ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মিয়াছদ্দিনের ফেরা না ফেরা

মিলন আশরাফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৯, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মিয়াছদ্দিনের ফেরা না ফেরা

||মিলন আশরাফ ||

‘ও মেজে বু, শুনচিস। ও বু, গিরাম থেইকে নাকি জোয়ান তাগড়া ছুড়াদের ধরে নিয়ে যাচ্চে!’

‘হ্যাই গো বু। সাতে নোতন বও, শ্যাইনা মেয়েদেরও রিহায় দেচ্চে না শুনলাম।’

 

বুকের খোড়লে দুপদাপ শব্দ হয় সোনাভান বিবির। বিয়ের আজ সাত দিন তার। মেহেদির দাগ শুকায়নি এখনো। সহবাসে ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে তলপেট। সকালের কাঁচা আলোয় অগোছালো শাড়ির ভাজে স্তনযুগল ভয়ে চুপসে যায়। শ্বাসটা ওঠানামা করে দ্রুত। পাড়ার ছেলেমেয়েদের হইজকারে দেহে একটু শক্তির সঞ্চয় হয়। বাচ্চারা আগুন ধরিয়ে কী যেন পোড়াচ্ছে। চিৎকার করছে কেউ কেউ। বাতাসে সেই চিৎকার প্রতিধ্বনি হয়ে সোনাভানের কানে আসে।

 

‘পোড় শালা মিলিটারির বাচ্চা। পোড়। পুড়ে পুড়ে ছাই হ।’

 

পুব পাড়ার শাহাদত চিকন বাঁশ এনে মিলিটারির প্যান্টের পাছার কাছে গুঁতা মারে, আর বলতে থাকে, শালা। এই নে তোর পুঙয়ার মদ্দি ঢুকিয়ে দিলাম। এবার মজা বোজ্ শালা!

 

উপস্থিত যুবক চ্যাঙড়ারা একসঙ্গে যাত্রা পালার জুম্মন কসাইয়ের মতো হো হো করে হেসে ওঠে। তাদের হাসি শুনে কেঁদে ওঠে সোনামুখী গ্রামের নাজিমের বোন রাবেয়া। দশম শ্রেণির ছাত্রী সে। দেশের খারাপ অবস্থা দেখে ঘরেই থাকতো সারাক্ষণ। আর চাঁচের ছোট্ট জানালা দিয়ে দেখতো নীল আকাশ। মেঘ দেখলেই ভীষণ ভয় লাগতো রাবেয়ার। কিন্তু গত রাতে আকাশে মেঘ না থাকলেও বজ্রপাতে পুড়ে গিয়েছিল তার সমস্ত শরীর। গোবর চটকানোর মতো তাকে চটকিয়ে রেখে গেছে মিলিটারিরা। গোবরের ভাগ্যে তো নুড়ি হবার সৌভাগ্য থাকে, তার তাও হয়নি। দেহটা তার অসাড় নির্জীব। দৈত্যরূপে ৪ জন চারপেয়ে জন্তু গতরাতে খুবলে ফেলে রেখে গেছে তাকে।

 

সোনাভানের স্বামী মিয়াজউদ্দিন। গ্রামে সবাই ডাকে মিয়াছদ্দিন। টগবগে যুবক। নব বিবাহিত। শক্ত সামর্থ্য পুরুষ। মুখের উপর উজ্জ্বলতার ছাপ স্পষ্ট। সুঠাম দেহে ভালোবাসার সুবাতাসে মৌ মৌ করে সারাক্ষণ। তার দেহের বলিষ্ঠতার প্রমাণ রাতের বিছানায় বহুবার পেয়েছে সোনাভান। কিন্তু আজ তার শরীরটা কেন জানি অজানা আশঙ্কায় কাঁপছে। রাতের বিছানায় সোনাভানকে ডেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস জড়িয়ে মিয়াছদ্দিন বলে, জানো। শালা মিলিটারির শুয়োরের বাচ্চারা নাজিমদের বাড়িতে হামলা করে, তার বুন রাবেয়াকে ধর্ষণ করেচে। শাজান, দিলা, শাদত চলে আসলি শালারা পালাইছে। দুটো প্যান্ট ফেলে দোড় দিয়েচে।

 

‘হ, জানি। সকালে শাদতরা প্যান্ট দুটো পুড়াচ্ছিল। আর রাবেয়া কিরাম করে জানি জানলা দিয়ে তাগিয়ে ছেলো।’

 

কথাগুলো বলতে বলতে গুঙিয়ে কেঁদে ওঠে সোনাভান। মিয়াছদ্দিন ধমক দিয়ে তাকে থামায়- চুপ কললি। তোদের এই মাগীদের খালি কান্নার স্বভাব। কিছু হলিই শুধু ফ্যা ফ্যা। আল্লা আল্লা কর।

 

কিছুক্ষণ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে সোনাভান। মিয়াছদ্দিনের ঘুম হয় না। এপাশ-ওপাশ করে সারারাত।

 

পরদিন খুব ভোরে চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায় রাবেয়াদের বাড়িতে। উঠোনের সামনের পিটল গাছে ঝুলে আছে রাবেয়া। চোখ ও জিহ্বা ভয়ংকরভাবে বাইরে বের হয়ে আছে বিঘাত খানিক। এপাড়া-ওপাড়া সবপাড়া থেকে মানুষজন এসে গিজগিজ করে রাবেয়াদের বাড়ির উঠোনে। চিৎকার ও নীরব কান্নায় সোনামুখী গ্রামে মাতম ওঠে। সকালটা কান্নাকাটি করে কেটে গেলেও দুপুরবেলা সোনামুখীর বাতাস ভারি হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। পাখিরা ডাকাডাকি করছে না যখন তখন। রাস্তার পাশে শিমুল গাছে বিষণ্ন চোখে তাকিয়ে আছে কয়েকটা পেঁচা। মিজান, গোলাম, ইমান পরণের লুঙ্গি দুই হাঁটুর উপর উঠিয়ে ভাজ করে দুটো গিঁট মেরে হেঁটে চলেছে মাঠপানে। গ্রামের মহিলারা গুজুরগুজুর ফুচুরফুচুর করতে ব্যতিব্যস্ত। এ ওর বাড়িতে গিয়ে হা-হুতাশ করে। মোটা বুদ্ধি চিকন বুদ্ধি একসঙ্গে মিশে আসন্ন যুদ্ধ নিয়ে আলাপ চলে। শুধু রাবেয়া আর তার পরিবার থাকে নীরব। ইতোমধ্যে অবশ্য সব পাড়ার লোকই এসে ফিরে গেছে। রাবেয়ার ভাই নাজিম যুদ্ধে যাবার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হয়। গ্রামে এখনো যুদ্ধে যেতে বাকি আছে যুবকদের মধ্যে নাজিম, হারাণ আর মিয়াছদ্দিন। খবর আসে আজ রাতে তাদেরকে নিতে আসবে গ্রাম থেকে যাওয়া অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা।

 

ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। নাজিমের বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়। হঠাৎ ঝটপট শব্দে অনেকগুলো পাখি পালিয়ে যায়। বাঁশপাতার খসখস শব্দ। নাজিমের বুক আঁতকে ওঠে। চাঁচের ছোট জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় সে। লুঙ্গি পরা কয়েকজন যুবককে দেখতে পায় সে। বাড়ির দিকেই আসছে তারা। জ্যোস্নার আলোয় তাদেরকে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। ওই যে, আতিয়ার, নূরউদ্দীন, কামাল ভাই। আনন্দে বুকটা নেচে ওঠে নাজিমের। যুদ্ধে যাবে সে লড়তে। হয় মারবে, না হয় মরবে। বেশি কথা ব্যয় না করে সে তাদের দলে ভেড়ে। তাদের সঙ্গে একে একে যোগ দেয় মোসলেম, ইমান, মিজান, গোলাম। বাকি থাকে শুধু মিয়াছদ্দিন আর হারাণ। তারা দুজন কেউ-ই গেল না নাজিমদের সঙ্গে। নতুন বউ রেখে মিয়াছদ্দিনের মন সায় দিলো না। আর পৈত্রিক বাড়ি ছেড়ে যেতে অসম্মতি জানায় হারাণ। চারিদিকে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে।

 

রোদের দাপটও খুব বেড়েছে। খালি পায়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটা যায় না। গ্রামের যুবকরা একে একে যুদ্ধে চলে গেছে। আর যারা যুদ্ধে যায়নি তারা বেনাপোল বর্ডার পার হয়ে সোজা ইন্ডিয়া। পুরো শার্শা থানাজুড়ে থমথমে আবহাওয়া বিরাজ করছে। খলসেমারি বিলে খলসে মাছ বুক চেতিয়ে আকাশ পানে একবার চেয়েই আবার ফুস করে ঘাড় গুঁজে পানির ভেতর মাথা চালান করে দেয়। প্রকৃতির নিস্তব্ধতা সোনামুখীর মানুষদের আরও চুপ করিয়ে দেয়। ঘন ঘন মিলিটারির গাড়ি গ্রামের ভেতর-বাহির প্রদক্ষিণ করছে সকাল দুপুর। ছোট ছোট বাচ্চারা মিলিটারির গাড়ি দেখে পড়িমড়ি করে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তাদের সামনে। গাড়ি থামিয়ে মিলিটারিরা মজার একটা খেলায় মাতে। বন্দুক উঁচিয়ে রাবারের লাল প্যান্ট পরা ছেলেদেরকে প্যান্ট খুলে নুনু চেক করে হাত ডলে ডলে। খেলতে খেলতে খেলার অংশ মনে ভেবে নাজমার ছেলের তলপেটে চাপ পড়লে মুতে দেয় এক মিলিটারির মুখের উপর। ক্ষেপে গিয়ে সে একটানে বোটা ছেঁড়ার মতো করে ছিঁড়ে ফেলে তার নুনু। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়। বেহুঁশ হয়ে ধুলায় মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় নাজমার ছোট ছেলে। ভারি বুটজুতার কয়েকটা লাথি মেরে, তীব্র আওয়াজে গাড়ি স্টার্ট করে স্থান ত্যাগ করে মিলিটারিরা।

 

যুদ্ধে অনেকের মতো নাজমার ছেলের প্রাণটাও ফুরিয়ে যায়। ইতিহাস তার নাম ভুলে গেলেও সোনামুখীর মানুষেরা ঠিকই মনের মধ্যে খোদাই করে রাখে আব্দুল্লাহর নাম।

 

গ্রামের শেষ দুজন যুবক মিয়াছদ্দিন ও হারাণ। তারাও শেষ পর্যন্ত  যুদ্ধে না গিয়ে রেহাই পেল না। একরাতে মিলিটারিরা জোর খাটিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায় তাদেরকে। তারপর দীর্ঘদিন তারা লাপাত্তা। মিয়াছদ্দিনের নতুন বউ কেঁদে কেঁদে একদিন ঠিকই থেমে যায়। হারাণের বাড়ির লোকজনও নিরাশ হয়ে ফিরে পাবার আশা ছেড়েই দেয় একপ্রকারের। গ্রামের অন্যরাও যুদ্ধের মধ্যে যে যার জীবন নিয়ে পালাতে থাকে। ঠা ঠা শব্দে পুরো দেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে নয় মাস। যুদ্ধ শেষে সোনামুখী গ্রামের কেউ ফিরে আসেনি। তাদের মা বাবারা অপেক্ষায় অপেক্ষায় একসময় শোক ভুলে যেতে আরম্ভ করে।

 

দুপুর যায় যায় তখন। শার্শা কামারবাড়ির মোড়ে গাড়ি থেকে নেমে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দিক ঠিক করে নেয় মিয়াছদ্দিন। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে সে। মোড়ে ধূলোর মধ্যে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই কিছু ধুলা লাফিয়ে উঠে পুনরায় আবার ঘাড় কাত করে থিতিয়ে জমে যায়। ধূসর পর্দার মতো কিছু ধূলো উড়ছিল বাতাসের মধ্যে। খটখটে শূন্য সুদীর্ঘ রাস্তাটা যেন এঁকেবেকে ছায়াহীনভাবে জাতিসাপের মতো রোদের মধ্যে শুয়ে নাক ডাকছে। পাশ দিয়ে একটা গরুর গাড়ি তড়বড় করে ঢালু রাস্তায় নেমে পড়ল। কাঁচা মাটির উপর উইয়ের ঢিবি ভেতর থেকে ড্যাবড্যাব করে কয়েকটা উইপোকা যেন মিয়াছদ্দিনের দিকে তাকিয়ে হাসে। রাস্তার কোলঘেষে পড়ে আছে ৫-৭টা কাটা বাবলা গাছের গুঁড়ি। পায়ের দিকে খেয়াল না করে ধ্যাবড়াধ্যাবড়া পা ফেলে মিয়াছদ্দিন এগোতে থাকে উত্তর দিকে। তার দৃষ্টি সোজা প্রসারিত সামনে। দ্রুত হাঁটতে থাকে সে। আর আশায় থাকে পরিচিত কেউ দেখলে তার সঙ্গে আলিঙ্গন করবে। রাস্তা আর শেষ হয় না। ঘাড় বরাবর নেমে গেছে চুলটা। পায়ে রঙজ্বলা হাওয়ায় চপ্পল। ফিতেটা খেঁজুরের কাঁটা দিয়ে আটকানো। গায়ে ছিঁড়ে যাওয়া ফতুয়া। বাম পাশের পকেট উপর থেকে ছিঁড়ে বুকে লেপ্টে ঝুলে আছে। সূর্যের দিকে মুখ তুলে তাকায় মিয়াছদ্দিন। সামনে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বিস্তৃত মাঠটা। রাস্তার দুই পাশে ছোট খালের মধ্যে জল জমে আছে, তারি মধ্যে ৭-৮টা গরু গায়ে গায়ে ঠেসে অর্ধেক শরীর জলে ডুবিয়ে মিয়াছদ্দিনের দিকে আলস্যভরে তাকায়।

 

চারিদিকে লোকশূন্য প্রায়। নিঃশব্দ সমুদ্রের মতো ধূ ধূ করছে। গোধূলির ছায়া পড়বে পড়বে ভাব। সমগ্র দেশটা আজ নয় মাস ধ্বস্তাধ্বস্তি করে বিবর্ণ ও বিধ্বস্ত। খলসেমারির বিলটা দেখে আনমনা ও অচেনা ভাবটা কেটে যায় তার। সতেজতায় দেহটা কেঁপে ওঠে। এই তো, এখানে ছোটবেলায় ন্যাংটো হয়ে কত ঝাপিয়ে পড়েছে সে। স্মৃতির বাতাসের ঝাপটায় তার শরীরটার ভেতরে জানালাগুলো খুলে যায় সাটাসাট। কেমন যেন মেঠো মেঠো ঘেসো ঘেসো গন্ধ ঢুকে পড়ে মিয়াছদ্দিনের নাকে। একটু দূরে তাকাতে দেখলো বন্দে মাঠটা কেমন তকতক করে উঠছে, কয়েকজন কৃষক নিড়ানি হাতে কাজে ব্যস্ত। উত্তেজিত বোধ হয় মিয়াছদ্দিনের। দুজনকে চিনতেও পারে সে। মুহূর্তে তার মনে সন্দেহ জাগে তারা তাকে চিনতে পারবে তো? আগন্তুক ভেবে তাড়িয়ে দেবে না তো ! তার খুব ইচ্ছে হয় এক দৌড়ে তাদের কাছে গিয়ে বলবে, ‘এই যে আমি। আমি তোমাদের মিয়াছদ্দিন। এই যে দেখো, দেখো।’ কিন্তু পরক্ষণে কারও চোখ তার দিকে না পড়াতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয় সে। তাদের কাছাকাছি গিয়ে জিজ্ঞেস করে, দুলাল কাকা, ভালো আছো তোমরা?

 

কেউ কেউ সাড়া দেয়। অন্যরা বোবার মতো তার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। যেন তার কথায় তাদের ভেতর কোন প্রভাব পড়েনি। সে ভাবে, আমার চেহারা কি খুব বেশি বদলে গেছে? নাকি সে অন্য গ্রামে চলে এসেছে? তাদের উৎসাহে ভাটা পড়া দেখে আরও কাছে গিয়ে সে বলে, আমাকে তুমরা চিনতি পারচো না?

 

 

দৃষ্টি তাদের স্থির। এবার মিয়াছদ্দিনের মনে হয় তারা তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে অথবা তারা তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করতে চাচ্ছে। খলিল সর্দার অবশেষে তাকে চিনতে পারে। ‘আরে তুমি আমাদের মিয়াছদ্দিন না। আমরা ভাবছিলাম তুমি বোধহয় হারিয়েই গেছো।’ মিয়াছদ্দিন ভেতরে ভেতরে অপমানিতবোধ করে। তিক্ততায় গলা পর্যন্ত ভরে ওঠে। তাদেরকে পেছনে রেখে সামনে এগোতে থাকে সে। তার সেই গ্রাম আর আগের জায়গায় নেই। ভাবে সে। তারা যেন তার কাছ থেকে কোনো কিছু গোপন করতে চাচ্ছে। পুরনো বাড়ি ও বন্ধু-বান্ধবদের কথা মনে পড়ে তার। সে ভাবে তার বাবার কথা, মায়ের কথা। হঠাৎ তার দেহে উষ্ণতা আনে বউ সোনাভান। হৃদপিণ্ডের চলাচল দ্রুত হয়। কামনা তরঙ্গায়িত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। বউয়ের কথা মনে পড়াতে সে গ্রামের মাঠে কাজ করা মানুষদের কথা ভুলে যেতে শুরু করে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে বাড়ি পৌঁছতে হবে এখন। মিলিটারি ক্যাম্পে যখন সে ছিল তখন সারাক্ষণ নিজ গ্রাম ও তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা ভেবে সময় কাটাতো।

 

ক্যাম্পে তার কাজ ছিল মিলিটারিদের রান্না করে খাওয়ানো। একদম ভালো লাগতো না তার এই কাজ। এটা ছিল দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। কিন্তু কী করার ছিল তার? সে ছিল একটু ভীরু প্রকৃতির। যতবার না করতো, বন্দুক উঁচু করলেই কুকড়ে যেত সে। তার সঙ্গে আরও যারা ছিল সবাই কেউ তাদের বউয়ের কথা, কেউ প্রেমিকার কথা তুলতো। কেউ বলতো, আমি একটি বাচ্চাসহ বউকে দেখে এসেছি। কেউ বলতো, বউয়ের পেটে বাচ্চা। কেউ বলতো, আংটি পরিয়ে এসেছি। এভাবেই সময়গুলো কাটতো তাদের। সবাই অপেক্ষায় ছিল বাড়িতে গিয়ে নতুন ঘর বাঁধবে। শুরু হবে নব জীবন। মিয়াছদ্দিন স্বপ্ন দেখতো তাদের একটা মেয়ে হবে। আর তার বউ দেখতো একটা ছেলের স্বপ্ন। এসব ভাবতে ভাবতে তার উড়ে যেতে ইচ্ছে করে। জোরে জোরে পা চালাতে চালাতে ভাবে, হঠাৎ তার বাবার দেখা পেয়ে যেতে পারে, কিংবা ভাইয়ের অথবা বোনের।

 

চনমন করে ওঠে তার পুরো শরীর। রাস্তার ধারে একটা বাবলা গাছে চড়ে বসে সে। দেখে পুরো গ্রামটাতে কেমনজানি অচেনা ধুসরতার ধূলো মিশে একটা কুয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। দূরে পশ্চিমে করমচার মতো লাল সূর্যটার এককোণ ফুটে আছে রক্তজবার মতো। গাছ থেকে নেমে গ্রামের অনেক নতুন মুখের সঙ্গে তার দেখা হয়। বিভিন্ন বিষয় সে জানতে চায়। কেউ তেমন তাকে পাত্তা দেয় না। ক্লান্ত পায়ে পায়ে অবশেষে সে তার নিজের বাড়ির উঠোনের এককোণে এসে পা ফেলে। দূরে বারান্দায় একপাশে তার বাবা একটা দু পেয়ে চেয়ারে বসে উদাসীন হয়ে চেয়ে আছে বাইরে। তাকে বেশ বুড়ো ও অসহায় লাগছে। ধীরে ধীরে কাছে এসে ডাক দেয় সে-বাবা, ও বাবা।

 

একদৃষ্টিতে বাবা তাকিয়ে থাকে তার দিকে। নিরুত্তর। নিরিখ করে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকায় তার দিকে। অস্থির লাগে মিয়াছদ্দিনের। ‘আব্বা আমাকে চিনতি পারছেন না?’

 

হঠাৎ থরথর করে কেঁপে ওঠে তার বাবা। অজানা একটা আতঙ্ক তাকে ঘিরে ধরে। ঘর থেকে তার মা দৌড়ে এসেই বলে, ‘বাবা গো, সোনাভান তো নাই !’

 

মাথার মধ্যে দপ করে জ্বলে ওঠে তার। এরপর বুকের ভেতর দুপদাপ শব্দ হতে থাকে মিয়াছদ্দিনের। তার বিশ্বাসই হতে চায় না সোনাভান নেই। তার মা তাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! বলে, ‘তাকে কখনো অন্য চোকে দেকিনি আমরা। সে ছেলো আমাদের মেয়ের মতো। কিন্তু তার মা-বাবা, ভাই বোনেরা এসে একদিন জানায়, তুই নাকি মরে গিছিস। আর কখনো ফিরে আসপিনে। এই বলে তারা তাদের মেয়েকে নিয়ে ইন্ডিয়া চলে গ্যাছে। পরে ছিদামের কাছে শুনলাম, সোনাভানকে নাকি আরও একটা বিয়ে দিইচে। বাবা, একটা বাচ্চাকাচ্চা থাকলিও তাকে আমরা রাকতি পারতাম।’

 

মিয়াছদ্দিন যেন এসব কথা শুনতেই পায়নি এতোক্ষণ। আগুনের ফালা হয়ে কান-মাথা সব ঝাঝরা করে বেরিয়ে যাচ্ছিল কথাগুলো। কী করবে কিছুই বুঝতে পারে না সে। ভীষণ ক্লান্ত বোধ হয় তার। বারান্দায় ঢলে পড়ে। ঘুমিয়ে যায়। রাতে স্বপ্ন দেখে, সোনাভান তাকে যেন বলছে, ‘তুমি একটা আস্ত ভীতুর ডিম। বাংলাদেশি হয়ে গোলামি করলা ওই ধর্ষক পাকিস্তানিদের। ধিক্ তুমারে, শত সহস্র ধিক! আমি একবার তুমারে বলেছিলাম দুপুরচন্দ্র ফুল এনে দিতে। তুমি সেটাও পারোনি। তুমি পুরুষ না, মেয়েলোক। বুঝলা, মাগী লোক।’

 

স্বপ্নের মধ্যে নির্বাক থাকে মিয়াছদ্দিন। বুকের নিঃশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করে। ভীষণ পানি তেষ্টা পায় তার। কিন্তু কোথাও কোন পানি নেই। ঘুম থেকে জেগে যায় সে। আকাশে তখন চাঁদটা হলুদ হয়ে পুরো ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে। সে সিদ্ধান্ত নেয় আগামীকাল ইন্ডিয়া যাবে। সঙ্গে নিয়ে যাবে দুপুরচন্দ্র ফুল। কিন্তু তার জন্যে তাকে অপেক্ষা করতে হবে দুপুর পর্যন্ত। ভোরবেলা কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে মিয়াছদ্দিন। খলসেমারি বিলের ধারে শোয়ানো একটা বাবলা গাছের উপর পাছা পেতে বসে পড়ে সে। আর অপেক্ষা করে কখন দুপুর হবে।

 

বাবলা গাছের উঁচু ডালে ভাঙাচোরা বাসা করে আছে একটা শালিক। নতুন মনে হলো বাসাটা। এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। যশোর ক্যান্টনমেন্টে মিলিটারিদের ক্যাম্পে থাকাকালীন সে যে রান্নার কাজ করতো এবং সেখানে তাকে কীভাবে অত্যাচার করা হতো তা সে কারো কাছে বলতে চায় না। এক মেজরের বউয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠায় সে অনেক বারই মরতে মরতেও বেঁচে গেছে। যুদ্ধের শেষ দিকে মেজরের বউ করাচি যাবার সময় তাকে বাবুর্চি হিসেবে সঙ্গে নিতেও চেয়েছিল। শুধু সোনাভানের কথা চিন্তা করে সে রাজি হয়নি। দেশের কথাও অনেক বারই মনে হয়েছে তার। দেশের মানুষজনকে যারা দেদারছে মেরেছে, মা-বোনের ইজ্জত লুটেছে তাদেরকে সে এতোকাল রান্না করে খাইয়েছে।

 

নিজের প্রতি ঘৃণাবোধ হয় তার। বেঁচে থাকার তীব্র বাসনায় জীবনের রিক্স না নিয়ে সে থেকে গেছে মিলিটারি ক্যাম্পে। শুধু এই সুন্দরী স্ত্রীর কথা মনে করে। আর বিনিময়ে তার বউ? একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে মিয়াছদ্দিন। তার এই বেঈমানির শাস্তি সে পাচ্ছে এখন। মুহূর্তে সে শপথ নেয় এবং মনে মনে স্থির করে, বেঁচে থাকতে হলে শক্ত সামর্থ্য পুরুষ হয়েই বাঁচা উচিৎ। বাবলা গাছে একটা ঘুঘু ডেকে ওঠে। দুইটা কাঠবিড়ালি খসখস করে তার পাশ দিয়ে লাফিয়ে পড়ে। দুপুর হয়েছে তাহলে। ভাবে মিয়াছদ্দিন। দুপুরের রোদে চিকচিক করছে খলসেমারির বুক। মিয়াছদ্দিন দুপুরচন্দ্র ফুল খুঁজতে থাকে। দূরে লাল টকটকে একটা কিছু দেখে সে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেদিকেই এগিয়ে যায়। হ্যাঁ, সত্যিই দুপুরচন্দ্র ফুল। হালকা বাতাসে ফুলগুলো বেশ আরামে দোল খাচ্ছে। পাশে সবুজ সবুজ পাতা। ঘোরলাগা দুপুর। দুপুরচন্দ্র ফুলটাকে মিয়াছদ্দিনের কাছে বাংলাদেশের মানচিত্র মনে হয়। সেখানে সোনাভানের মুখ থাকলেও তার মুখ দেখা যায় না। মিয়াছদ্দিন যে ফুলটার কাছে যেতে চাচ্ছিল ঠিক তার পাশে চকরা-বকরা মাথাওয়ালা একটা জাতসাপ ফণা তুলে শূন্যে দুলছে। জিহ্বাটা লকলক করে জ্বলছে আগুনের ফুলকির মতো। সাপটার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সে শুনতে পায়, ‘তুমি পুরুষ না, মেয়েলোক, বুঝলা, মাগীলোক।’

 

আস্তে আস্তে কথাটা প্রতিধ্বনি হতে হতে সারাগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। মিয়াছদ্দিনের ভেতরে ভাঙচুর চলতে থাকে। হৃদকম্পন বেড়ে যায়। দপদপ করে জ্বলে ওঠে সারা শরীর। হাতদুটো শক্ত হয়ে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে সে পাশের কলার ভেলার সঙ্গে আটকে রাখা একটা চইড় আকারের বাঁশ তুলে নেয় হাতে। মাথার উপরে বাঁশটা শো শো করে ঘোরাতে থাকে। কিন্তু তারচেয়ে ক্ষিপ্রতায় প্রায় উড়ে এসে গোখরাটা ফস করে একবার ছোবল মেরে দ্বিতীয়বার ছোবল মারার জন্য ফণা তুললে সঙ্গে সঙ্গে মিয়াছদ্দিন ফণার উপর সজোরে বাড়ি মারে। সাপটা দূরে ছিটকে পড়ে। মস্তকটা দু’ভাগ হয়ে কয়েকটা পাক খেয়ে স্থির হয়ে যায়। মিয়াছদ্দিন কীসের যেন চাপাক্রোধে বাঁশ দিয়ে সাপটাকে পেটাতেই থাকে, পেটাতেই থাকে। মারতে মারতে তার মাথাটা ঝিমঝিম করে। হাতের দিকে নজর পড়তেই দেখে দুটো রক্তের বিন্দু হিরার মতো চকচক করছে। এমন সময় তার ভীষণ ঘুম পায়। 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়