উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের চতুর্থ দিনে মানুষের ঢল
বিনোদন প্রতিবেদক : ‘সংগীত জাগায় প্রাণ’-এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে গত ২৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে শুরু হয় পাঁচ দিনব্যাপী বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব। ৬ষ্ঠবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ উৎসব। গতকাল শুক্রবার ছিল এ উৎসবের চতুর্থ দিন। ছুটির আমেজ থাকায় সন্ধ্যা থেকেই সংগীত প্রেমী মানুষের ঢল নেমেছিল আবাহনী মাঠে।
চতুর্থ দিনের আয়োজন শুরু হয় বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের দলগত নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। ‘নৃত্য চিরন্তন: মনিপুরি, ভারতনাট্যম, কত্থক নৃত্যার্ঘ’ শীর্ষক দুই পর্বে ভাগ করা এ পরিবেশনাটির নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন গুরু বিপিন সিংহ, পণ্ডিত বিরজু মহারাজ, শিবলী মোহাম্মদ এবং নৃত্য ভাবনা, সার্বিক নৃত্য পরিচালনা ও সম্বনয়কারী হিসেবে ছিলেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রথম পর্বে পরিবেশিত হয় মনিপুরি, ভরতনাট্যম ও কত্থক নৃত্যের উপস্থাপনা। মনিপুরি নৃত্যে তাল-তানচেপ-৪ মাত্রায় রাধা রূপ বর্ণন করেন সুদেষ্ণা স্বয়ম্প্রভা; নৃত্য ও সংগীত পরিচালনায় ছিলেন গুরু বিপিন সিংহ, কণ্ঠে গুরু কলাবতী দেবী। গানের কথা নেওয়া হয়েছে বৈষ্ণব কবি গোবিন্দ দাসের একটি ভক্তি কবিতা থেকে। এরপর তাল-সপ্ততাল ২০ মাত্রায় কালীয় দমন পরিবেশন করেন সুইটি দাস; নৃত্য ও সংগীত পরিচালনা করেন বিপিন সিংহ, কণ্ঠে ছিলেন দ্রৌপদি দেবী। মনিপুরি নৃত্যের সর্বশেষ অংশে তাল-তানচেপ-৪ মাত্রা, চালি তাল-৮ মাত্রা এবং মেনকুপ-৬ মাত্রায় পরিবেশত শিব স্তুতি। এ অংশের নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন বিম্বাবতী দেবী, সংগীত পরিচালনায় গুরু লাকপতি সিং এবং কণ্ঠে দ্রৌপদি দেবী।
ভারতনাট্যম অংশে কীর্তি রামগোপালের নৃত্য পরিচালনায় ও ডি এন শ্রীভাৎসার সংগীত পরিচালনায়, বৃন্দাবনী রাগ ও আদি তালে সূরিয়া কথুরাম পরিবেশন করেন অমিত চৌধুরী। এরপর শিব স্তুতি পরিবেশন করেন জুয়েইরিয়াহ মৌলি। এতে নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন কীর্তি রামগোপাল, সংগীত পরিচালনায় রামা সুব্রামানিয়াম শর্মা। শিব স্তুতিটি পরিবেশিত হয় আভোগী রাগে মিশ্র চাপু তালমে। শিব স্তুতির পর কীর্তি রামেগাপালের নৃত্য পরিচালনায় ও শ্রী পদ্মচরণের সংগীত পরিচালনায় এবং পূর্বী কল্যাণী রাগে ও আদি তালমে শিব কৃতি পরিবেশন করেন অমিত চৌধুরী। কত্থক নৃত্যের শুরুতে তিনতালে গুরু বন্দনা করেন মেহরাজ হক তুষার। এরপর শুদ্ধ নৃত্য পরিবেশন করেন স্নাতা শাহরিন। তিনতালের ওপর ভিত্তি করে পরিবেশিত এ কত্থক নৃত্যের সংগীত ও নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শিবলী মহম্মদ।
এরপর শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নৃত্য পরিচালনা ও রাহুল চ্যাটার্জির সংগীত পরিচালনায় (রবীন্দ্র সংগীত) শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। এ পর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে মনিপুরি, ভরতনাট্যম ও কত্থক সম্মিলনে নটরাজের প্রতি নৃত্যের মালিকা নিবেদন করা হয়। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন মহুয়া মঞ্জুরী সুনন্দা, সুকান্ত চক্রবর্তী ও অভিজিৎ মজুমদার। পুরো নৃত্য পরিবেশনাটির ভাবনা, সার্বিক পরিচালনা ও সমন্বয়কারী ছিলেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিবেশনা শেষে শিল্পীদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। নৃত্যের পর সরোদ পরিবেশন করেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীরা। দলগত পরিবেশনায় তারা রাগ ভূপালি পরিবেশন করেন। পরিবেশনা শেষে শিল্পীদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের মা এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি মমতাজ খালেক।
এরপর মঞ্চ আলোকিত করেন উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ওস্তাদ রাশিদ খান। রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার প্রবাদপ্রতিম এই শিল্পী পুরিয়া রাগে খেয়াল পরিবেশন করেন। এ সময় তার সঙ্গে কণ্ঠ সহযোগী ছিলেন নাগনাথ আদগাঁওকার, তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জি, হারমোনিয়ামে ছিলেন অজয় যোগলেকর এবং সারেঙ্গিতে ছিলেন ওস্তাদ সাবির খান। পরিবেশনা শেষে এই গুণী শিল্পীর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, এমপি।
খেয়াল শেষে ছিল সরোদ এবং বেহালার যুগলবন্দী। পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার এবং ড. মাইশুর মঞ্জুনাথ একসঙ্গে পরিবেশন করেন রাগ সিমেন্দ্রমধ্যমম। এ সময় তাদের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি এবং মৃদঙ্গমে ছিলেন অর্জুন কুমার। পরিবেশন শেষে শিল্পীদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। এরপর খেয়াল পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন পণ্ডিত যশরাজ। তিনি প্রথমে রাগ যোগ- এ খেয়াল পরিবেশন করেন এবং পরে দূর্গা রাগে ভজন পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন রামকুমার মিশ্র, হারমোনিয়ামে পণ্ডিতা তৃপ্তি মুখার্জি, কণ্ঠে রত্তন মোহন শর্মা এবং মৃদঙ্গমে শ্রীধার পার্থসারথী। পরিবেশনা শেষে শিল্পীর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
খেয়াল শেষে প্রথমবারের মতো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে চেলো’র পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন সাসকিয়া রাও দ্য-হাস। তিনি রাগ নন্দকোষ পরিবেশন করেন। এরপর তিনি ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ ও ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’- এ দুটি রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি, তানপুরায় বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী অভিজিৎ কুণ্ডু ও টিংকু কুমার শীল। পরিবেশনা শেষে শিল্পীর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন স্কয়ার গ্রুপের পরিচালক তপন চৌধুরী।
উৎসবের চতুর্থ দিনের শেষ পরিবেশনা ছিল ইমদাদখানি ঘরানার শিল্পী পণ্ডিত বুধাদিত্য মুখার্জির সেতার। তিনি রাগ ললিত বিস্তার গৎ ঝালা পরিবেশন করেন। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন সৌমেন নন্দী। পরিবেশনা শেষে শিল্পীর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন স্থপতি নাহাস খলিল। গত পাঁচ বছর ধরে আয়োজিত ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব’ শিল্পী ও দর্শকের অংশগ্রহণের নিরিখে এরই মধ্যে এই উপমহাদেশ তথা বিশ্বের সর্বাধিক বড় পরিসরের উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ বছর উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সংস্কৃতিতাত্ত্বিক এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে।
গত তিন দিনে আসর মাতিয়েছেন ড. এল সুব্রহ্মন্যণ, বিদূষী পদ্মা তালওয়ালকর, রাকেশ চৌরাসিয়া, পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা, পণ্ডিত উলহাস কশলকর, ওস্তাদ শাহিদ পারভেজ খাঁ, পণ্ডিত রণু মজুমদার ও পণ্ডিত দেবজ্যোতি বোস, বিদ্বান ভিক্ষু বিনায়করাম, পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর, কলা রামনাথ, এবং পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর মতো গুণীরা।
আজ শনিবার পর্দা নামবে এ উৎসবের। এদিন সন্ধ্যা সাতটায় পরিবেশনার শুরুতে থাকছে বিদূষী সুজাতা মহাপাত্রের ওড়িশি নৃত্য। এরপর মোহন বীণা পরিবেশন করবেন পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভট্ট। এ ছাড়া থাকছে ব্রজেশ্বর মুখার্জির খেয়াল; পণ্ডিত কুশল দাস ও কল্যাণজিত দাস, এবং পণ্ডিত কৈবল্য কুমারের সেতার। সর্বশেষ থাকছে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি। তবে অনিবার্য কারণবশত কোনো রকম ঘোষণা ছাড়াই উল্লেখিত সূচিতে পরিবর্তন আসতে পারে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ ডিসেম্বর ২০১৭/রাহাত/শান্ত
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন