ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

রজনীগন্ধাপুর : ষষ্ঠ পর্ব

ইমদাদুল হক মিলন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রজনীগন্ধাপুর : ষষ্ঠ পর্ব

বাবা আমাদের নিয়ে কোনো দিন কোনো রকমের বাড়াবাড়ি করেননি। আদরের চেয়ে শাসন করেছেন বহুগুণ বেশি। কোনো বাড়াবাড়ি প্রশ্রয় দেননি। যখন যা দরকার শুধু তাই করেছেন। তেমন লেখাপড়া জানা মানুষ ছিলেন না। তার পরও আমরা কি মানুষ হইনি?

অতিরিক্ত আদরে দিপুকে আমি শেষ করে দিলাম। আসলে নিজে শেষ হলাম। নিঃস্ব বাতিল মানুষ হয়ে গেলাম।

আমি যদি আমার বাবার পথটাই ধরতাম, মায়ার কথা শুনতাম তাহলেই তো দিপু কোনো বাড়াবাড়ি করতে পারতো না। দুরন্ত স্বভাবটা কন্ট্রোলে থাকতো, ভয় পেতো আমাকে। যৌবন বয়সে মদটদ একটু আধটু অনেকেই খায়। দিপু খেলেও বাবার শাসনের ভয়ে খেতো পালিয়ে, বাড়াবাড়ি করার সাহস পেতো না। মিলিয়াকেও তৈরি করা যেতো সেইভাবে। শ্বশুরের ভয়ে আরষ্ঠ হয়ে থাকতো। বাড়িতে দিপু মদের আসর বসানো তো দূরের কথা, নিজের রুমে দরজা বন্ধ করেও খাওয়ার সাহস পেত না।

তাহলে কী দাঁড়াতো?

এই রকম মৃত্যু কি দিপুর হতো?

দিপুকে শাসন করা দরকার ছিল। দিপুর মৃত্যুর জন্য দায়ী আসলে আমি। যদিও এই জবাবদিহি কারও কাছে আমাকে করতে হয়নি। মায়া বেঁচে থাকলে করতে হতো। সে আমাকে ছাড়তো না। সে আমার কলার চেপে ধরে বলতো, আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী। আমার ছেলেকে খুন করেছে তোমার প্রশ্রয়। তুমি খুনি।

আসলেই আমি খুনি।

আমি আমার ছেলেকে খুন করেছি।

আমি কেন আমার বাবার মতো হইনি? আমার লেখাপড়া না জানা বাবা যেভাবে আমাদের মানুষ করেছিলেন আমি কেন সেভাবে দিপুকে মানুষ করিনি? আমার বাবা তো লেখাপড়া তেমন জানতেন না। আমি লেখাপড়া জানা মানুষ! কী অর্থ আমার সেই লেখাপড়ার, যে তার একমাত্র ছেলেকে প্রকৃত মানুষ করতে পারেনি? প্রশ্রয় দিয়ে যে তার ছেলেকে হত্যা করেছে!

গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে আমার বলতে ইচ্ছে করে, যে যেখানে আছো, শোনো। আমি একজন হত্যাকারী। আমি আমার একমাত্র সন্তান হত্যা করেছি। ফাগুন মাসের আকাশ শোনো, আমি একজন হত্যাকারী। মাটি শোনো, রৌদ্রছায়া আর হাওয়া শোনো, আমি একজন হত্যাকারী। গাছপালা মাঠ শোনো, ফুল পাখি প্রজাপতি শোনো আমি একজন হত্যাকারী। নিঃসীম নির্জনতা শোনো, আমি একজন হত্যাকারী। আমি আমার ছেলেকে হত্যা করেছি।

গাছপালা ঘেরা জায়গাটার তলায় সবুজ ঘাসের এক টুকরো একটা মাঠ। হাত পা দুমড়ে সেই মাঠে বসে পড়ি আমি। বুক ঠেলে ওঠে গভীর কষ্টের কান্না। চোখ ফেটে যেতে চায়। এই মাঠে লুটিয়ে পড়ে আমি কাঁদবো, আমি নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষের মতো কাঁদবো। ঠিক তখনই বাঁশবনের ওদিক থেকে দমকা একটা হাওয়া আসে। সেই হাওয়ায় বিভৎস একটা গন্ধ এসে নাকে লাগে। বিভৎস গন্ধ। বিভৎস।

মানুষ বড় অদ্ভুত জীব। এরকম মনের অবস্থাতেও গন্ধে আমি একেবারে দিশেহারা হয়ে যাই। বুক চাপা কান্না, চোখ ফাটা কান্না, দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে পড়া মানুষের মতো অবস্থা সেই বিভৎস গন্ধে মুহূর্তে বদলে যায়। নিশ্চয় কাছে কোথাও কিছু মরে পচেছে। শেয়াল কুকুর হবে। খাটাস বাঘদাসাও হতে পারে।

এই গন্ধ সহ্য করা মুশকিল। বমি হয়ে যাবে।

সব ভুলে আমি উঠে দাঁড়াই। যত দ্রুত সম্ভব গন্ধের জায়গা থেকে সরে আসার জন্য লম্বা পায়ে অন্যদিকে হাঁটতে থাকি।

মিলিয়া ও জামি

তুমি যে আমাদের নিয়ে এখানে এলে, কথাটা রুবানা জানবে না?

জামি মিলিয়ার মুখের দিকে তাকাল। জানবে তো নিশ্চয়। এসব কী আর চাপা থাকবে? আমার চারপাশে রুবানার লোকজনও তো আছে। তারা সব জানিয়ে দেবে। পিয়ন ড্রাইভার বা এই জাতিয় লোকজনকে টাকা ধরিয়ে দিলেই সাহেবদের সব খবরাখবর গড়গড় করে বলে দেয়। ওই জাতিয় লোকরা টাকা খায় দুইপক্ষ থেকেই। সাহেব টাকা দিয়ে বলেন, ম্যাডামের কানে যেন এসব না যায়। ম্যাডাম ডাবল টাকা দিয়ে বলেন, বলো আমাকে, সাহেবের খবর কী? সেখানেও গড়গড় করে সব বলে দিচ্ছে! রুবানা হয়তো আজই সব জেনে যাবে। এতক্ষণে জেনে গেছে কিনা তাই বা কে জানে?

অশান্তি হবে না?

তাতো হবেই। ফোনেই হয়তো ঝগড়াঝাটি করবে।



তাহলে?

তাহলে আর কী? এই অশান্তি কি নতুন? দিপু মারা যাওয়ার পর, তুমি অফিসে বসার পর থেকেই তো অশান্তি শুরু হয়েছে। যে কারণে তুমি আর অফিসে বসলে না। ওর জন্যই আমি দিপুর শেয়ার তোমাদের বুঝিয়ে দিলাম। এটা আমি চাইনি। আমি চেয়েছিলাম যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা দুটি বন্ধু ফার্মটা শুরু করেছিলাম, বন্ধু আমাদের ছেড়ে গেছে, তাকে তো আর ফেরত পাবে না। তবু সে থাক আমার সঙ্গে। তার শেয়ারটা থাক, তুমি থাকো। রুবানার জন্য পারলাম না।

এটা রুবানার দোষ না।

মানে?

রুবানার জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম। যখন স্ত্রী জানতো তার স্বামী বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে, তাকে বন্ধুর জায়গায় অফিসে এনে বসাচ্ছে, এটা কেউ মেনে নেবে না।

কিন্তু ওসব করে তো কোনও লাভ হয়নি। সম্পর্কটা কি সে ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছে?

তা পারেনি।

তো?

এসব সম্পর্ক ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সম্পর্ক একবার গাঢ় হয়ে গেলে কোনো না কোনোভাবে মানুষ তা ম্যানটেইন করবেই।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে এইসব বাধাবিঘ্নের কারণে, ঝগড়াঝাটি মনোমালিন্যের কারণে চাপা থাকা আগুন আরো  উসকে ওঠে।

একটু থামল জামি। তোমাকে একটা ঘটনা বলি। আমার এক বন্ধুর ক্ষেত্রেই ঘটেছে। তুমি চিনবে না। ছোট ব্যবসায়ী। এক হিন্দু ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। মাঝে মাঝে যায় তার ফ্ল্যাটে। বন্ধুর বউটা মিশুক ধরনের। পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠল একপর্যায়ে। এই বন্ধু বউ ছেলেমেয়ে ওই বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছে, ওই বন্ধুও পরিবার নিয়ে আসছে এই বন্ধুর বাড়িতে। খাওয়া দাওয়া হৈ হল্লা আড্ডা। মুসলমান বন্ধুর বউটা স্বামীকে সন্দেহ করতে লাগল। নিশ্চয় বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে। দুজনের চোখ দেখে আমি বুঝতে পারি। কথা বলার ধরন, হাসি, একটু বেশি মনোযোগ দুজন দুজনার দিকে। নিশ্চয় কিছু একটা আছে।

আসলে কিছু না।

না। হিন্দু মহিলা একজন আন্তরিক ধরনের মানুষ। কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ভদ্রলোকেরও নেই, মহিলারও নেই। মাঝখান থেকে বউটা এমন অশান্তি শুরু করল, ভদ্রলোকের জীবন তছনছ। কিছুতেই হিন্দু বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না। রাখলেও দুজন দুজনের অফিসে যাতায়াত করতে পারবে। বাড়িতে একেবারেই না। কথাটা হিন্দু বন্ধুর কানে গেল। সে মন খারাপ করে বলল, ভাবি যা চাইছেন তাই করো। সংসারে অশান্তি করে লাভ নেই। আমি সেভাবেই সব ম্যানটেইন করবো। প্রতিমাকে বলে দেব। প্রতিমা হচ্ছে ভদ্রলোকের স্ত্রীর নাম।

তা বুঝতে পারছি।

কিন্তু প্রতিমার এটা খুব মনে লাগল। খুবই আঘাত পেল সে। কিছু না করে এমন একটা সন্দেহের মধ্যে পড়ল? সে ঘুণাক্ষরেও স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কে জড়াবার কথা ভাবেনি। স্বামীভক্ত মহিলা। অন্য কোনো পুরুষের কথা জীবনে ভাবেনি। বিয়ের আগে প্রেম ভালোবাসার দিকে যায়নি। স্বামীই তার জীবনের একমাত্র পুরুষ। এই অবস্থায় স্বামীর বন্ধুর স্ত্রীর এই সন্দেহ?

প্রতিমা কি দেখতে সুন্দরী?

গায়ের রং ফর্সা না। কালো। একেবারেই কালো। তবে চেহারা খুব সুন্দর, ফিগার খুব সুন্দর। বয়স তোমার মতো হবে।

বলো, তারপর?

জেদ করে সে একটা কাজ শুরু করল। স্বামীর বন্ধুকে প্রায়ই ফোন করে। অযথা গল্প গুজব, হাসি মজা। রোমান্টিক কথাবার্তা। বেশিরভাগ পুরুষ মানুষ এসব পছন্দ করে। ভদ্রলোকও ধীরে ধীরে শুরু করল। দেড় দুমাসের মাথায় এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে মিট করলো দুজনে। প্রথম দিনই ফিজিক্যাল ব্যাপারটা হয়ে গেল। তারপর নেশা হয়ে গেল দুজনার। মনের নেশা ততটা না, শরীরের নেশাটাই প্রবল। এখনও চলছে।

মহিলার স্বামী বা ভদ্রলোকের স্ত্রী কিছু টের পাচ্ছে না?

না। তারা জানে সম্পর্ক শেষ। মানে পারিবারিক সম্পর্ক বলে এখন আর কিছু নেই। বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর যোগাযোগ আছে। ব্যবসায়ীক লেনদেন ইত্যাদি আছে। ভেতরে একবন্ধু আরেক বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।

তার মানে পুরো ব্যাপারটাই জেদ করে?

হ্যাঁ। স্রেফ জেদ। প্রতিমার জেদ। ফাঁকে ফাঁকে তৈরি হয়ে গেছে শরীরের নেশা।

মিলিয়া উদাস গলায় বলল, এ রকম হতে পারে।

তবে তোমার আমার ব্যাপারে তেমন হয়নি। আমার সব সময়ই তোমাকে খুব ভাল লাগতো। তোমাকে খুবই পছন্দ করতাম। আর তুমি পছন্দ করতে দিপুকে।

তার পরও নিয়তি ঠিকই তোমার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে দিল। দিপু চলে গিয়ে আমাকে পৌঁছে দিল তোমার কাছে।

মিলিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল।


(চলবে)..

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়