ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

‘ছোট্ট’ কাভানিকে লেখা কাভানির চিঠি

শেখ আল মুমিন শুভ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩৩, ১০ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ছোট্ট’ কাভানিকে লেখা কাভানির চিঠি

উরুগুয়ের স্ট্রাইকার কাভানি তার ছোট বেলার সত্ত্বার উদ্দেশ্যে আবেগঘন চিঠি লিখেছেন। যেখানে তার ছোট বেলার অনেক গল্পই উঠে এসেছে। কাভানির লিখা চিঠিটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন শেখ আল মুমিন শুভ।

প্রিয় ৯ বছর বয়সি ছোট এডিনসন,

এটা সেই ছোট বালকের জন্য, যাকে প্রতিবেশীরা ‘পেলাদো’ নামে ডাকে।

তুমি যখন ছোট শিশু ছিলে তখন তোমার মাথায় খুব একটা চুল ছিল না, চুল উঠত খুব ধীরে। যা খুবই বাজে ছিল, তুমি নিজেও এর জন্য কিছু করতে পারোনি। তাই তোমার পরিবারকে এমন কাজের জন্য ধন্যবাদ, তুমি সব সময়ই ‘পেলাদো’।

আমি বলতে খুব খুশি হচ্ছি যে, আগামী বিশ বছরে ফুটবল তোমার জীবনকে অনেকভাবে বদলে দেবে। যার কিছুটা ভালো আর কিছুটা খারাপ। এমনকি ফুটবল তোমার এই ডাকনাম বদলে দিতেও সাহায্য করবে।
 


তুমি কি জানো গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা নামের একজন মানুষ ছিল। তুমি তাকে চিনবে না, কারণ তুমি ‘টম এন্ড জেরি’ দেখতে একমাত্র আগ্রহী। তোমার বড় ভাই নান্দো প্রথম ব্যক্তি যে বাতিস্তুতাকে দেখে উৎসাহী হয়েছিল। সে সেলুনে যাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং তার মায়ের হেয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার করা শুরু করে। এবং কিছুদিন পর তাকে দেখতে বিখ্যাত ‘বাতিগোল’ এর মতো লাগে। যখন সে তার ঝুটি যুক্ত লম্বা চুল নিয়ে ফুটবল মাঠে দৌড়ানো শুরু করে, এমন দৃশ্য দেখা ছিল খুবই নয়নাভিরাম। তুমি আস্তে আস্তে সাহস জমাও তোমার মাকে ‘আর চুল কাটব না’ কথাটা বলার জন্য।

দক্ষিণ আমেরিকার একটি নিয়ম হচ্ছে যদি তুমি তোমার পায়ে একটা বল নাও, তাহলে তুমি বাইরে জীবন কাটাতে পারবে। যদি না নাও তাহলে তুমি আলাদা সম্পর্কে কিছুই জানো না।

বাড়িতে কি আছে?

কোনো আনন্দ এবং আকর্ষণীয় কিছুই নেই! নেই কোনো প্লেস্টেশন বা বড় টিভি। কোনো গরম পানির শাওয়ার নেই। শীতকালে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য গরম হিটারের বদলে রয়েছে আরামদায়ক চারটি কম্বল। সেসময় গোসলের জন্য কেরোসিনের স্টোভে পানি গরম করতে হয়। পানি কতটুকু গরম বা ঠাণ্ডা তা বুঝতে হলে একটি বালতির মধ্যে দেখতে হয়। তোমার কাছে এটা অভিজাত জীবন। স্মরণ কর তোমার প্রথম ঘর যার কোনো বাথরুম ছিল না। যেকোনো সময় বাথরুমের কাজ শেষ করার জন্য বাইরে ঝোঁপের মধ্যে যেতে হতো।

তোমাকে একটা গোপন কথা বলি, যখন আমি এই অতীত স্মরণ করি তখন দুঃখী হই না। কিছু কারণ আমাকে আগ্রহ ও সাহস দেয়। এটা খুবই সুন্দর স্মৃতি। তোমার মাঝে কী আছে তা নিয়ে চিন্তা করো না ‘পেলাদো’, জীবন কাটাতে থাক সূর্যের আলোর মতো।

ফুটবলার হওয়ার সুবিধা কী? প্রতি দুই-তিন বছর পর চাকরিচ্যুত বা বাসা ভাড়া না দিতে পারায় তোমাকে নতুন জায়গায় গিয়ে থাকতে হয়। তবে মজার কথা হচ্ছে প্রতিটি নতুন জায়গা, তা যেখানেই হোক না কেন সেখানে এক চিলতে ছোট ময়লা জমি থাকে এবং তার চারপাশে একটা বল থাকে। কোনো মালিকই তা তোমার কাছ থেকে নিতে পারবে না। তোমার জীবনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় এখন। যদি সঠিকভাবে তা মনে করতে পারো তাহলে ভবিষ্যৎ উজ্বল। উজ্বল ভবিষ্যত কিছুটা জাদুময়।
 


আমি এটা নিয়ে পিএসজির একজনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। এটা খুবই অসাধারণ ও প্রেরণাময় ছিল। এই বুদ্ধি সাল্তোর এক যুব লীগের। তুমি ছয় বছরের এক গুচ্ছ বাচ্চাকে গোল করানোর আগ্রহ জন্মাতে চাও, তাহলে ফলাফল যাই হোক না কেন বলে দাও, যে খেলার শেষ গোল করতে পারবে সে একটা আইসক্রিম পাবে। তুমি আকর্ষণীয় সব আইসক্রিমের জন্য একের পর এক গোল করতে থাকবে এবং চাইবে এটাই যেন শেষ গোল হয়। ওই দিনের জন্য তুমিই রাজা ।

তুমি নিশ্চিত কোনো রাজধানীর নও মন্টেভিডিওর শিশুরা আলাদা জগতে বাস করে। এই জগত থেকে তুমি বেরোতে জানো না। অ্যাডিডাসের বুট, কারে চড়া এবং সবুজ ঘাস। সাল্তোতে কিছু পার্থক্য রয়েছে। কিছু কারণে সেখানকার সব বাচ্চারা খালি পায়ে খেলতে চায়। তারা প্রত্যেকটা ম্যাচ শুরু করে বুট পরে এবং হাফ টাইমের সময় তা খুলে খালি পায়ে খেলা শুরু করে।

এখনো কল্পনা করলে আমার মনে পড়ে আমি বলের পেছনে দৌড়াচ্ছি, পায়ে কাঁটা বিঁধছে কিন্তু তারপরও আইসক্রিম জয়ের জন্য দৌড়াচ্ছি।

তুমি এই অনুভূতি সারা জীবন বয়ে নিতে পারো, কারণ তুমি দক্ষিণ আমেরিকার উরুগুয়ে থেকে এসেছো। তুমি উরুগুয়ে থেকে এসেছো। তুমি সাল্তো থেকে এসেছো।
 


উরুগুইয়ানদের আশীর্বাদ এবং অভিশাপ হচ্ছে, আমরা কখনো আরাম করি না। এটা ফুটবলের ইতিহাস, এটা উরুগুইয়ানদের ইতিহাস। উরুগুইয়ানরা যখন তাদের ফুটবলের জার্সি পরে তখন তারা তাদের ইতিহাস অনুভব করে। আমাদের সব সময় এগিয়ে যেতে হয়, তারপর আরো এগোতে হয়।

তোমার স্বপ্ন কী ‘পেলাদো’?

আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। সময় তা ভুলিয়ে দিচ্ছে। তুমি কি নান্দোর মতো মন্টেভিডিওতে খেলতে চাও। তুমি তা পারবে এবং তার অনুভূতি হবে তুমি তা চ্যাম্পিয়নস লিগে করছ। তুমি কি ইউরোপে খেলতে চাও? তুমি তা পারবে এবং তোমার জীবনধারা বদলানোর জন্য অনেক টাকা আয় করতে পারবে।

তুমি কি জাতীয় দলে খেলতে চাও? তুমি তা পারবে এবং তোমার অভিজ্ঞতা হবে তোমার দুই চোখ আনন্দ ও বেদনার জলে ভরে উঠবে। তুমি কি অনেক সম্পদ নিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে চাও? তাহলে ‘পেলাদো’, তুমি এসবের সবকিছুই পারবে।

কিন্তু আমি তোমাকে বলতে চাই, এটা প্রয়োজনীয় নয় যে তুমি খুশি হবে। তোমার এই নয় বছর বয়সে তোমার যা আছে, আমি তা খুব মিস করছি একত্রিশ বছর বয়সে। তোমার কোনো ডলার নেই, গরম পানির শাওয়ার নেই, এমনকি সুন্দর কোনো স্টাইলে কাটা চুলও নেই। কিন্তু তার চেয়েও মূল্যবান কিছু রয়েছে তোমার। তা হচ্ছে তোমার স্বাধীনতা।

শিশু হিসেবে তোমার পক্ষে যা সম্ভব, বয়স্কদের পক্ষে তা সম্ভব না। বয়স্ক হয়েও সেই অনুভূতি আমরা পেতে চাইছি, কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ অনেক চাপ ও দায়িত্বের মাঝে এখন থাকতে হচ্ছে। এই বয়সে সবচেয়ে বেশি কোন কাজ আমরা করছি? হোটেল থেকে বাসে করে ট্রেণিং গ্রাউন্ড, সেখান থেকে বাসে করে প্লেনে, সেখান থেকে আবারো বাসে করে স্টেডিয়ামে।
 


তুমি অনেকভাবে স্বপ্ন তৈরি করছো, আবার অনেকভাবে স্বপ্ন ধ্বংস করছো। তুমি চাইলেই রোদ পোহাতে পারবে না, বা ময়লার মাঝে খেলতে পারবে না। সময় জীবনকে অনেক কঠিন করে তোলে। শৈশবে তোমার বিভ্রম ছিল যে সবচেয়ে সফল মানুষ হলো সবচেয়ে সম্পদশালী। আস্তে আস্তে বড় হয়ে বুঝতে পারলে যে সবচেয়ে সফল মানুষ হচ্ছে সেই, যে জ্ঞানের মাঝে বাঁচে।

তুমি তোমার স্বপ্নের সবকিছুই বাস্তবায়ন করতে পারো। এবং এজন্য তুমি অনেক অনেক ধন্য। কিন্তু সত্যি বলতে কী, একটি জায়গা রয়েছে যেখানে পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। তুমি ভাগ্যবান হলে তা হচ্ছে ফুটবল ম্যাচের ৯০ মিনিট। যখন তুমি বুট পরবে তখন জরুরি নয়, তুমি ময়লায় খেলছো নাকি নেপলসের সবুজ ঘাসে খেলছো, নাকি লক্ষাধিক মানুষের সামনে বিশ্বকাপে খেলছো।

তুমি জানো, তারপরও আমি তোমাকে তোমার বাবার কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, যখন তুমি সাদা দাগ অতিক্রম করে সবুজ মাঠে প্রবেশ করবে, তখন তোমার মাথায় ফুটবল ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। বাইরে বা ভেতরে কী হচ্ছে, সেদিকে তোমার কোনো খেয়াল থাকবে না। যদি তুমি এই কথাগুলো অনুসরণ করো এবং তোমার মাথায় তা ঢোকাও; তাহলে প্রবল চাপের মধ্যেও একেবারে সাবলীল থাকবে। মনে হবে না তুমি ফুটবল খেলছো। সর্বোচ্চ শিরোপার জন্য খেললেও মনে হবে তুমি আইসক্রিমের জন্য খেলছো।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জুলাই ২০১৮/শেখ আল মুমিন শুভ/পরাগ/ইয়াসিন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়