ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

ঈদে কেমন নাটক চাই?

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:০৬, ১৭ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঈদে কেমন নাটক চাই?

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল : ঈদে কী ধরণের নাটক চাই? দর্শক হিসেবে যদি বলি,  তা হলে বলব আমি সাধারণ মানুষ। আমি যা চাই আপনি যদি তাই বানিয়ে আনেন, তা হলে আমি নির্ঘাত নতুন কিছু পাব না। কারণ এক ধরণের প্রি-কনসেপ্ট থেকে দর্শকের চাহিদা তৈরি হয়, সেই চাহিদা বহুবার দেখা জিনিসের পুনরাবৃত্তি বৈ বেশি কিছু হবার সামর্থ রাখে না! মানুষের মস্তিষ্কের নিউরন বড়ই বিচিত্র, যেকোনো নতুন সংকেতে উদ্দিপ্ত হবার অপরিসীম ক্ষমতা সে রাখে। সুতরাং অসীম ক্ষমতাধর এই মগজকে সীমাবদ্ধ করতে নেই!

এখন প্রসঙ্গে আসা যাক। আমার প্রারম্ভিক আলাপে দয়া করে কেউ এই ভেবে বিভ্রান্ত হবেন না যে, আমি ঈদের নাটক নিয়ে দর্শকের কোনো প্রত্যাশা তৈরি হওয়াকে সমর্থন করছি না। ঈদের আনন্দ দ্বিগুন করতে যুতসই ঈদ অনুষ্ঠানমালা তো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুতরাং মোটাদাগে দর্শকের প্রত্যাশা থাকবে নিজের সময় ব্যয় করে সে যখন টিভি সেটের সামনে বসবে, সেটা যেন সার্থক মনে হয়। কিন্তু দর্শকের দায় পড়েনি আপনি কী বানাবেন,  তা সে ঠিক করে দেবে।

নাটক তো আসলে নিছক বিনোদনের বস্তু নয়, এর সঙ্গে মানুষের রুচিবোধ, সমসাময়িক শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিফলন, পারিবারিক ও রাজনৈতিক চেতনা জড়িত। এই সকল উপাদানের সম্মিলিত প্রতিফলনে উদ্দিপ্ত হবার ক্ষমতাকে আমি সুস্থ বিনোদন বলব। কিন্তু আজকাল  বিশেষ করে এই বছর যা আভাস পাচ্ছি, তাতে উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ আছে। বিনোদন দেবার নাম করে ভাঁড়ামি আমদানি করার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। মানুষের লঘু রুচির দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করে লাভ নাই। আপনি দিনের পর দিন সস্তা থেকে সস্তাতর বিনোদন(!) উৎপাদন করে চলবেন, আর মানুষের রুচি খুব সূক্ষ্ম উচ্চতায় অবস্থান করবে, তা তো হবে না! মানুষের রুচি নিয়ন্ত্রণের নেপথ্য কারিগর তো আমার আপনার মতো নির্মাতাগণ। এই বাংলাদেশেই ‘সংশপ্তক’, ‘গ্রন্থিকগণ কহে’ বা ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’-এর মতো চিন্তানিষ্ঠ গভীর বিষয়বস্তুর নাটক যে তুমুল জনপ্রিয় ছিল তা ভুলে গেলে চলবে না। এরপর প্যাকেজ নাটক যুগের মধ্য ভাগে আমরা লঘুতার দিকে ধাবিত হলাম। এই লঘুতা আর ভাঁড়ামো যখন চূড়ান্তরূপ নিল তখন একুশে টেলিভিশনের ছায়ায় সাইদুল আনাম টুটুল, নুরুল আলম আতিক, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, গিয়াস উদ্দিন সেলিমদের হাত ধরে আমরা পুনরায় গভীর শিল্পসম্মত নাটকে ফিরে যেতে শুরু করলাম। এরপর অমিতাভ রেজা, অনিমেষ আইচ, মাসুদ হাসান উজ্জ্বল (নির্লজ্জের মতো নিজের নামটা বলতে হচ্ছে), মেজবাউর রহমান সুমনদের আগমনে শিল্পসম্মত নাটক চূড়ান্ত একটা জায়গায় পৌঁছল।

দর্শক কেবল সাদরে সেসব নাটক গ্রহণ করল বললে ভুল হবে, গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল। এই সময়টাতে উল্লেখযোগ্য হারে ভাঁড়ামি কমতে শুরু করল। ঈদে যেহেতু বাজেটটা ভালো পাওয়া যায়, সবাই তার সেরা গল্পটা ঈদের জন্য তুলে রাখত। ঈদ মানেই লঘু বিনোদন, যথেচ্ছাচার ভাঁড়ামি, এই কনসেপ্ট থেকে আমরা চূড়ান্তভাবে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হলাম। ঈদ এলে Thought provoking নাটক নির্মাণের যেন একটা প্রতিযোগিতা লেগে যেত। দর্শকও অধির আগ্রহে বসে থাকত সেসব নাটক উপভোগ করবে বলে। এবং লক্ষ্য করবেন, এই সমস্ত পরিচালকদের নির্মাণশৈলী সবসময়ই স্বতন্ত্র, গল্প নির্বাচন থেকে শুরু করে নির্মাণে কারো সঙ্গে কারো মিল নেই। এসব শুনে মনে হচ্ছে না আমি প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা বলছি! কিন্তু না, আমি মধ্যপথে অতীত হয়ে যাওয়া জ্বলজ্বলে বর্তমানের কথা বলছি, যেখানে মুহূর্তেই সবকিছু অতীত হয়ে বাতিল বলে বিবেচিত হয়।

 



এখনকার নাটকে সবচেয়ে প্রকটভাবে যেটি ধরা পড়ে, তা হলো স্বকীয়তার অভাব। কি এক ইউটিউবের আগমন হলো দেশে, সেখানে একখানি লাইকের লোভে রহিমুদ্দিন আজ যা বানালেন পরের দিনই করিমুদ্দিনও সেই পথে হাঁটা শুরু করলেন। ফলে নিজস্ব ভাবনার জায়গা আর অবশিষ্ট রইল না। হঠাৎ করে ৬০ বা ৭০ দশকের মেলোড্রামায় ফেরত যাবার প্রবণতাও আমাকে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন করে। সবাই মিলে ঠেলেঠুলে টেলিভিশন নাটককে যখন একটা উচ্চতায় নেওয়া হলো, তখন হ্যাঁচকা টানে তাকে হয় মেলোড্রামা, নয়তো ভাঁড়ামি দিয়ে টেনে নামানো হলো। ২০১৭ সালে যদিওবা অস্থির সময়ে স্বস্তির গল্প বা ছবিয়াল রিইউনিয়নের বেশ কিছু কাজ যথেষ্ট আশা জাগিয়েছিল কিন্তু তার ধারাবাহিকতার ন্যূনতম রেশটুকুও এ বছর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আমরা রসাতলে যাওয়ার জন্য এতটাই ব্যাতিব্যস্ত যে, এখনই সমস্ত অর্জন টেনেহিঁচড়ে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। এখন নাটক নায়ক-নায়িকা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেখানে একজন ঠিকাদার আর পরিচালকের ভূমিকার তেমন কোনো পার্থক্য নেই। সুতরাং যেখানে মেধার প্রাধান্য নেই, সেখানে নতুন ভাবনার যে আগমন ঘটবে না সে কথা বলাই বাহুল্য। জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকারা এই সকল পরিচালক নামধারী ঠিকাদারদের ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলটিও ঠিক করে দিয়ে থাকেন। অভিজ্ঞ নায়ক বা নায়িকা সহ-শিল্পীকে সিনও বুঝিয়ে দিচ্ছেন আজকাল। সুতরাং এহেন পরিস্থিতিতে ঈদের নাটক নিয়ে নিজের প্রত্যাশার কথা কি আর বলব! শুধু বলতে পারি, এই সকল গা জোয়ারি বাদ দিয়ে নতুন চিন্তা আমদানি করার ম্যাজিকটা দেখান।

আমি জানি, বাংলাদেশ মানে কেবলমাত্র রাজধানী ঢাকা নয়। বাংলাদেশ মানে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর অশিক্ষায় মোড়ানো একটা দেশ। কেবলমাত্র নগর সভ্যতার মানদণ্ডে দেশের বিনোদন জগত সাজালে চলবে না। কিন্তু এ কথাও তো সত্যি বিশ্বায়নের এই যুগে নগরই তো সবকিছুর দিক-দিশা ঠিক করে দেয়। আমি কেবলমাত্র ফোন কোম্পানিগুলোর উদাহরণ দিয়েই আমার কথার যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পারি। এ দেশে যখন নতুন নতুন সেল ফোন আসে, আমরা কি ঘুণাক্ষরেও অনুমান করেছিলাম যে, অক্ষর জ্ঞানহীন মানুষও একদিন ফোনবুক থেকে নিজের কাঙ্ক্ষিত নম্বর বের করে ডায়াল করে কথা বলবে? এখন কিন্তু এটিই এই দেশে স্বাভাবিক বাস্তবতা। মানুষের গ্রহণ করার ক্ষমতা অপরিসীম, কেবলমাত্র তার কাছে সঠিক সময়ে সঠিক জিনিসটি পৌঁছে দিতে হয়। আমরা যখন স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করতে যাই, তখন সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব থেকে অগ্রসর মানুষ হিসেবে একজন শিক্ষককেই জানি। শিক্ষক কিন্তু শিক্ষার্থীর চাহিদা মাফিক পাঠ দান করেন না, শিক্ষার্থীর জন্য যা কিছু দরকারি সেই পাঠ তিনি দিয়ে থাকেন।

একজন নির্মাতাকে আমি জাতির শিক্ষকের ভূমিকায় দেখতে চাই, ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়। কিন্তু একজন নাট্য বা চলচ্চিত্র নির্মাতাকে আমি শিক্ষা, জ্ঞান, দর্শনে ঋদ্ধ একজন অগ্রসর মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করি। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিই আমি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু কিছু অনুর্বর মস্তিষ্কের তথাকথিত নির্মাতা প্রান্তিক জনগোষ্ঠির চাহিদা হিসেবে যে কল্প কাহিনিকে ঠাউরে নিয়েছেন, তা আমাকে বিস্মিত করে। কৃষকের বা রিকশাওয়ালার বিনোদন চাহিদা মেটানোর জন্য আপনার রুচি আর মননকে তার স্তরেই কেন নামিয়ে নিতে হবে তা আমার বোধগম্য নয়। আপনি তো সমাজের একজন অগ্রসর মানুষ, আপনার কাজ তো নিচের দিকে নামা নয়, আপনার দায়িত্ব সমাজের অনগ্রসর শ্রেণিকে আপনার স্তরে টেনে তোলা। আবারো বলছি, মানুষের গ্রহণ করার ক্ষমতা অপরিসীম, যে অক্ষর জ্ঞানহীন কৃষক ফোনবুকে ঢুকে কাঙ্ক্ষিত নাম্বার ডায়াল করতে পারে, ক্রমাগত চেষ্টা করে গেলে একদিন সে বার্ড ম্যানের মতো চলচ্চিত্র দেখে তালি বাজানোর ক্ষমতাও রাখে।

লেখক : নাট্যকার, সংগীত পরিচালক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ জুন ২০১৮/শান্ত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়