ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মায়ের কারণেই আজ আমি সুচন্দা

কোহিনুর আক্তার সুচন্দা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০১, ১৩ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মায়ের কারণেই আজ আমি সুচন্দা

কোহিনুর আক্তার সুচন্দা

মা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মা ছাড়া কোনো সন্তানই বড় হতে পারে না, ভালো হতে পারে না। এটা আমার ভাবনা। বিশেষ করে ছোটবেলা থেকে একটি সন্তান যখন বড় হতে থাকে তখন থেকে সন্তানের ভবিষ্যৎ মায়ের হাতেই গড়তে থাকে। আমার মা একদম অন্যরকম মা ছিলেন। আমার মা একজন স্নেহময়ী আদর্শ মা ছিলেন। এ কথা বলছি কারণ তার কারণেই আজ আমি সুচন্দা হতে পেরেছি। মাকে ছাড়া আজকের আমি হতে পারতাম না। তার অবদান ভোলার না। মা আরো কিছু কাল বেঁচে থাকলে হয়তো আমি আরো কিছু অর্জন করতে পারতাম। সেটা আমার দুর্ভাগ্য।

কলকাতার বিখ্যাত লেডি ব্রেবোন কলেজ থেকে আমার মা পড়াশোনা করেছেন। তখন মুসলমান মেয়েদের লেখাপড়া করাটা খুব কঠিন ছিল। আমাদের গ্রামের বাড়ি যশোর। যে বছর মা ম্যাট্রিক পাস করেন ওই বছর যশোর জেলায় মোট ৭জন মেয়ে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন। ওই ৭জনের মধ্যে আমার মা একমাত্র মুসলিম মেয়ে ছিলেন। বাদ বাকি সবাই হিন্দু ছিলেন। মা কলকাতায় পড়াশোনা করেছিলেন এজন্য আমার মায়ের মানসিকতাও সংস্কৃতিমনা ছিল। সেই কারণে আমি যাতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভালো কিছু করতে পারি মা-ই আমাকে প্রেরণা দিয়েছিলেন। পথ দেখিয়েছিলেন। তবে চলচ্চিত্রাঙ্গনে আমাকে আসতে হবে এমনটা ভাবেননি। ছোটবেলা থেকে নাচ, গান, ছবি আঁকা থেকে শুরু করে ঘরের রান্না-বান্নার কাজও তিনি শিখিয়েছেন। চলচ্চিত্রে আসার কারণে যদিও অন্য কিছু তেমনভাবে করা হয়ে উঠেনি। ছোটবেলায় রবীন্দ্রসংগীত গাইতাম। বাড়িতে আমার জন্য নাচ ও গানের শিক্ষক রেখে দিয়েছিলেন। নাচের শিক্ষক বাঁশের বাঁশি বাজাতেন। তিনি বাঁশি বাজাতেন আর আমি নাচতাম। আমার ওই শিক্ষকের নাম ছিল মুক্তার আলী। তারপর যখন একটু বড় হলাম তখন পাড়ায় একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ছিল ওখানে আমরা দল বেঁধে নাচ শিখতাম। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতাম। আমি যেন সবকিছুতেই অংশগ্রহণ করি এবং ভালো পারফর্ম করি এ বিষয়ে আমার মায়ের আদেশ ছিল।

আমার অল্প বিস্তর লেখালেখির অভ্যাস রয়েছে। যদি সেক্ষেত্রে অনেক বড় কিছু করিনি। ইংরেজি ভাষার দখল আমি আমার বাবার কাছ থেকে গড়েছি। তবে বাংলা ভাষার দখলটা তৈরি হয়েছে মায়ের কাছ থেকে। মা বাংলা ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। মা নিজেও তখন লেখালেখি করতেন। নারীদের নিয়ে তিনি বেশ লেখালেখি করেছেন। সেগুলো তৎতকালীন কিছু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। মা একজন হোমিও ডাক্তার ছিলেন। সেবা সংঘ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে মা গরীবদের বিনা খরচে চিকিৎসা দিতেন। এটা সেবার অংশ হিসেবেই তিনি করতেন।

ছোটবেলায় মায়ের কাছে অনেক বকা খেয়েছি। তখন ছোট ছিলাম এতে অনেক সময় রাগও করেছি। এ প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা বলি, সম্ভবত তখন আমি ক্লাশ ফাইভে পড়ি। একদিন বাড়ির কাজের লোককে মা বললেন, ‘কিছু গোবর আর পানি নিয়ে আসো।’ তারপর লোকটি গোবর পানি নিয়ে আসলো। মেইন রোড থেকে আমাদের বাড়িতে ঢোকার যে রাস্তাটা সেই রাস্তায় মা গোবর ঢালতে বললেন। তো আমি দাঁড়িয়ে সব দেখছি। এরপর মা লোকটিকে বললেন, ‘একটা শলার ঝাড়ু নিয়ে আসো।’ লোকটি ঝাড়ু নিয়ে আসলেন। এরপর মা আমাকে ডাকলেন। আমি গেলাম। মা-বাবাকে যেমন ভয় পেতাম তেমনি আবার সম্মানও করতাম। মা যা বলতেন তাই করতাম। কাঁচা গোবরের একটা গন্ধ আছে। এদিকে গন্ধটা আমার নাকে লাগছিল। আমি তখন সালোয়ার কামিজ পরি। পরনের জামা দিয়ে নাক-মুখ ডেকে রেখেছি। কাছে যাওয়ার পর মা বললেন, ‘তোমার সালোয়ার কুচিয়ে একটু উপরে তোলো।’ আমি তুললাম। তারপর মা বললেন, ‘এই গোবর এখন পা দিয়ে পাড়াও।’ আমি পাড়ালাম। এরপর বললেন, ‘এখন গোবরে পানি ঢালো।’ আমি পানি ঢাললাম। এরপর মগ দিয়ে পানি ঢাললাম আর পা দিয়ে গোবর ছড়াতে লাগলাম। এক পর্যায়ে গোবর যখন তরল হয়ে গেল তখন মা বললেন, ‘এই গোবর মাখা পানি এখন শলা দিয়ে ঝাড়ু দাও।’ মানে গ্রামে উঠান যেমন গোবর দিয়ে লেপে দেয় তেমন করে লেপতে বললেন। আমাদের বাড়ি থেকে মেইন রোড পর্যন্ত পুরো রাস্তাটাই লেপতে বললেন। আমি যখন কাজ শুরু করলাম তখন আমার দাদা এসে হাজির। আমার এ অবস্থা দেখে দাদা মাকে বললেন, ‘বউ কী ব্যাপার, আমার বংশের বড় নাতনিকে দিয়ে তুমি গোবর পাড়াচ্ছো, এই সাহস তুমি কোথা থেকে পেলে?’ তখন আমার মা দাদাকে বললেন, ‘আব্বা, মেয়েদের সবকিছু শিখতে হয়। কোথায় কখন কোন কাজটির প্রয়োজন হবে সেটা বলা মুশকিল। আর কার ভাগ্যে কি আছে সেটা বলাও মুশকিল। আমি ওকে সব কাজ শেখাব। ও যাতে অল রাউন্ডার হয়। ও যাতে কখনো কোনো কাজে ‘না’ না বলে।’ এ কথাগুলো আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। এরপর দাদা আর কিছু বললেন না। এখন মায়ের সেসব কাজ ও কথার মানে উপলদ্ধি করতে পারি।

আমি তখন স্কুলে পড়ি। একবার মা বললেন, ‘তুমি বাড়ির বড় মেয়ে অথচ তোমার ছোট ভাই-বোনের কাপড় দর্জির কাছে সেলাই করতে হয়, এটা কোনোভাবেই হতে পারে না। সেলাইয়ের কাজ তুমি শিখে নাও এগুলো তুমি করো।’ এরকম অনেক কথাই জমা আছে। কটা বলে শেষ করব। প্রতি ঈদে মা আমাকে দিয়ে দুই পদের খাবার রান্না করাতেন। যে কোনো দুটি পদ। সে রান্না ভালো হোক আর মন্দ হোক। তিনি সব শিখিয়ে দিতেন। আমাকে আপনি যেকোনো কাজ দেন আমি করতে পারব। যদি বলেন লাঙল দিয়ে চাষ করতে হবে সেটাও পারব। এটা অবশ্য শুটিংয়ের কারণে শিখেছিলাম। ধান ঝাড়া, ধান বানা এমন কোনো কাজ নেই যা আমি পারব না। এমনকি এখনো আমি কাজ করি। সময় পেলে কোনো না কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। অমার জীবনে মায়ের যে প্রভাব ভোলার মতো না। মা আমাকে যেভাবে শিক্ষা দিয়েছেন এগুলো আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি। মাকে খুব মনে পড়ে। আমার মা একজন স্নেহময়ী, মমতাময়ী ছিলেন।

শ্রুতি লিখন : আমিনুল ইসলাম শান্ত



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মে ২০১৮/শান্ত/মারুফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়