ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাংলা সিনেমার ইংরেজি নাম- এ কেমন বাংলা প্রেম?

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৬, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলা সিনেমার ইংরেজি নাম- এ কেমন বাংলা প্রেম?

রাহাত সাইফুল : মাতৃভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে আমাদের। বিশ্বের অন্য কোথাও এমন নজির নেই। যে কারণে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। আমরাও দিনটি বিনম্র চিত্তে পালন করি। স্মরণ করি ভাষাশহীদদের। গর্ব করে ফেব্রুয়ারি মাসটিকে বলি ‘ভাষার মাস’। ফেব্রুয়ারি চলে গেলেই ভুলে যাই সে কথা। 

মুখের ভাষা হিসেবে আমরা বাংলা ব্যবহার করলেও সর্বস্তরে বাংলাভাষা ব্যবহার হচ্ছে না। বলা যায়, এ ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার দাপটে বাংলা যেন অসহায়। ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে আমার মায়ের ভাষা। ফলে এটা বলা যায়, যে চেতনা রক্ষায় ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত সেই চেতনা আমরা পুরোপুরি রক্ষা করতে পারিনি। বাংলাভাষা আজও আমরা সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে পারিনি। আমাদের দেশের বিনোদন মাধ্যমেও ইংরেজি ও হিন্দির প্রভাব স্পষ্ট। 

বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরুর আগে নাম নিবন্ধন করতে হয়। বলা চলে শুরুটা হয় নাম দিয়ে, সেখানেই ভাষার প্রথম বিড়ম্বনা। কেননা প্রায়ই বাংলা সিনেমার ইংরেজি নাম আমাদের চোখে পড়ে। এখানেই শেষ নয়, বাংলা চলচ্চিত্রের গানেও ইংরেজি ও হিন্দি শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস দীর্ঘ ও গৌরবের। এদেশে ‘বেহুলা’,  ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র মতো অসংখ্য চলচ্চিত্র বাংলা নামেই সুপার হিট হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে ঢাকাই চলচ্চিত্রে ইংরেজি নাম ব্যবহৃত হচ্ছে বেশি। ২০১২ সালের দিকে ইংরেজি নাম ব্যবহারের মাত্রা বেড়ে যায়। কারণে-অকারণে বাংলা চলচ্চিত্রের ইংরেজি নাম ব্যবহার করা হয় তখন। এরপর ২০১৫ সালে বিষয়টি আমলে নেয় তথ্য মন্ত্রণালয়।

২০১৫ সাল থেকে তথ্য মন্ত্রণালয় এ প্রসঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। তারা বলছে, সরাসরি ইংরেজি নাম নয়, কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশি সিনেমার নাম দিতে হবে বাংলাতেই। বাংলা চলচ্চিত্রে ঢালাওভাবে ইংরেজি নাম ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতেই এই উদ্যোগ। কিন্তু  কে শুনছে সে কথা! চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের অনেকে ইংরেজি নাম দিয়েই সিনেমা মুক্তি দিচ্ছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য নাম নিবন্ধন করতে হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি থেকে। নির্মাণ শেষে চলচ্চিত্র মুক্তির জন্য জমা দেয়া হয় সেন্সর বোর্ডে। স্বাভাবিক কারণেই এই দুই স্তরে এ ব্যাপারে কঠিন মনিটরিং হলে ইংরেজি নাম এড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিতে মোট ১৮২টি চলচ্চিত্রের নাম নিবন্ধন করা হয়। এর মধ্যে ২৪টি চলচ্চিত্রের নাম ইংরেজি। এর মধ্যে কয়েকটি হলো: ‘মাফিয়া ডন’, ‘আই লাভ ইউ প্রিয়া’, ‘দ্য টেরোরিস্ট’, ‘মাই ডার্লিং’, ‘রানা দ্যা ফাইটার’, ‘আইসক্রিম’, ‘ইউটার্ন’ ইত্যাদি। একই বছর তথ্য মন্ত্রণালয়ের এমন নির্দেশের পরও ‘ওয়ার্নিং’, ‘ব্ল্যাক মানি’, ‘ব্ল্যাক মেইল’, ‘গুন্ডা দ্যা টেরোরিস্ট’, ‘জিরো ডিগ্রি’সহ বেশ কিছু চলচ্চিত্র ইংরেজি নাম নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। যদিও এসব চলচ্চিত্রের মধ্যে কিছু চলচ্চিত্র ২০১৫ সালের আগেই ইংরেজি নামে নিবন্ধন করা।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিতে ১৯৯টি চলচ্চিত্রের নাম নিবন্ধন করা হয়। এর মধ্যে ১১ টি চলচ্চিত্রের নাম ইংরেজিতে। ২০১৫ সালে ছিল ২৪টি ইরেজি নাম, ২০১৬ সালে এসে তা কমে ১১টিতে দাঁড়ায়। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু তৎপরতা এ ব্যাপারে ইতিবাচক কাজ করেছে। ২০১৬ সালে  ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’, ‘সুইট হার্ট’, ‘শুটার’সহ কয়েকটি সিনেমা ইংরেজি নামে মুক্তি পায়। ২০১৭ সালে ২৪৪টি চলচ্চিত্র নিবন্ধন করা হয়। এর মধ্যে ‘মিশন শূন্য’, ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’, ‘সুপার হিরো’সহ ৮টি চলচ্চিত্র ইংরেজি নামে নিবন্ধন করা। এ বছরও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র ইংরেজি নামে মুক্তি পায়।



২০১৮ সালে এখন পর্যন্ত ২৮ টি চলচ্চিত্রের নাম নিবন্ধন করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘মিস ইউ জান’, ‘ক্যাপ্টেন খান’ শিরোনামের দুটি চলচ্চিত্র ইংরেজি নামে নিবন্ধন করা হয়েছে। এছাড়া কিছু সিনেমায় বাংলা নামের সঙ্গে কৌশলে ইংরেজি টাইটেল জুড়ে দেওয়া হয়। এ তালিকায় রয়েছে ‘বাজে ছেলে- দ্য লোফার’, ‘রুদ্র দ্য গ্যাংস্টার’, ‘রানা পাগলা দ্যা মেন্টাল’ প্রভৃতি।  শুধু চলচ্চিত্রের নাম ইংরেজি নয়, চলচ্চিত্রের গানেও রয়েছে বাংলা-ইংরেজির সংমিশ্রণ। এ ধরণের ঘটনা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়।

চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি বাংলা চলচ্চিত্রে ইংরেজি নাম ব্যবহার রোধে কতটা কাজ করছে? এ বিষয়ে জানতে কথা হয় চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা ইংরেজি নামের ক্ষেত্রে খুব কঠোরভাবে হস্তক্ষেপ করি। যেমন ধরুন, ‘সুইট হার্ট’ এই শব্দটা আমরা ব্যবহার করি। এর বাংলাটা আমরা ব্যবহার কম করি। তাই এ ধরণের নাম নিবন্ধন করি। এছাড়া কিছু শব্দ আছে বিদঘুটে। যেমন ‘পাঙ্কু জামাই’। এটা আমরা দিতে চাচ্ছিলাম না। বাংলা ডিকশনারিতে নেই এমন নাম আমরা দিতে চাই না। যেমন ‘মিসডকল’ নামটি আমরা দিতে চাচ্ছিলাম না। পরবর্তীতে সেন্সর বোর্ডের সচিব বরাবর চিঠি দিয়ে এই নামটি তারা নিয়েছে।’

সেন্সর বোর্ডে সিনেমার ত্রুটি বা অসামঞ্জস্য দেখেন। সেন্সর বোর্ডের অনুমতি পেলেই প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা মুক্তি দেয়া সম্ভব। ইংরেজি নামের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড কতটা ভূমিকা রাখছে জানতে কথা হয় চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সচিব মুন্সি জালাল উদ্দিনের সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে ইংরেজি নামের ব্যবহার বেড়ে গিয়েছিল। এরপর ২০১৫ সালে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে যেটা বলা হয়েছে সেটা ছিল পরামর্শমূলক এবং বাংলা নামকে উৎসাহিত করা। এখনো ইংরেজি নাম বন্ধ হয়নি। তবে কিছুটা কমেছে। সেন্সর বিধিতে নেই যে ইংরেজি নাম দিলে চলচ্চিত্র আটকে দেয়া হবে। এছাড়া সরকারও এ নিয়ে কোনো আইন করেনি।’

ইংরেজি নামে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে জমা পড়লে আপনারা পদক্ষেপ নেন কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে মুন্সি জালাল উদ্দিন বলেন, ‘সেন্সর বোর্ড দেখে সেন্সর বিধির সঙ্গে সিনেমাটি সাংঘর্ষিক কিনা, যদি হয় তখন ব্যবস্থা নেয়া হয়। চলচ্চিত্রের সার্বিক ভাষা কি সেটাই এখানে দেখা হয়। সেক্ষেত্রে বেমানান শব্দ থাকলে কেটে বাদ দেয়া হয়।’

চলচ্চিত্র নির্মাণ শুধু বিনোদনেই সীমাবদ্ধ নয়। এর মধ্যে ব্যবসায়িক দিকটাও মাথায় রাখতে হয় প্রযোজকদের। এ ক্ষেত্রে বাংলা চলচ্চিত্রে ইংরেজি নাম কতটা যৌক্তিক বলে মনে করছেন প্রযোজক? এ প্রসঙ্গে জানতে কথা হয় মনোয়ার হোসেন ডিপজলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাংলা  চলচ্চিত্রে কেন ইংরেজি নাম দিতে হবে? এটা আমাদের সংস্কৃতির জন্য ক্ষতি। আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে এখন বিদেশের অপসংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে। এর সমাধান তথ্য মন্ত্রণালয় দিতে পারে। তারা নিরুৎসাহিত কেন করবে না? তারা সরাসরি আইন করে এটা বন্ধ করে দিলেই হয়।’

অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ডের নামটিও ইংরেজিতেই সমধিক পরিচিত। চলচ্চিত্রে ইংরেজি নাম বাতিল করার পাশাপাশি সেন্সর বোর্ডের নামও পরিবর্তন করে বাংলায় করা উচিৎ বলে মনে করছেন চলচ্চিত্রবোদ্ধারা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/রাহাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়