ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চিকিৎসাসেবার নাজুক পরিস্থিতি

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৫, ২৬ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চিকিৎসাসেবার নাজুক পরিস্থিতি

অলংকরণ : গিয়াস উদদীন সিজার

হাসান মাহামুদ: বাংলাদেশে পোশাক খাতের পরই স্থান পোল্ট্রি খাতের। কিন্তু এই শিল্পটি গড়ে ওঠা থেকে পরিচালিত হওয়া, সবই চলছে অনেকটা অভিভাবকশূণ্য হয়ে। প্রশিক্ষণের অভাবে খামারিদের অসচেতনতায় পোল্ট্রিতে বাড়ছে অনাকাঙ্খিত ওষুধের ব্যবহার। প্রয়োজনীয় প্রচারণার অভাবে নতুন নতুন চিকিৎসা ও ভ্যাকসিন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রান্তিক পর্যায়ের খামরিরা। এতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ, লোকসানে পড়ছেন তারা।

পোল্ট্রি শিল্পে গত কয়েক বছরে বিনিয়োগ বেড়েছে। একই সঙ্গে চিকিৎসা সেবার মানও বেড়েছে। কিন্তু খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনো এ শিল্পের চিকিৎসাসেবা কাঙ্খিত পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। বিশেষ করে, প্রান্তিক খামারিরা এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রে বঞ্চিতের কাতারে থেকে যাচ্ছেন। এর অন্যতম কারণের মধ্যে রয়েছে- প্রচারণার অভাব, অপ্রতুল প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, সরকারিভাবে গৃহীত প্রকল্প বা কর্মসূচির স্বল্পতা, জাতীয়ভাবে পোল্ট্রির গুরুত্ব অনুধাবনের অভাব, প্রভৃতি।

খাতসংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার কারণে গত কয়েক বছরে মুরগিরর বেশকিছু রোগ শনাক্ত করা গেছে। যেগুলো সম্পর্কে আগে খামারিরা জানতেন না। কিন্তু এখনো মুরগির সব রোগের বিশেষ করে ভাইরাসজনিত রোগের ফলপ্রসু চিকিৎসা দেশে হয় না। পাওয়া যায় না ওসব রোগের ওষুধও। একই সঙ্গে ক্ষতিকর কিছু ওষুধের বিরুদ্ধে অনেকবার আওয়াজ ওঠার পরও দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো এখনো ওসব ওষুধ বাজেয়াপ্ত বা বন্ধ করতে পারেনি।

দেশে যে সংখ্যক ডিসট্রিবিউটর, ফার্মেসি প্রভৃতি রয়েছে, তা এ খাতের ওষুধ-ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। কিন্তু শুধু প্রচারণা ও প্রশিক্ষণের অভাবে প্রান্তিক খামারিরা হালনাগাদ চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ পায় না। এমনকি বেশিরভাগক্ষেত্রে অনেক হাত বদলের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের ওষুধ, ভিটামিন এবং ভ্যাকসিন উচ্চদামে কিনতে হয়।

এসব সমস্যার সমাধানে, খামারিদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সরকারের বিভিন্ন সময়ে নেওয়া পরিকল্পনা ও উদ্যোগ বাস্তবায়ন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে এন্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহারে জোর দেওয়া এবং জাতীয় পোল্ট্রি উন্নয়ন নীতিমালার পূর্ণ বাস্তবায়নের কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

খামারের মুরগির বিভিন্ন রোগ নিয়ে খুব বেশি গবেষণা কিংবা প্রচারণা হয় না। এতে এক এলাকায় মুরগির কোনো রোগ হলে দেশের অন্য প্রান্তের খামারিরা জানতে পারেন অনেক দেরিতে। কিন্তু মুরগির রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে আগে থেকে জানা থাকলে আগেই সাবধান থাকা ও দ্রুত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতো। পোল্ট্রি খাতের বিভিন্ন রোগ নিয়ে প্রচারণার অভাবে আমরা এখনো ঘুরেফিরে শুনি মুরগির শুধু কয়েকটি রোগের নাম। আবার, বিশ্বব্যাপী চিকিৎসাসেবার মান বাড়ছে, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রতিষেধক আবিস্কার হচ্ছে, নতুন নতুন রোগ চিহ্নিত হচ্ছে। কিন্তু প্রশিক্ষণের সুযোগের অভাবে খামারিরা এসব তথ্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। অথচ এ বিষয়ে গবেষণা হলে আরো অনেক রোগ সনাক্ত করে চিকিৎসা সম্ভব হতো। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে খামারিরা হালনাগাদ তথ্য জানার মাধ্যমে উপকৃত হতো।

বন্ধ হচ্ছে না প্রাণিখাদ্যে ক্ষতিকর এজিপি ব্যবহার: জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো পোল্ট্রি ফিডে এন্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটর বা এজিপি ব্যবহার নিষিদ্ধ আমাদের দেশে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ২০১৪ সালের আগস্টে এজিপি ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। ইউরোপিয়ান কমিশন এজিপি ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ২০১৬ সালে। এরপর আমেরিকা ও কানাডা একই নীতি অনুসরণ করে। জানা গেছে, পোল্ট্রি ফিডে এজিপি ব্যবহার না হলেও পানিতে ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা নেই। ফলে পানিতে ঠিকই ব্যবহার হচ্ছে ক্ষতিকর এজিপি।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- দেশে গ্রোথ প্রোমোটর হিসেবে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে তবু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পোল্ট্রি, গরু ও মাছের খাবার তৈরিতে এসবের ব্যবহার করছে। সেক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে তদারকি না থাকার দায় সরকার এড়িয়ে যেতে পারে না।

এখনো অসনাক্তকৃত ও অপ্রচারিত অনেক রোগ: মুরগির রোগ হিসেবে আমরা পরিচিত- রাণিক্ষেত, কলেরা, আমাশয়, কৃমি, সালমোনেলোসিস এসব নাম। কিন্তু এর বাইরেও এরই মধ্যে বাংলাদেশেই কোনো না কোনো এলাকায় মুরগির হয়েছে এমন আরো কিছু রোগ।  সেগুলো হচ্ছে- ইনফেকশাস ল্যরিংগোট্রাকিয়াটিস (মুরগির ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একপ্রকার শ্বসনতন্ত্র আক্রান্তকারী রোগ। এ রোগের অপর নাম এভিয়ান ডিপথেরিয়া), পালমোনারি হাইপারটেনশন সিনড্রোম বা এসাইটিস (মুরগির পেটে পানি জমা রোগ নামে পরিচিত। এটি হলে মুরগির শরীরের কোষগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় এবং আন্তঃকোষীয় তরল পদার্থ ভেদ করে চামড়ার নিচে জমা হয়), গামবোরো (একটি ভাইরাসজনিত রোগ, একে মুরগির এইডসও বলা হয়), নেক্রোটিক এন্টারাইটিস, ই-কোলাই, ক্যাপিলারিয়া প্রভৃতি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোল্ট্রি সংক্রান্ত কিছু রোগ সনাক্ত করা এবং এসবের ভ্যাকসিন-টিকার মধ্যেই আটকে আছে এ শিল্পের চিকিৎসা। কিন্তু পোল্ট্রির বিভিন্ন সমস্যা, রোগ-জীবাণু, সংক্রমণ নিয়ে আরো বেশি প্রচারণা প্রয়োজন। যাতে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা সচেতন হতে পারেন। এই খাতের উন্নয়নে প্রয়োজন বিষয়ভিত্তিক গবেষণা। এর বাইরে, চিকিৎসা সংক্রান্ত সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের তদারকিও বাড়ানো প্রয়োজন।

এভিয়ান এনসেফালোমায়েলাইটিস রোগের চিকিৎসা নেই দেশে: এভিয়ান এনসেফালোমায়েলাইটিস বিশেষ করে বাচ্চা মোরগ-মুরগির ভাইরাসঘটিত একটি মারাত্মক রোগ। মাথা ও ঘাড়ের মাংসপেশীর অসমক্রিয়া ও কম্পন এ রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ রোগের ভাইরাস প্রধানত ৬ সপ্তাহের মোরগ-মুরগিকে আক্রান্ত করে থাকে। প্রাকৃতিকভাবে ফেজান্ট, কোয়েল ও টার্কি এ রোগের ভাইরাসের প্রতি সংবেদনশীল। এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুস্থ মুরগিকে আক্রান্ত করে থাকে। আক্রান্ত মুরগির মলে এ রোগের ভাইরাস থাকে, যার দ্বারা খাদ্যদ্রব্য দূষিত হলে এবং সেই খাদ্য গ্রহণ করলে সুস্থ মুরগিতে এ রোগের বিস্তার ঘটে। আক্রান্ত মুরগির ডিমের মাধ্যমে এ রোগের ভাইরাস সংক্রমিত হয়।  এমনকি ইনকিউবেটর থেকেও এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে।

পুষ্টিবিদদের মতে, মুরগির বাচ্চা ও ভ্রুণে এই ভাইরাস বিস্তার লাভ করে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকেই এ রোগের সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়। তবে ওসব দেশে ইতোমধ্যে মুরগির এই রোগের চিকিৎসা-প্রতিষেধক আবিস্কার হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো এই রোগের সন্তোষজনক চিকিৎসা হয় না।

তবে খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, এখনো এই রোগের জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে চলছে বাংলাদেশের অসংখ্য পোল্ট্রি খামার। জানা গেছে, মুরগির ইনফেকশাস এনসেফেলোমায়েলাইটিস রোগ প্রতিরোধকল্পে হিমশুষ্ক লাইভ ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয় আমাদের দেশে। এই ভ্যাকসিন এখনো দেশে খুব বেশি সহজলভ্য নয়। এটি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞের অভাব: দেশে এখনও পোল্ট্রি শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত লোকবল নেই। এমনকি প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত লোকবল তৈরির এবং এ নিয়ে গবেষণার সুযোগও অপর্যাপ্ত। তাই কনসাল্ট্যান্ট হিসেবে বিদেশ থেকে আনতে হচ্ছে বিশেষজ্ঞ। কোন রোগ দেখা দিলে তা গবেষণা করতে পাঠাতে হচ্ছে বাইরের দেশের কোন গবেষণাগারে।

দেশের অল্প কয়েক স্থানে মাঠ পর্যায়ে রোগ অনুসন্ধান কেন্দ্র রয়েছে, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় না। এক্ষেত্রে খাতসংশ্লিষ্টরা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে চিকিৎসক হিসেবে পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞ নিয়োগেরও দাবি জানান।  যদিও খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আগের থেকে বাড়ছে। তবে এই হার আরো বাড়ানো দরকার বলে মন্তব্য করছেন তারা।

ভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকি: বিশ্বখাদ্য ও কৃষি সংস্থার রিপোর্টে দেখা যায়, বাংলাদেশ ও অপরাপর পাঁচটি দেশে এই ভাইরাসের সংক্রমণ রয়েছে। যথাযথ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ না করা ও সময়োপযোগী ভ্যাকসিনেশনের অভাবে এ শিল্পটি যথেষ্ট হুমকির মুখে রয়েছে। এছাড়া আরো বেশকিছু সমস্যা রয়েছে যা পোল্ট্রি শিল্প বিকাশের অন্তরায়। এসব প্রাণীর খাবার প্রস্তুতের জন্য কিছু উপাদান বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর ওপর আরোপিত ট্যাক্সের পরিমাণ কমানোর দাবি জানান খামারিরা।

সামগ্রিক বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন) ডা. আইনুল হক বলেন, ‘পাখি ও পশুতে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার মানুষের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। শুধু সরাসরি এন্টিবায়োটিক গ্রহণ নয়, এসবের মাধ্যমেও মানুষের শরীরে এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা হারিয়ে যাচ্ছে। তাই এ ব্যাপারে আমাদের অধিক সতর্ক থাকতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে গ্রোথ প্রোমোটর হিসেবে নিষিদ্ধ এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার হচ্ছে। শুধু পোল্ট্রি নয়, গরু ও মাছের খাবার তৈরিতেও এসবের ব্যবহার হচ্ছে। এদের রোধ করতে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, কিছু সুপারিশ জানানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। পাশাপাশি অনুমোদিত চিকিৎসক ছাড়া যাতে কেউ এন্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব না করতে পারে সেজন্যও আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

**




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ অক্টোবর ২০১৮/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়