবন। সামনে সবুজ দুর্বা ঘাসের মাঠ। ১৭৯ বছরের প্রাচীন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি পাক-ভারত উপমহাদেশের অন্যতম স্কুলটি হিসেবে ইতিহাসের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে। এই স্কুল থেকে পাঠ নিয়ে অনেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতিমান হয়েছেন।

ব্রিটিশ শাসন আমলে বৃটিশ শাসক লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক পাশ্চাত্য শিক্ষার সুযোগ লাভের জন্য এদেশে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ সময় বিদ্যানুরাগী নন্দী পরগনার জমিদার পত্নী রাণী কাত্যায়নী, রাজা বরদাকন্ঠ, রাজা কালীকান্ত পোদ্দার, রাম রতন, মোঃ আব্দুল করিম, মৌলভী মোঃ আব্দুল্লাহ, নীলকমল পাল চৌধুরী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, কুঞ্জলাল ঠাকুর, প্রাণনাথ চৌধুরী, শুকদাস রায়, রাধামোহন ঘোষ চৌধুরীসহ আরো কয়েকজনের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও আর্থিক সহায়তায় স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রতিষ্ঠাকালে স্কুলটির নাম ছিল যশোর মডেল স্কুল। ক্লাস শুরু হয় মাত্র ১৩২ জন ছাত্র নিয়ে রাণী কাত্যায়নীর কাছারি বাড়িতে। প্রতিষ্ঠার পর ১৮৩৮ সালেই সরকারের পক্ষে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্কুল স্থাপনের ঘোষণা জারি করেন। ১৮৪৫ সালের ২৭ জানুয়ারি রাণী কাত্যায়নী বার্ষিক ৩০০ টাকা অনুদান ঘোষণা দিলে স্কুলটি নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়।  ১৮৭২ সালে রাণীর কাছারি বাড়ি থেকে স্কুলটিকে খড়কি মৌজায় হস্তান্তর করা হয়। ওই বছরই স্কুলের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখা হয় ‘যশোর জিলা স্কুল’।

খড়কি মৌজার ৭.৮০ একর জমির উপর পরবর্তী সময়ে স্কুলের পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সড়কের পশ্চিমপাশে ১০টি ভবন নিয়ে  জিলা স্কুল অতীত ঐতিহ্য আর জ্ঞানের মশাল জ্বেলে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর জে. স্মিথ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৪৭ সালে ছাত্রদের জন্য ফারসি বিভাগ চালু করা হয়। চালু হয় উর্দু বিভাগও। ১৯৬৩ সালে বিজ্ঞান ও মানবিক, ১৯৬৫ সালে বাণিজ্য বিভাগ চালু করা হয়। এর পাশাপাশি স্কুলের মূল ভবনের দক্ষিণে ১৯০৭ সালে নির্মিত হয় হিন্দু হোস্টেল। ১৯১২ সালে উত্তর দিকে নির্মাণ করা হয় মুসলিম হোস্টেল। ১৯৪০ সালে হোস্টেল দু’টিকে দ্বিতল ভবনে রুপান্তরিত করে শ্রেণিকক্ষ হিসাবে চালু করা হয়।

ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, কথা শিল্পী আনিস সিদ্দিকীসহ খ্যাতিমান পন্ডিত ব্যক্তিরা এ স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।  আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জ্যোর্তিবিজ্ঞানী রাধা গোবিন্দ চন্দ্র, ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান, খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কবি ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, পরমানু বিজ্ঞানী ড. শমসের আলী, বই মেলার জনক মোহাম্মদ শরীফ হোসেন, কমিউনিস্ট নেতা কমরেড আব্দুল হক, শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন, রাজনীতিক রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, তরিকুল ইসলাম, খালেদুর রহমান টিটো, বিচারপতি লতিফুর রহমান, পীর হয়রত মাওলানা শাহ আব্দুল মতিন, ভাষা সৈনিক শহীদ মশিয়ূর রহমান, ড. জীবন রতন ধর, ভাষা সৈনিক আলমগীর সিদ্দিকী, একরামুল হক, মাস্টার ঈমান আলী, শামসুল হোসেন জিন্নাহ এমএলএ, খন্দকার জহুরুল হক,  অধ্যক্ষ আব্দুল হাই, মেজর জেনারেল জামিল ডি আহসান, লেখক গবেষক আমজাদ হোসেন, গীতিকার সুরকার মোঃ রফিকুজ্জামান, যশোর প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাড. তৌহিদুর রহমান, মেজর জেনারেল আব্দুল মান্নান সিদ্দিকী, সচিব তসলিমুর রহমান, মনিরুজ্জামান, খ্যাতিমান ব্যাংকার এ এ এম জাকারিয়া মিলন, নাট্যকার সালাউদ্দিন লাভলু, নাট্যাভিনেতা আজিজুল হাকিম সহ আরো অনেকেই এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করেছেন স্কুলের কৃতি ছাত্র শহীদ মশিয়ূর রহমান, সিরাজউদ্দিন হোসেন, মাশুকুর রহমান তোজো, আসাদুজ্জামান আসাদ, সিরাজুল ইসলাম শান্তি, নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ আরো কয়েকজন । ১৯৪৮ সালে এই স্কুলের ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে অংশ নিয়ে ইতিহাস হয়ে আছেন।

স্কুলের বর্তমান ছাত্রসংখ্যা ২২০০। শিক্ষক আছেন ৫৩ জন। পাশের হার ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ। স্কুলের লাইব্রেরিতে দুষ্প্রাপ্য ৫,৫০০টি গ্রন্থ রয়েছে।  নিয়মিত ম্যাগাজিন প্রকাশ, বিজ্ঞান চর্চা, খেলাধুলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বৃক্ষরোপণ, দারিদ্র তহবিল বিভাগ, স্কাউটসহ স্কুলটিতে নানা ইতিবাচক কার্যক্রম অব্যহত রয়েছে। বর্তমানে নতুন পুরাতন মিলিয়ে স্কুলের মোট ভবনের সংখ্যা ১০ টি।

যশোর জিলা স্কুল প্রাক্তন ছাত্র সমিতির উদ্যোগে ‘এক নবীন প্রবীণ এক প্রাণ’ এই শ্লোগানে ২০০৫ সালে প্রথম স্কুল প্রাঙ্গণে প্রাক্তন ছাত্রদের পুণর্মিলনী অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবে দেশ বিদেশের ৫০০ ছাত্র যোগ দেন। এরপর ২০১০ সালের ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর স্কুল ক্যাম্পাসে আরো বর্ধিত কলবরে প্রাক্তন ছাত্রদের মিলন মেলা বসে। স্কুলের ১৭৫  বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ২০১৪ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি দুদিনের পুণর্মিলনী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এবারও একই শ্লোগানে ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর  স্কুলের ১৮০ বছরে পদার্পণ উপলক্ষ্যে প্রাক্তন ছাত্রদের মিলন মেলার আয়োজন করা হয়েছে। আজ মিলন মেলার শেষ দিন।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/যশোর/২৩ ডিসেম্বর ২০১৭/বি এম ফারুক/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়